রাষ্ট্র-জনগণের সম্পর্ক হ্যান কাং যেভাবে দেখেন

হ্যান কাংয়ের উপন্যাসটি বাংলাদেশে এসে জুলাইতে অনেকখানি বাস্তব হয়ে গেছে
সাহিত্যে নোবেল পেলেন দক্ষিণ কোরিয়ার হান ক্যাং, ছবি: সংগৃহীত

দক্ষিণ কোরিয়া থেকে প্রথমবারের মতো সাহিত্যে নোবেল জিতলেন ৫৩ বছর বয়সী লেখিকা হ্যান কাং। রাষ্ট্রীয় বাহিনী দ্বারা ছাত্রদের আন্দোলনকে দমন করতে হত্যাযজ্ঞ চালানো এবং আন্দোলনে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে লেখা হ্যান কাংয়ের উপন্যাসটির দিকে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে নোবেল কমিটি। 

১৯৭০ সালের শেষে জন্ম নেয়া হ্যান কাং লেখালেখি শুরু কবিতার মাধ্যমে ১৯৯৩ সালে। একটি সাহিত্য ম্যাগাজিনে ছাপা হয় তার পাঁচটি কবিতা। পরের বছর ঔপন্যাসিক হিসেবে অভিষেক হয় তার। তিন দশকের লেখালেখিতে আন্তর্জাতিকভাবে তিনি নজরে আসেন অনেক পরে। ২০০৭ সালে প্রকাশিত 'দ্য ভেজেটেরিয়ান' উপন্যাসটি ইংরেজি অনুবাদে প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে। বইটি আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার জিতে নেয়। উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন ডেবোরো স্মিথ। ২০১৬ সালে ঢাকা লিট ফেস্টে এসেছিলেন ডেবোরো স্মিথ। আর 'দ্য ভেজেটেরিয়ান' উপন্যাসটি বাংলায় অনুবাদও হয়েছিল, প্রকাশ করেছে সময় প্রকাশন। 

হিসেব করলে হ্যান কাংয়ের আন্তর্জাতিক পরিচিতি মোটের উপর দশ বছর। এত কম সময়ের পরিচিতিতে নোবেল পুরস্কার জেতার ঘটনা আগে সেভাবে ঘটেনি। তার উপর এবারে নোবেল প্রত্যাশী যেসব লেখকদের নাম সামনে আসছিল, হ্যান কাং তাদের মেয়ের বয়সীই হবে। এর বাইরেও মজার একটি বিষয় হলো, ২০১২ সাল থেকে (কাজিও ইশিগুরো ব্যতিরেকে) এক বছর পরপর সাহিত্যে নারী লেখককে নোবেল জিততে দেখা যায়। ২০২৪ সালের নোবেলেও এই ধারাবাহিকতা দেখা গেল। সব মিলিয়ে এবারের সাহিত্যের নোবেল বেশ অদ্ভুতই বটে। 

লেখালেখির ক্যারিয়ারে প্রথম তিন বছরে যথাক্রমে কবিতা, উপন্যাস ও ছোটগল্পকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন তিনি। তার বাবাও ছিলেন একজন লেখক। ১৯৭০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার গেয়াঞ্জু শহরে জন্ম নিলেও তিনি বেড়ে ওঠেন সিওলে। নোবেল প্রাপ্তির খবর যখন শুনছেন, তখনও ছেলের সঙ্গে নৈশভোজ শেষে সময় কাটাচ্ছিলেন নিজের সিওলের বাড়িতে। তার নাম ঘোষণার সময় নোবেল কমিটি জানায়, 'দুর্বলদের প্রতি তার অনুভূতি, সঙ্গে সঙ্গে জীবনের স্পর্শকাতর দিকগুলোকে বিভিন্ন রূপকের মাধ্যমে হ্যান কাং অভিনবভাবে গদ্যে তুলে ধরেছেন। শরীর ও আত্মা, জীবন ও মৃত্যু - এই দুইয়ের মাঝে অদ্ভুত সংযোগ ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন তিনি। কাব্যের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে গদ্যের নতুন ধারার সূচনা ঘটিয়েছেন হান কাং'।

নোবেল ঘোষণার পর সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়েছিল, যিনি এর আগে হ্যান কাংয়ের কোন বই পড়েননি, তার জন্য প্রথম কোন বইটি পড়া উচিত? নোবেল কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, যদিও প্রতিটি পাঠকের নিজস্ব রুচি ও পছন্দের উপর এই ধরণের পরামর্শ নির্ভর করে। তাছাড়া হ্যান কাংয়ের লেখা কিছু ক্ষেত্রে জটিল ও গূঢ় বিষয় নিয়ে গড়ে উঠেছে, তবুও একটি বই বাছাই করতে হলে তার নাম হবে 'হিউম্যান অ্যাক্ট'।

হিউম্যান অ্যাক্ট বইটি 'সোনানিয়ন ওন্দা' নামে প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। ২০১৬ সালে ডেবোরো স্মিথের অনুবাদে ইংরেজিতে প্রকাশ করা হয়। হ্যান কাংয়ের লেখা সবচেয়ে জটিল চিন্তার অভিনব উপন্যাসের মধ্যে 'হিউম্যান অ্যাক্ট' সবার উপরে। বইটির প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের অদ্ভুত মিল পাওয়া যায়।

হিউম্যান অ্যাক্ট বইটিতে দেখা যায়, ১৯৮০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতা রুখে দাঁড়িয়েছে। সেসময় ঘটনাচক্রে আন্দোলনে যোগ দেয় উপন্যাসটির মূল চরিত্র স্কুল শিক্ষার্থী ডংহো। ছাত্র-জনতার এই আন্দোলন দমন করতে রাষ্ট্রীয় বাহিনী চরম নিপীড়ন চালায়। আন্দোলনকারী অনেক ছাত্রকে তারা হত্যা করে। স্কুল শিক্ষার্থী ডংহো এরকম বেশ কিছু মৃতদেহ উদ্ধার করে এবং তাদের লাশের উপর দক্ষিণ কোরিয়ার পতাকা বিছিয়ে দিতে দেখা যায়। যদিও বিক্ষোভকারীদের বেশিরভাগই ছিল ছাত্র এবং ডংহোর বয়স ছিল সবার চেয়ে কম, তবুও স্বৈরাচারী শাসকের নিপীড়নের উপর বিশ্বাস করা ছিল কঠিন। ডংহোর মা উদ্বিগ্ন অবস্থায় দিন কাটাতে থাকে। 

সেসময় আন্দোলনকারীদের ধরতে রাতের বেলা রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে অভিযান চালাতে দেখা যায়। স্কুল ছাত্র ডংহোর সবচেয়ে কাছের বন্ধু জিয়োংকে তার চোখের সামনেই গুলি করে হত্যা করা হয়। হপ্তাখানেকের মাঝে জিয়োংয়ের বোন জিয়োংমি নিখোঁজ হয়। এমতাবস্থায় সেই এলাকায় রাতে অভিযান করার জন্য আসে বাহিনী। ডংহোর মা তাকে রাতে বাসায় না ফেরার জন্য বলে, কারণ ডংহোকে অভিযান করে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে মা উদ্বিগ্ন থাকে।

উপন্যাসটির এটুকু অংশের সাথে সম্প্রতি বাংলাদেশে ঘটা জুলাই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের অদ্ভুত মিল রয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাই কমিশনারের কার্যালয়-ওএইচসিএইচআরের প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে ১৭ আগস্ট খবর প্রকাশ করে দ্য ডেইলি স্টার। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'বেশিরভাগ মৃত্যুর জন্য নিরাপত্তা বাহিনী ও আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন দায়ী। সংঘাত দমনের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে 'অপ্রয়োজনীয়' ও 'মাত্রাতিরিক্ত' বলপ্রয়োগের গুরুতর ও বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ আছে। এক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য 'হুমকি' না হওয়া সত্ত্বেও নিরস্ত্র প্রতিবাদকারীদের ওপর 'বেআইনিভাবে' রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেড, পাখি শিকারে ব্যবহৃত অস্ত্র ও বুলেটসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে ৩২ শিশুসহ কয়েক শ মানুষ নিহত হওয়ার পাশাপাশি কয়েক হাজার মানুষ আহত হয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ওএইচসিএইচআর বলছে, আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানোর জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেলিকপ্টার ব্যবহার সহিংসতার মাত্রাকে তীব্রতর করেছে। কিছু ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এমন যান ও হেলিকপ্টার মোতায়েন করেছে, যেগুলোতে জাতিসংঘের লোগো ছিল'। 

এছাড়াও হ্যান কাংয়ের 'হিউম্যান অ্যাক্ট' বইতে উল্লেখ করা স্বৈরশাসকের রাতের বেলার অভিযানের সঙ্গেও জুলাইয়ে বাংলাদেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর 'ব্লক রেইড' অভিযানের মিল পাওয়া যায়। ২৮ জুলাই 'শহরজুড়ে ব্লক রেইড, আতঙ্কে নগরবাসী' শিরোনামে খবর প্রকাশ করে দ্য ডেইলি স্টার। সেই খবরে বলা হয়, 'আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সারি সারি গাড়ি যাচ্ছে তাদের এলাকায়—কখনোবা সূর্যাস্তের পর। বাহিনীর সদস্যরা গাড়িগুলো থেকে তড়িৎগতিতে লাফিয়ে নামছে, মুহূর্তেই ঘিরে ফেলছে এলাকা, অবস্থান নিচ্ছে বিভিন্ন পয়েন্টে। কখনো হাতে শক্ত করে ধরা বন্দুক, তর্জনী ট্রিগারে, ব্লক রেইডের কারণে অনেক শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, এসব আতঙ্কিত পরিবারগুলোর অনেকে ইতোমধ্যে তাদের বাড়িঘর ছেড়েছে এবং ঢাকা ছাড়ার অপেক্ষায় রয়েছে'।

হ্যান কাংয়ের উপন্যাসটি বাংলাদেশে এসে জুলাইতে অনেকখানি বাস্তব হয়ে গেছে। যদিও উপন্যাসের নৃশংসতাই নোবেল একাডেমিকে তাড়িত করেছে এবং বিশ্ববাসীকেই বইটি পড়ার ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছে। হ্যান কাংয়ের লেখায় মানসিক ভঙ্গুরতা এসেছে অভিনবভাবে। তার বইগুলোতে বারবার মানুষের শারীরিক নিপীড়ন ও মানসিক বিষণ্ণতাকে পাশাপাশি দেখানো হয়েছে। প্রশ্ন করা হয়েছে, পৃথিবীর উত্তাল সময়ে শান্তির নামে অশান্তি ছড়ানো মানুষগুলো নিয়ে।

ফিরে যাই উপন্যাসে। হিউম্যান অ্যাক্ট উপন্যাসটির এই পর্যায়ে লেখক ডংহোর মৃত বন্ধু জিয়োংয়ের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গল্পটি বর্ণনা করা শুরু করে। সেখানে দেখা যায়, জিয়োং একটি লাশের স্তুপের মাঝে পরে আছে এবং সে বুঝতে পারছে তার নিখোঁজ বোন জিয়োংমিকেও সম্ভবত মেরে ফেলা হয়েছে। সে তার জীবিত বন্ধু ডংহোকে নিয়ে ভাবে এবং এসব হত্যাকান্ডের শাস্তি একসময় স্বৈরশাসক পাবে তার আশা ব্যক্ত করতে থাকে। ঠিক সেসময়ই সে বুঝতে পারে একদল রাষ্ট্রীয় বাহিনী এসেছে লাশের স্তুপের কাছে, জনগণ থেকে লুকাতে তারা লাশগুলো পুড়িয়ে দিতে চায়।

জুলাই অভ্যুত্থানেও এমন ঘটনার নজির পাওয়া যায়। ৫ আগস্ট আশুলিয়ায় ছাত্রদেরকে হত্যা করে তাদের লাশ পুড়িয়ে ফেলে পুলিশ। এই ঘটনার ভিত্তিতে র‍্যাব একজনকে গ্রেফতারও করে। ১৩ সেপ্টেম্বর দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত '৫ আগস্টের ভাইরাল ভিডিও: লাশ পোড়ানোর ঘটনায় পুলিশ পরিদর্শক আরাফাত গ্রেপ্তার' শীর্ষক খবরে বলা হয়, 'ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে গত ৫ আগস্ট আশুলিয়া থানার সামনে স্তূপ করে মরদেহ পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় 'সম্পৃক্ত' পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) পরিদর্শক আরাফাত হোসেনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব'। 

হ্যান কাংয়ের উপন্যাসটি বাংলাদেশে এসে জুলাইতে অনেকখানি বাস্তব হয়ে গেছে। যদিও উপন্যাসের নৃশংসতাই নোবেল একাডেমিকে তাড়িত করেছে এবং বিশ্ববাসীকেই বইটি পড়ার ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছে। হ্যান কাংয়ের লেখায় মানসিক ভঙ্গুরতা এসেছে অভিনবভাবে। তার বইগুলোতে বারবার মানুষের শারীরিক নিপীড়ন ও মানসিক বিষণ্ণতাকে পাশাপাশি দেখানো হয়েছে। প্রশ্ন করা হয়েছে, পৃথিবীর উত্তাল সময়ে শান্তির নামে অশান্তি ছড়ানো মানুষগুলো নিয়ে।

তবে এরকম জটিল ও নৃশংসতা নিয়ে লেখার ভাষা হিসেবে হ্যান কাং বেছে নিয়েছে কাব্যময়তা। যে কারণে শহীদুল জহিরের জটিল বাক্যগুলোও নেশার মতো করে পড়া যায়, হারুকি মুরাকামির বিমূর্ত ধারণাকেও পড়া যায় যে কারণে, সে কারণেই হ্যান কাংয়ের কাব্যময় গদ্যে উঠে আসা ভয়ঙ্কর লেখাগুলো পড়া যায় নিমিষেই। গল্পের টানাপড়েন ও বলার ভঙ্গিমা তাই মাঝে মাঝে বাস্তবতা ছাড়িয়ে নিয়ে যায় পরাবাস্তব জগতে। 

হ্যান কাংয়ের লেখার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, বাহুল্য বিবর্জিত লেখা। কলেবরের জায়গা থেকে অতি সংক্ষেপিত এবং মাত্র চারটি উপন্যাস লিখেই নোবেল জিতে নিয়েছেন তিনি। পৃষ্ঠার হিসেবেও সেটা ৬০০ থেকে কম। আমাদের পরিচিত অনেক লেখকের একটি উপন্যাসের চেয়ে কম, হ্যান কাংয়ের সারাজীবনের গদ্য। চাইলে গোটা হ্যান কাং পড়ে ফেলা যায় এক সপ্তাহে। বাহুল্য বিবর্জিত স্পষ্ট অথচ জটিল চিন্তার এই লেখাগুলোর দ্বারা দক্ষিণ কোরিয়ান কাব্যময় লেখার ভঙ্গিমায় হ্যান কাং আমাদের নিয়ে যায় এমন এক জগতে, যেখানে বাস্তবতার ভয়াবহতা টের পাওয়া যায় ক্রমেই। মৃত লাশের মনে হতে থাকে জীবিত নিপীড়নের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা, অথচ আমাদের মনে হয়েছিল মৃত্যুই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর।

Comments