মাওবাদবিরোধী যুদ্ধে কতটা এগোলো ভারত?
প্রতিরক্ষা ব্যয়ে বিশ্বে ভারতের অবস্থান এখন চতুর্থ। বিগত বছরগুলোতে অবিশ্বাস্য গতিতে ভারতে সামরিক বাহিনীর শক্তি বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ বাজেটে এ খাতে প্রায় ৭৫ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ ছিল।
প্রতিরক্ষা ব্যয়বৃদ্ধির পক্ষে ভারতে নীতিনির্ধারকদের যুক্তি হিসেবে সচরাচর 'প্রতিপক্ষ' চীন-পাকিস্তানের হুমকির কথা আসে। সীমান্তে ওই দুই দেশের হাতে ২-৪ জন সেনা হারালেও ভারতীয় গণমাধ্যমে সেটা বড় শিরোনাম হয়। পুরো দেশের আত্মসম্মানে লাগে সেটা, প্রতিশোধের ডাক ওঠে। ভারতীয় মনস্তত্ত্ব যেকোনো উপায়ে চীন-পাকিস্তানের বিপরীতে সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব চায়। তারই ফল সমর খাতের বলবৃদ্ধি।
কিন্তু এরকম এক পরাক্রমশালী সমরশক্তিকে দেশের মাওবাদী গেরিলাদের বিরুদ্ধে যে দশকের পর দশক লড়তে হচ্ছে, সেটা বিস্ময়করই বটে। চলতি নির্বাচনী উত্তেজনার মধ্যেই ঝাড়খন্ডে মাওবাদীদের সঙ্গে সংঘর্ষের একাধিক খবর বেরিয়েছে। কোন পক্ষ কার কত জওয়ান নির্মূল করেছে, তার চেয়েও বড় বিষয় ভারতে ৪৮ বছর আগে প্রয়াত চীনের নেতার আদর্শের প্রভাব আজও টিকে আছে কীভাবে? এর পেছনে সামাজিক কারণ কী? শিগগির কি এ অবস্থার কোনো সুরাহা হবে?
ডেটলাইন কেওড়াতলা, ১৯৭২
ভারতে মাওবাদী রাজনীতি ও সশস্ত্র সংগ্রামের অন্যতম জনক চারু মজুমদার। তার সহযোগী ছিলেন কানু সান্যাল, জঙ্গল সাঁওতাল প্রমুখ। সবাই বহু আগে মারা গেছেন। আটক অবস্থায় হৃদরোগের জরুরি ওষুধ না পেয়ে মারা গিয়েছিলেন চারু মজুমদার। ক্ষীণ দেহের এই নেতাকে অত্যাচারেরও অভিযোগ উঠেছিল তখন। ৫২ বছর আগে কংগ্রেস শাসনামলের ঘটনা সেসব।
কিন্তু এটা ইতোমধ্যে স্পষ্ট যে, কলকাতার কেওড়াতলা শশ্মানে ১৯৭২ সালের জুলাইয়ে পুলিশ পাহারায় চারু মজুমদারের বিদায়ের পরও এই আদর্শ নিশ্চিহ্ন হয়নি, বরং আদিভূমি নকশালবাড়ি ছাড়িয়ে তার চাষাবাদ ঘটেছে অন্যত্র।
'নকশালবাড়ি কৃষক সশস্ত্রতা'র সংগঠক চারু বাবু, কানু সান্যাল, জঙ্গল সাঁওতালদের গুরু ছিলেন মাও সেতুং। 'চেয়ারম্যান মাও'য়ের একটা উক্তি তাদের খুব প্রিয় ছিল। মাও বলতেন, 'রাজনীতি হলো রক্তপাতহীন যুদ্ধ, আর যুদ্ধ হলো রক্তপাতে ভরা রাজনীতি।'
স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে, ভারতের আজকের মাওবাদীরা রক্তপাতময় কী রাজনীতি করছে? সরকারই বা কেন পাঁচ দশকেও তাদের থামাতে পারল না?
যেসব অঞ্চলে মাওবাদী ব্যাপকতা
গত শতাব্দীর সত্তর ও আশির দশকে পশ্চিমবঙ্গে মূল সংগঠকদের হারানোর পর ভারতীয় মাওবাদী রাজনীতি ছড়ায় অন্ধ্র প্রদেশের দিকে। এখন এর ভরকেন্দ্র প্রধানত অনেকগুলো রাজ্যের মধ্যস্থল 'দন্ডকারণ্য' এলাকায়। 'রেড করিডোর'ও বলা হয় একে। জায়গাটি ছত্তিশগড়-ওডিশা-অন্ধ্র-মহারাষ্ট্রের মধ্যবর্তী কিছু এলাকা মিলে। ঝাড়খন্ড ও বিহারেও মাওবাদের প্রভাব আছে। এসব অঞ্চলের তুলনামূলকভাবে অরণ্য ও আদিবাসী-প্রধান এলাকায় এই আদর্শবাদীদের খোঁজ মেলে। অর্থাৎ ভারতের দরিদ্র পূর্বাঞ্চলে এই সশস্ত্রতা কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে।
কেন এসব অঞ্চলে মাওবাদের কথা শোনা যায়? এর বড় কারণ নিশ্চিতভাবে এখানকার অর্থনৈতিক বঞ্চনা।
গবেষকরা দেখিয়েছেন, সেখানকার আদিবাসীরা অ-আদিবাসী দরিদ্রদের চেয়েও খানিকটা দরিদ্র। অর্থনৈতিক উদারীকরণে দেশের প্রধান প্রধান শহরে যেভাবে চাকচিক্য বেড়েছে, আদিবাসী সমাজে সেরকম ঘটেনি। দেশের জনসংখ্যার মোট হিসাবে যারা প্রায় নয় ভাগ।
সরকার গত এক দশকে দারিদ্র্য পরিস্থিতিতে অনেক উন্নতির দাবি করছে। তবে তাতেও জাতীয় গড় উন্নয়নের চেয়ে পূর্বাঞ্চলের আদিবাসী এলাকাগুলো পিছিয়ে। মাওবাদের আমূল পরিবর্তনের আওয়াজ হয়ত সে কারণেই এসব জনপদে এখনো আবেদনময়। ঐতিহাসিকভাবে চলতে থাকা জাত-পাতজনিত বর্ণ বৈষম্যও সমাজের নিচুতলায় পরিবর্তনকে জরুরি করে রেখেছে।
তবে 'দন্ডকারণ্য' বা আশেপাশের এলাকার বাইরেও আরএএস-বিজেপি ঘেঁষা পত্র-পত্রিকায় 'আরবান নকশাল' বলে দুটো শব্দও বেশ প্রচারিত হচ্ছে ইদানিং।
'আরবান নকশাল' বলতে ইঙ্গিত করা হয় শহুরে মাওবাদীদের, যাদের কাজের এলাকা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গন। যারা মতাদর্শিকভাবে বিশ্বাস করে যে, দক্ষিণ এশিয়ার চলতি শোষণমূলক ব্যবস্থা তথাকথিত ভোটের রাজনীতিতে বদলানো সম্ভব নয়।
হয়ত এ কারণেই ভোট এলেই নকশাল এলাকায় উত্তেজনা ও অভিযান বাড়ে। এবারও হয়তো তাই হচ্ছে। শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া ভোটে বহু দল পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়ছে। এর মাঝে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীগুলো লড়বে মাওবাদীদের বিরুদ্ধে।
'আরবান নকশাল' বনাম ইউএপিএ
ভারতের এখনকার শাসক পরিবার আরএসএসের ঘোষিত তিন আদর্শিক প্রতিপক্ষ হলো খ্রিস্টান, মুসলমান ও কমিউনিস্ট। তিন প্রতিপক্ষই দেশটিতে সংখ্যালঘু। বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ধর্মীয় সংখ্যালঘু খ্রিস্টান ও মুসলমানদের ভারতে বেশ কোনঠাসা করে রাখা হয়েছে।
এককালের একমাত্র মুসলিম প্রধান রাজ্য জম্মু-কাশ্মীরের রাজ্যসুলভ মর্যাদাই বাতিল করা হয়েছে আইনি প্রক্রিয়ায়। খ্রিস্টান প্রধান তিন রাজ্য মিজোরাম, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড মিলে লোকসভায় আসন মাত্র ৪টি। ৫৪৫ আসনের যুদ্ধে এটা ভাবনা-দুর্ভাবনার জন্য সামান্য বিষয়।
অন্যদিকে, ভোটে আস্থা আছে এমন কমিউনিস্টদের রাজনৈতিক প্রভাব শুধু কেরালায় টিকে আছে। এককালের পুরানো ঘাঁটি পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে কমিউনিস্টরা। ফলে বিজেপির জন্য তারা আর বড় কোনো হুমকি নয়।
কিন্তু আরএসএস পরিবার এরপরও 'বামপন্থা'কে বিশেষ প্রতিপক্ষ ভাবে। বিশেষ করে শিক্ষা-সংস্কৃতির অঙ্গনে 'মাওবাদী' মনোভঙ্গীর ব্যাপারে তারা খুব স্পর্শকাতর।
চিন্তা-চেতনায় 'এন্টি এস্টাবলিশমেন্ট' ধাঁচের কাউকে পেলেই 'আরবান নকশাল' বলার চল এখন।
চলচ্চিত্রকার বিবেক অগ্নিহোত্রী যখন 'আরবান মাওবাদী'দের টার্গেট করে 'বুদ্ধ ইন অ্যা ট্রাফিক জ্যাম' সিনেমাটি বানালেন, তখন দেখা গেল খোদ সে সময়কার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং তাকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। অগ্নিহোত্রী পরে সেই মুভি তৈরির পূর্বাপর তুলে ধরে বইও লিখেছেন 'আরবান নকশাল' নামে। এই মুভি ও বই নিয়ে বিজেপি সমর্থক কাগজগুলোতে উচ্ছ্বাসও দেখা গিয়েছিল।
মাওবাদীদের সাংস্কৃতিকভাবে খাটো করতে এরকম আরেক চেষ্টা ছিল 'বস্তার: দ্য নকশাল স্টোরি' সিনেমাটি, যেখানে মাওবাদকে দেশপ্রেমের বিপরীতে দাঁড় করানোর দুর্বল চেষ্টা দেখা গেছে। কেন মানুষ 'পরিবর্তনে'র আওয়াজে আকৃষ্ট হয় তার আর্থ-সামাজিক কারণ খোঁজার কোনো চেষ্টা নেই সাংস্কৃতিক এসব আয়োজনে।
'দ্য নকশাল স্টোরি'র পরিচালকই প্রায় কাছাকাছি সময়ে নির্মাণ করেন 'দ্য কেরালা স্টোরি', যার লক্ষ্যবস্তু ছিল 'মুসলিম সমাজ'। এটিও আরএসএস পরিবারের প্রশংসা পেয়েছিল। লোকসভা নির্বাচনের আগে সিনেমাটি রাষ্ট্রীয় দূরদর্শনে প্রচারের অনুমতি দেওয়া হয়। সরকার কাদের কী উদ্দেশ্যে সহযোগিতা করতে চায়, এসবে তা স্পষ্ট হয়।
মুসলমানদের মতো নকশালদের বেলায়ও বিজেপি ও তার সংগঠকরা বরাবরই নিজেদের সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির ছাপ দেখতে চেয়েছে রাষ্ট্রযন্ত্রে। সেই সূত্রেই হয়ত ভারতে নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের কাছে মাওবাদী সমস্যার দাপ্তরিক নাম 'এলডব্লিউই' বা লেফট উইং এক্সট্রিমিজিম।
এ বছর ২১ জানুয়ারি ছত্তিশগড়ের রাজপুরে এরকম নিরাপত্তা কর্তাদের উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠকে এখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ঘোষণা দিয়েছেন, তিন বছরের মধ্যে মাওবাদীদের নির্মূল করা হবে, সেটা গ্রাম-শহর দুদিক থেকেই।
অমিত শাহের বক্তব্য থেকে এবার যা নতুন পাওয়া গেল, তা হলো—মাওবাদ দমনে সময় বেঁধে দিলেন তিনি।
প্রশ্ন উঠেছে, এটা বাস্তবায়ন যোগ্য কি না? নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর দাবি হলো, হ্যাঁ।
২০০৫ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে বিজেপি-পূর্ব সরকারের তুলনায় ২০১৪ থেকে গত এক দশকে 'এলডব্লিউই সন্ত্রাস' অর্ধেক কমে গেছে। সব মিলে মাত্র প্রায় ৪৫টি জিলায় এখন এই আদর্শবাদী সশস্ত্রতা আছে।
নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের এরকম দাবি নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে তাতে কিছুটা সত্যতাও আছে। দুই বছর আগের তুলনায় মাওবাদীরা বিচরণভূমির অনেকখানি হারিয়েছে। সরকারি এই 'সফলতা'র কারণ প্রশাসন ও শাসক রাজনীতির সমন্বিত চেষ্টা।
রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীর সমন্বিত নিরাপত্তা হানা ছাড়াও 'দন্ডকারণ্য' জুড়ে বহু ধরনের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। আরএসএস পরিবার মন্দির গড়ার ওপর জোর দিয়েছে বেশ। 'ঘর ওয়াপ সি' (ঘরে ফিরে আসা!) নামের এই উদ্যোগে আদিবাসীদের যাদের পক্ষে টানা যাচ্ছে, তাদেরও মাওবাদীদের বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত যোগাড়ে কাজে লাগানো যাচ্ছে। এছাড়া আত্মসমপর্ণকারীদের জন্য রয়েছে আর্থিক সুযোগ-সুবিধা।
'ঘর ওয়াপসি' ধারনার প্রধান বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং এই কর্মসূচির প্রধান ক্ষেত্র তেলেঙ্গানা, অন্ধ্র, ঝাড়খন্ড এলাকা। এই সূত্রে পাওয়া জনবলের একাংশ দিয়ে বিভিন্ন নামে আধা-সামরিক চরিত্রের বাহিনীও গড়া হয়েছিল একসময়, যারা রাষ্ট্রকে মাওবাদীদের দমনে সহায়তা করেছে। এটা ছিল অনেকটা আদিবাসীদের দিয়ে আদিবাসীদের থামানো।
'সালওয়া জুডুম' ছিল ছত্তিশগড়ের এরকম এক বাহিনী, কংগ্রেস শাসনামলে যার গোড়াপত্তন হয়। মানবাধিকার দলনের বিস্তর অভিযোগের পর ভারতের সর্বোচ্চ আদালত একে একটা বেআইনি উদ্যোগ হিসেবে রায় দেয়।
অতীতের এসব উদ্যোগের পাশাপাশি প্রায় একই লক্ষ্যে প্রশাসনের দিক থেকে সম্প্রতি আরেক বড় পদক্ষেপ ছিল প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের গণসংগঠন আরডিএফের (রেভ্যুলুশনারি ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট) কার্যক্রম বিভিন্ন স্থানে নিষিদ্ধ করা। জোটধর্মী এই সংগঠন ভারতজুড়ে বিভিন্ন শহরে ছাত্র, শ্রমিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে র্যাডিক্যাল অবস্থান নিয়ে কাজ করত।
সরকারের অভিযোগ, এদের সঙ্গে সশস্ত্র মাওবাদীদের আদর্শিক যোগাযোগ ছিল। অরুন্ধতী রায় ছাড়া ওই গণসংগঠনের প্রধান বুদ্ধিজীবীরা প্রায় সবাই গ্রেপ্তার বা জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়েছেন বিভিন্ন সময়।
এতে করে 'আরবান' পরিমণ্ডলে 'মাওবাদী চিন্তা'র প্রসারও বড় আকারে হোঁচট খেয়েছে।
আরডিএফ অবশ্য বলে, 'কলম হাতে নেওয়া র্যাডিক্যাল'দের দমন করতেই 'বন্দুক হাতে নেওয়া নকশাল'দের সঙ্গে তাদের ট্যাগ করা হচ্ছে।
এই দাবি সত্য-মিথ্যা যাই হোক, আরডিএফকে কোনঠাসা করার প্রক্রিয়ায় ভারতীয় সমাজের বলা ও লেখার স্বাধীনতা বেশ আঘাত পেয়েছে। বিশেষ করে বুদ্ধিজীবী ও অ্যাকটিভিস্টদের বিরুদ্ধে যেভাবে ইউএপিএ আইন (দ্য আনলফুল অ্যাকটিভিটিজ প্রিভেনশন অ্যাক্ট) ব্যবহার হচ্ছে, তাতে গণতন্ত্রকর্মীরা বিশেষভাবে আপত্তি তুলছেন।
কিন্তু সরকার মনে করছে, মাওবাদী আদর্শভিত্তিক সশস্ত্রতা ভারতের জন্য 'অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা হুমকি'। সেকারণে কাশ্মীর ও উত্তর-পূর্ব ভারতের মতো প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও সামরিক পদ্ধতির পাশাপাশি সাংস্কৃতিকভাবেও এটাকে মোকাবিলা করতে চাওয়া।
মাওবাদীরা কি তবে নির্মূলের পথে?
ভারতজুড়ে মাওবাদীদের বিভিন্ন উপদল ও গ্রুপ থাকলেও এই ধারার প্রধান রাজনৈতিক শক্তি 'সিপিআই-মাওবাদী'। কৃষাণজি, গণপতি, 'কৃষাণ দা' প্রমুখ নেতার মতো এই ধারার পুরোনো নেতারা অনেকে এখন আর মাঠে নেই। কেউ মারা গেছেন, কেউ অবসরে। বর্তমান সংগঠকরাও মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়েই মাঠে থাকেন।
নেতৃত্ব পর্যায়ে বিপর্যয় ঠেকাতে 'সিপিআই-মাওবাদী'রা সাধারণত দুই-তিন স্তরের নেতৃত্ব ঠিক করে রাখে। তবে সরকার আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে যেরকম বিপুল ক্ষমতা দিয়েছে, তাতে চলতি অভিযানের মুখে সংগঠিতভাবে 'মুক্তাঞ্চল' ধরে রাখা 'দন্ডকারণ্যের' মাওবাদীদের পক্ষে বেশ কঠিন। কাশ্মীর ও উত্তর-পূর্ব ভারতে আপাত সফলতার পর ভারতের নিরাপত্তা-প্রশাসন পূর্বাঞ্চলের এই 'সমস্যা'ও দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। কিন্তু সমস্যা রয়ে যাবে অন্যত্র।
ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার সমাজ জীবনে ব্যাপকভাবে ধনবৈষম্য বাড়ছে। পাশাপাশি প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলগুলোর ছত্রছায়ায় থাকা করপোরেটরা প্রান্তিক ও আদিবাসী এলাকাগুলোতে প্রাকৃতিক সম্পদে কর্তৃত্ব পাচ্ছে বেশুমার। এতে সমাজের নিচুতলায় প্রতিনিয়ত যে অসন্তোষ তৈরি হচ্ছে, তা থামবে কোন উপায়ে? ভোটের প্রচলিত রাজনীতি ওইসব অসন্তোষের সন্তোষজনক সমাধান দিতে না পারলে বিকল্প উপায় কী? গ্রাম-শহরের কোথাও পরিবর্তন চাওয়া কয়েকশ বা কয়েক হাজার হাড় ঝিরঝিরে সশস্ত্র গরীব মানুষকে নিরস্ত্র করা হলেই, অন্যায্য সামাজিক সম্পর্কের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ থেমে থাকবে কি না? পেটে ও মগজে অসন্তোষ নিয়ে মানুষ চিরতরে মাথা নুইয়ে থাকতে পারে কি না? ১৯৭২ সালে পশ্চিমবঙ্গে যা ঘটেনি ২০২৪ এ 'দন্ডকারণ্যে' সেটাই ঘটবে কি না?
আলতাফ পারভেজ: গবেষক
Comments