‘আমরা যদি ভাঙতেই থাকি, দেশ গড়ব কবে’

চলছে অমর একুশে বইমেলা ২০২৫। প্রতিদিন মেলায় আসছে নতুন বই। এর মধ্যে প্রকাশ হয়েছে কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক আহমাদ মোস্তফা কামালের বই-রূপ-নারানের কূলে, প্রকাশ করেছে কথা প্রকাশ। নতুন বই ও নিজের লেখালেখি-বইমেলা নিয়ে তিনি কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে।
গণ অভ্যুত্থান পরবর্তী বইমেলায় কি ভিন্নতা দেখছেন?
আহমাদ মোস্তফা কামাল : বইমেলা খুব বেশি ঘুরে দেখা হয়নি। আড্ডা দিয়েই সময় পেরিয়ে গেছে। সেজন্য বিস্তারিত বলতে পারবো না। পাখির চোখে এটুকু ধরা পড়েছে যে, মেলার সাজসজ্জায় ব্য়াপক পরিবর্তন এসেছে। দোয়েল চত্বর থেকে টিএসসি পর্যন্ত রাস্তার দু'পাশ এবং মেলাপ্রাঙ্গণ সাজানো হয়েছে গণঅভ্যুত্থানের থিম দিয়ে। দৃষ্টিনন্দন সাজসজ্জা। জুলাইয়ের সেই উত্তাল দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দিয়েছে পোস্টার এবং ব্যানারগুলো। সেটিই প্রত্যাশিত ছিল। এত বড় একটা রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানের পর তার কোনো দৃশ্যমান চিহ্ন না থাকলেই বরং খারাপ লাগতো।
কী ধরনের বই আসছে, কীরকম বিক্রি হচ্ছে,পাঠকরা কীভাবে সাড়া দিচ্ছেন-- এসব প্রথম সপ্তাহে বোঝা যায় না। বোঝা যাবে দ্বিতীয় সপ্তাহ পার হলে। আশা করি মেলা জমজমাট হয়ে উঠবে দু-চারদিনের মধ্যেই।
'রূপ-নারানের কূলে' বই বিষয় বস্তু সম্পর্কে ধারণা দিবেন
'রূপ-নারানের কূলে' বইয়ের সব গল্পই নতুন। সব গল্প তো একরকম হয় না। এই বইয়ের বেশ কয়েকটি গল্প মরমী ধাঁচের। সেজন্যই বইয়ের নামকরণ ওরকম। আমার ধারণা, প্রকৃতির একটা বন্ধ দরজা আছে, আছে আড়াল। আমরা যেটুকু দেখি সেটুকুই সব নয়, বরং সামান্যই। যা কিছু প্রকাশিত, তাও সব নয়, আছে আরো অপ্রকাশিত বহু কিছু। দৃশ্যমান জগতের বাইরেও আছে অদৃশ্য এক মহাজগৎ, এক অপার বিস্ময়। আমাদের আশেপাশেই থাকে সেসব, তবু আমরা দেখতে পাই না, এমনকি অনুভবও করতে পারি না। কারণ, ওই অদৃশ্য দরজাটা বন্ধই থাকে, খোলার সাধ্য নেই কারো, নিজে থেকে না খুললে কেউ জানতেই পারে না, দরজার ওপারে কী আছে।
এমনকি এও জানা হয় না যে, একটা দরজা বন্ধ হয়ে আছে। প্রকৃতি সেই দরজা সবার জন্য খোলে না, খোলে অল্প কিছু নির্বাচিত মানুষের জন্য-- অনেক দুর্ভোগ আর অকথ্য যন্ত্রণার অসহনীয় ভার বয়ে যাবার বিনিময়ে। এই গ্রন্থের কিছু গল্পের কতিপয় চরিত্র, অতি সাধারণ মানুষ হয়েও, হয়তো সেই অচেনা জগতের সন্ধান পেয়েছিল। গল্পগুলো তাদের, এবং আমাদেরও, যারা দৈনন্দিন নিষ্ঠুর বাস্তবতার ভেতরে বাস করেও এক পারমার্থিক জীবনের সন্ধান করি।
জুলাই সংকটে আপনার ভূমিকা অসামান্য দরদী ছিল। এই সাহস আপনার বয়সী অন্য লেখকদের মধ্যে কতটা দেখেছেন?
আমি ছাড়াও আরো অনেকেরই সাহস ছিল। তবে সবার ছিল না। মানুষের নানারকম সীমাবদ্ধতা থাকে। অনেকে চাকরিবিধি মেনে চলতে গিয়ে সত্য বলতে পারেন না, অনেকে পরিবারের সদস্যদের মিনতি শুনতে বাধ্য হন, এইরকম কতকিছু! সময়টা তো ভয়ের ছিল। কথা বলার জন্য, কার্টুন আঁকার জন্য, লেখার জন্য নিগৃহীত হয়েছেন কত মানুষ! ওরকম ভীতিকর সময়ে কেউ সাহস করে না উঠতে পারলে তাকে আমি দোষ দিতে চাই না, বরং তাকাতে চাই সহমর্মিতার চোখে।
তবে হ্যাঁ, সুবিধাবাদি লেখক-কবি-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীও তো কম ছিল না। তারা নানান সুবিধার জন্য নিজেদের মস্তিষ্ক, হৃদয়, মেরুদণ্ড সবই সঁপে দিয়েছিলেন ইতিহাসের জঘন্যতম স্বৈরশাসকের পদতলে। বিনিময়ে পেয়েছেন টাকাপয়সা-প্লট-ফ্ল্যাট-পদ-পদক-পুরস্কার, বছরে একবার গণভবনে চা-চক্রে নিমন্ত্রণ, সেখানে গিয়ে হাত কচলে এক খুনী স্বৈরাচারের দয়া ভিক্ষা করেছেন এরা। এদেরকে আমি লেখক/কবি/বুদ্ধিজীবী বলে মনেই করি না।
বাংলা একাডেমি পুরস্কার নিয়ে যা হলো— একজন লেখক হিসেবে কিভাবে দেখছেন?
পুরস্কার নিয়ে আমি কখনো কথা বলতে চাই না, আমার রুচিতে বাঁধে। কিন্তু প্রতি বছরই এ নিয়ে কথা ওঠেই। এ বছর ঘটলো তা নিয়ে আমি আগেই আমার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছি। ঘোষিত পুরস্কার স্থগিত করে এবং পরে দুজনের পুরস্কার বাতিল করে অত্যন্ত খারাপ একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাংলা একাডেমি। তাঁরা তো একাডেমির কাছে পুরস্কার চাননি, তাহলে ঘোষণা করে ফের বাতিল করা হলো কেন? আপনি কাউকে সম্মান জানাতে না-ই পারেন, সেটা আপনার স্বাধিনতা, কিন্তু বিনা কারণে বাসায় ডেকে নিয়ে অপমান এবং অসম্মান করার অধিকার তো আপনার নেই।
কোনো পুরস্কারই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। এবারের পুরস্কার তো আগের বছরগুলোর তুলনায় অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য ছিল। পুরস্কারপ্রাপ্তরা অযোগ্য, এরকম কথাও খুব একটা শোনা যায়নি, যেমনটি শোনা যেত আগের বছরগুলোতে। দুজনকে নিয়ে যে সমালোচনা ছিল তা লেখার নয়, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার। এজন্য যদি পুরস্কার বাতিল করতে হয়, তাহলে আগেই কেন নীতিমালা ঠিক করে নেননি? কেন ভাবেননি যে, গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী উত্তপ্ত সময়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হলে তা সামাল দেবেন কী করে? প্রশ্ন হচ্ছে, সাহিত্য পুরস্কার কি রাজনৈতিক বিবেচনায় দেওয়া হবে নাকি সাহিত্যের মান বিবেচনায়? আওয়ামী আমলে তো রাজনৈতিক বিবেচনায় দেওয়া হতো। আওয়ামী সরকারের মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, এমনকি সচিবরাও সরাসরি হস্তক্ষেপ করতেন। লেনদেন, ধরাধরি, দেনদরবার সবই হতো।
আমরা সেসব জানি। এখনো কি সেগুলো চলবে? এসব বিষয়ে একাডেমির পরিষ্কার অবস্থান নেওয়া উচিত ছিল। হ্যাঁ, যদি কোনো লেখক গণহত্যার সমর্থক হয়ে থাকেন, কিংবা ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে থাকেন, তাহলে তিনি কোনোভাবেই পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য নন, মানসম্পন্ন লেখক হলেও না। কারণ পুরস্কার কেবল একটা ক্রেস্ট, প্রশংসাপত্র বা টাকার ব্যাপারই নয়, এটা একধরনের সামাজিক স্বীকৃতি। একজন অপরাধীকে সেই স্বীকৃতি না দেওয়াই সঙ্গত। একাডেমির উচিত এইসব বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা করা। আমি মনে করি, পুরস্কার ঘোষণার পর কেবল কতিপয় অতি-বিপ্লবীর হুমকিতে সেই পুরস্কার বাতিল করে বাংলা একাডেমি ন্যায়সঙ্গত আচরণ করেনি।
সাহিত্য-সংস্কৃতি মানুষের বোধের জাগরণে কিভাবে কাজ করে? আমরা কি সে ভূমিকা রাখছি?
সাহিত্য-সংস্কৃতির কাজ হলো সংবেদনশীল হৃদয় তৈরি করা, যে হৃদয় অন্যের দুঃখে কাতর হবে, অন্যের বেদনায় অধীর হবে। শুধু হৃদয় নয়, একইসঙ্গে মননশীল চিন্তা করতে শেখায় সাহিত্য, যে চিন্তা শুভ ও কল্যাণের দিকে, ন্যায় ও সত্যের দিকে মানুষকে ধাবিত করে। কিন্তু সংবেদনশীল হৃদয় বা মননশীল চিন্তা এক দিনে গড়ে ওঠে না, এর গতি খুব ধীর। তবে একবার গড়ে উঠলে তার বিনাশও হয় না, চিরকাল তা রয়ে যায়। সেজন্য সাহিত্যের কাছ থেকে তাত্ক্ষণিক কোনো ফলাফল আশা করা ঠিক হবে না। বরং দেখা দরকার, এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব আছে কি না। এই যে আমরা দুজন যেসব কথা বলছি, সেসব বলতেই পারতাম না যদি সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের সংযোগ না ঘটতো। তার মানে, আমাদেরকে তৈরি করার জন্য পূর্বসুরি লেখকদের অবদান রয়েছে, আমরা হয়তো অনেকসময় তা বুঝেও উঠতে পারি না।
স্বৈরাচারের সংস্কৃতি থেকে কতটুকু বেরুতে পেরেছি,? লেখক হিসেবে রাজনৈতিক পরিবর্তন দেখেন?
এখনো বিরাট কোনো পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি না। দীর্ঘকাল ধরে আওয়ামী লীগ সব বিষয়েই তাদের বয়ান বা ন্যারেটিভ তৈরি করেছে, সেগুলোর ব্যাপক প্রচার করেছে, মানুষের মস্তিষ্কে সেগুলো গেঁথে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে আমরা সেসব থেকে মুক্তি পাবো তা মনে করার কোনো কারণ নেই। এখনো আমাদের অনেক আচরণের মধ্যে আওয়ামী ছাপ রয়ে গেছে। একাডেমি পুরস্কার নিয়েই একটা উদাহরণ দিই। ২০১৭ সালে অধ্যাপক নিয়াজ জামানকে অনুবাদ শাখায় পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা আসার পর মব ভায়োলেন্স তৈরি করেছিল আওয়ামী লীগের অনলাইন সন্ত্রাসীরা। 'বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে' তাঁকে পুরস্কার গ্রহণের জন্য একাডেমিতে না যেতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন তৎকালীন মহাপরিচালক। সেটাও এক ন্যক্কারজনক উদাহরণ ছিল।
সেই একই স্টাইলে এবার কিছু অতি-বিপ্লবী মব ভায়োলেন্সের হুমকি দিয়ে পুরস্কার স্থগিত করতে বাধ্য করলেন এবং লেখকদের জন্য অপমানজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করলেন। তারা বুঝতেও পারলেন না, তারা আওয়ামী আচরণেরই অনুকরণ করছেন মাত্র। আবার রাজনৈতিক পরিবর্তনের কথা যদি বলি, সেখানেও কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন চোখে পড়ছে না। এখন প্রয়োজন শান্ত থাকা, ধৈর্য ধরা, দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। হচ্ছে উল্টোটা। প্রায় সবাই ক্ষিপ্ত, ক্ষুব্ধ, অস্থির। এভাবে অনেক কিছু ভাঙা যায়, দেশ গড়া যায় না। আমরা যদি কেবল ভাঙতেই থাকি, দেশ গড়বো কবে?
Comments