৭ দশকের চীন-তাইওয়ান উত্তেজনা

বেইজিংয়ের হুমকি উপেক্ষা করে যুক্তরাষ্ট্রের হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে। এখন দেখার বিষয় চীন-যুক্তরাষ্ট্র-তাইওয়ানের এই উত্তেজনা কোথায় পৌঁছায় এবং চীন কী ব্যবস্থা নেয়। আর তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র কী ব্যবস্থা নেবে। পুরো বিশ্ব হয়তো এখন সেদিকেই তাকিয়ে আছে।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েন। ছবি: সংগৃহীত

বেইজিংয়ের হুমকি উপেক্ষা করে যুক্তরাষ্ট্রের হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে। এখন দেখার বিষয় চীন-যুক্তরাষ্ট্র-তাইওয়ানের এই উত্তেজনা কোথায় পৌঁছায় এবং চীন কী ব্যবস্থা নেয়। আর তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র কী ব্যবস্থা নেবে। পুরো বিশ্ব হয়তো এখন সেদিকেই তাকিয়ে আছে।

তবে, এই মুহূর্তে চীন ও তাইওয়ানের দীর্ঘদিনের এই উত্তেজনার দীর্ঘ ইতিহাস এক নজরে জেনে যাওয়া যাক।

১৯৪৯: আলাদা হয়ে যাওয়া

মাও সে-তুংয়ের কমিউনিস্টরা ১৯৪৯ সালের অক্টোবরে চিয়াং কাই-শেকের কুওমিনতাঙ (কেএমটি) জাতীয়তাবাদীদের গৃহযুদ্ধে পরাজিত করে বেইজিংয়ের ক্ষমতা দখল করে। এরপর কেএমটি তাইওয়ান দ্বীপে পালিয়ে যায়। একই বছরের ডিসেম্বরে কেএমটি তাইপেইতে তাদের নিজস্ব সরকার গঠন করে এবং চীনের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়।

১৯৫০ সালে তাইওয়ান যুক্তরাষ্ট্রের একটি মিত্র হয়ে ওঠে এবং কোরিয়ায় কমিউনিস্ট চীনের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। সম্ভাব্য হামলা থেকে মিত্রকে রক্ষা করতে যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ান প্রণালীতে একটি নৌবহর মোতায়েন করে।

১৯৭১: জাতিসংঘ ও মার্কিন সম্মতি লাভ করে বেইজিং

১৯৭১ সালের অক্টোবরে বেইজিং জাতিসংঘে চীনের আসন গ্রহণ করে, যা পূর্বে তাইপেইয়ের দখলে ছিল।

১৯৭৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং বেইজিংয়ের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। ওয়াশিংটন 'এক চীন' নীতির প্রতি সমর্থন প্রকাশ করে। যেখানে বলা হয়, তাইওয়ান চীনের অংশ। কিন্তু, তাইপেইয়ের সঙ্গে বাণিজ্য ও সামরিক সম্পর্ক বজায় রাখে যুক্তরাষ্ট্র।

১৯৮৭-২০০৪: সম্পর্কের উন্নয়ন

১৯৮৭ সালের শেষের দিকে তাইওয়ানের বাসিন্দাদের প্রথমবারের মতো চীনের মূল ভূখণ্ডে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। ফলে, পরিবারগুলো পুনরায় একত্রিত হওয়ার সুযোগ পায়।

১৯৯১ সালে তাইওয়ান জরুরি অবস্থা তুলে নেয় এবং একতরফাভাবে চীনের সঙ্গে যুদ্ধ পরিস্থিতির অবসান ঘটায়। এর দুই বছর পর সিঙ্গাপুরে দুই পক্ষের মধ্যে প্রথম সরাসরি আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।

কিন্তু, ১৯৯৫ সালে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট লি টেং-হুইয়ের যুক্তরাষ্ট্র সফরের প্রতিবাদে বেইজিং আলোচনা স্থগিত করে।

১৯৯৬ সালে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটারদের বাধা দিতে ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করে চীন।

২০০০ সালের নির্বাচনে কেএমটি প্রথমবারের মতো তাইওয়ানে ক্ষমতা হারায়। এর পরবর্তী কয়েক বছরে দু'পক্ষের মধ্যে বাণিজ্যিক যোগাযোগ আরও উন্নত হয়।

২০০৫-২০১৫: হুমকি ও আলোচনা

২০০৫ সালের মার্চে বেইজিং একটি আইন করে। যা তাইওয়ান স্বাধীনতা ঘোষণা করলে শক্তি প্রয়োগের অনুমোদন দেয়। একই বছরের এপ্রিলে চীনা নেতা হু জিনতাওর সঙ্গে আলোচনার জন্য বেইজিংয়ে একটি যুগান্তকারী সফর করেন কেএমটি চেয়ারম্যান লিয়েন চ্যান।

২০০৮ সালে কেএমটির মা ইং-জিউ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তাইওয়ান এবং চীন পুনরায় উচ্চপর্যায়ের আলোচনা শুরু করে।

২০১০ সালে তারা একটি ব্যাপক অর্থনৈতিক সহযোগিতা ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং আলাদা হওয়ার পর ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো সরকার টু সরকার আলোচনা করে।

২০১৬: আবার সম্পর্কের ইতি

২০১৬ সালের জানুয়ারিতে স্বাধীনতাপন্থী ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টির সাই ইং-ওয়েন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়লাভ করেন। ওই বছরের জুনে নতুন সরকার 'এক চীন' নীতি মেনে না নেওয়ায় তাইওয়ানের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় চীন।

২০১৬ সালের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প টেলিফোনে সাইয়ের সঙ্গে কথা বলেন। চীন দাবি করে, এর মাধ্যমে কয়েক দশকের মার্কিন কূটনৈতিক নীতি ভঙ্গ করেন তিনি।

২০১৯ সালের জানুয়ারিতে শি জিনপিং সতর্ক করে বলেন, চীন ও তাইওয়ানের একত্রীকরণ 'অনিবার্য'।

২০২১: চীন-যুক্তরাষ্ট্র উত্তেজনা

২০২১ সালে চীনা সামরিক জেটগুলো তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা অঞ্চলে প্রবেশ করে। ওই বছরের অক্টোবরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, চীন যদি তাইওয়ানকে আক্রমণ করে তবে যুক্তরাষ্ট্র তাকে রক্ষা করবে।

তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট তখন জানান, তাইওয়ানের বাহিনীকে প্রশিক্ষণে সহায়তা করছে কিছু সংখ্যক মার্কিন সেনা।

২০২২: পেলোসি সফর ঘিরে উত্তেজনা বৃদ্ধি

চলতি বছরের ২৩ মে ইউক্রেন ইস্যুতে পশ্চিমাদের রাশিয়ার বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। যেন তাইওয়ানকে জোর করে দখলে নেওয়ার চেষ্টা থেকে বিরত থাকে চীন। এসময় বাইডেন পুনরায় বলেন, আগ্রাসনের হাতে থেকে তাইওয়ানকে রক্ষা করবে যুক্তরাষ্ট্র।

২ আগস্ট পেলোসি চীনা সতর্কবার্তা উপেক্ষা করে এশীয় সফরের সময় তাইওয়ানে অবতরণ করেন। গত ২৫ বছরের মধ্যে তাইওয়ান সফরে আসা সর্বোচ্চ পর্যায়ের মার্কিন কর্মকর্তা পেলোসি বলেন, তার এই সফর তাইওয়ানের প্রতি ওয়াশিংটনের দৃঢ় অঙ্গীকারকে প্রতিফলিত করে।

চীন তাইওয়ানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কর্মকর্তার এই সফরকে 'অত্যন্ত বিপজ্জনক' বলে অভিহিত করেছে এবং এই সফরের প্রতিক্রিয়ায় পাল্টা ব্যবস্থার কথাও বলেছে।

সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া, ডিপ্লোম্যাট

Comments