আনোয়ার ইব্রাহিমের হাত ধরে নতুন পথে মালয়েশিয়া?

কুয়ালালামপুর সিটি সেন্টার। ছবি: রয়টার্স

গত ২৪ নভেম্বর ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথম বিদেশ সফরে ইন্দোনেশিয়ায় গিয়েছেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। প্রতিবেশী দেশটির পশ্চিম জাভায় রাষ্ট্রপতির প্রাসাদে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বিষয়ে কথা বললেন প্রেসিডেন্ট জোকো জোকোভি উইদোদোর সঙ্গে। কথা হয় বাণিজ্য, পামশিল্প, সীমান্তবিরোধ নিয়েও।

গত সোমবার ইন্দোনেশিয়ার সংবাদমাধ্যম দ্য জাকার্তা পোস্ট জানায়, আনোয়ার ইব্রাহিমের এই সফরে মালয়েশিয়ার ৮ প্রতিষ্ঠান ৩৭৯ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি করেছে।

একই দিনে মালয়েশিয়ার দৈনিক মালয় মেইল জানিয়েছে, দেশটির ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠা রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্ত করতে প্রভাবশালী সাবাহ প্রদেশের নেতাদের সঙ্গে কথা বলবেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, 'আমি ও উপপ্রধানমন্ত্রী আহমাদ জাহিদ হামিদি মিলে সাবাহ প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হাজি নূরকে বরখাস্তের বিষয়ে গ্রহণযোগ্য সমাধানের চেষ্টা করছি।'

এ হলো মালয়েশিয়ার অতি সাম্প্রতিক অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিষয়। এসব নিয়ে আবারও আলোচনায় দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার 'আকর্ষণীয় দেশ' মালয়েশিয়া। এক সময়ের উদীয়মান অর্থনীতির এ দেশ হঠাৎ গৌরব হারাতে বসে। এর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ডেকে আনে অর্থনৈতিক অচলাবস্থা। থমকে যায় আর্থ-সামাজিক বিকাশ। মুখ ফিরিয়ে নেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা।

মালয়েশিয়ার নাম আসলে প্রথমেই আসে এর বৈশ্বিক গুরুত্বের পথিকৃৎ ড. মাহাথির মোহাম্মদের নাম। তিনি ১৯৮১ সালে প্রধানমন্ত্রী হয়ে সেই পদে আসীন ছিলেন টানা ২২ বছর। মূলত সেই সময়েই মালয়েশিয়া বিশ্ববাসীর কাছে 'আকর্ষণীয় দেশ' হয়ে উঠে।

২০০৩ সালে মাহাথির প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিলে এরপর আর তেমন এগোতে পারেনি মালয়েশিয়া। মূলত সেই সময় থেকেই দেশটির ভাগ্যাকাশে জমতে থাকে অস্থিরতার কালো মেঘ।

আনোয়ার ইব্রাহিম। ছবি: রয়টার্স

এরপর, একে একে কেটে যায় আরও প্রায় ২০ বছর। জেলেপাড়ার জলাগন্ধ থেকে উঠে এসে জমকালো মালয়েশিয়া হওয়ার গল্প অতীতের স্মৃতিচারণ হয়ে উঠে। দেশটিতে শুরু হয় রাজনৈতিক অস্থিরতা, বেড়ে যায় জাতিগত বিভেদ। এসবের সঙ্গে যোগ হয় অর্থনৈতিক মন্দা। যেন ধীরে ধীরে বন্ধ হতে থাকে দেশটির বিকাশ। হতাশ হয়ে ওঠে তরুণ প্রজন্ম।

২০১৮ সালে আবারও ডেকে আনা হয় ৯৩ বছর বয়সী মাহাথিরকে। তবে তিনি এসে সমস্যায় নিমজ্জিত দেশটির হাল ধরতে ব্যর্থ হন। ক্ষমতা ছেড়ে দেন মাত্র ২ বছরের মাথায়। এরপর আরও বেশি অস্থিতিশীল হয়ে উঠে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি মানুষের দেশটি।

গত সোমবার মতামতধর্মী গণমাধ্যম প্রজেক্ট সিন্ডিকেটের এক প্রতিবেদনের শিরোনাম করা হয়, 'মালয়েশিয়ার নতুন দিন?'। শিরোনামে প্রশ্ন রাখা হলেও প্রতিবেদনের শেষে বলা হয়েছে, মালয়েশিয়া যেসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে, সন্দেহ নেই সেগুলো অনেক শক্তিশালী। কিন্তু, এটাও বলা যায়, সেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সাবেক অর্থমন্ত্রী বা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের চেয়ে যোগ্য রাজনীতিক এ মুহূর্তে সে দেশে আর কেউ নেই।

এতে আরও বলা হয়, স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি ও জাতিগত বিভেদের বাইরে এসে সব মানুষের সার্বিক উন্নয়ন মালয়েশিয়াকে সাফল্যের দিকে নিয়ে যাবে। নিয়ে আসবে নতুন দিন।

মালয়েশিয়ার চ্যালেঞ্জ

প্রজেক্ট সিন্ডিকেটের প্রতিবেদন অনুসারে, ব্রিটিশদের হাত থেকে মালয়েশিয়ার স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে দেওয়া বক্তব্যে ২০০৭ সালে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ ই. স্টিগলিৎজ দেশটির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে 'অলৌকিক' বলে অভিহিত করেছিলেন।

কিন্তু, গত ১৫ বছরে দুর্নীতি ও প্রবাসী শ্রমিকদের ওপর অত্যাচারের ঘটনা দেশটির ভেতরে ও বাইরে 'পচন' ধরাতে শুরু করে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মালয়েশিয়া খ্যাতি হারায়। বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় দেশের ভেতরে।

৭৫ বছর বয়সী আনোয়ার ইব্রাহিমের রেকর্ড আছে অর্থমন্ত্রী হিসেবে ১৯৯০ এর দশকে মালয়েশিয়ার প্রবৃদ্ধি ২ অঙ্কে নেওয়ার। তিনি তার রাজনৈতিক মিত্র মাহাথিরের সরকার থেকে বহিষ্কৃত হয়ে জেল খাটলেও তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তেমন 'জোরালো' নয়।

মাহাথির মোহাম্মদ ও আনোয়ার ইব্রাহিম। ছবি: রয়টার্স

এখনকার পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে আনোয়ারের দায়িত্ব দেশের বাজেট ঘাটতি কমানোর পাশাপাশি ঋণের বোঝা হালকা ও বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আনোয়ারকে করোনা-পরবর্তী মালয়েশিয়ার মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরতে হবে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব নাগরিকের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ব্যবসায় নতুনদের আগ্রহী করার পাশাপাশি তাদের প্রণোদনা দিতে হবে।

এসব শুধু মুখে বললেই হবে না। এর জন্য প্রয়োজন বিদ্যমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সংস্কার। স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আন্তর্জাতিকমানে উন্নীত করতে হবে। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

এগুলোই শেষ কথা নয়, আনোয়ার ইব্রাহিমকে সরকারের 'লৌহকঠিন' আমলাতন্ত্র ভাঙতে হবে, দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিকদের প্রভাব কমাতে হবে ও প্রবাসী শ্রমিকদের ভাগ্য নিয়ে কারসাজি বন্ধ করতে হবে। তাহলেই নতুন দিনের পথে হাঁটা সম্ভব।

এসব কথা আনোয়ার ভালোভাবেই জানেন। তার নির্বাচনী ইশতেহারেও এসব ছিল। তবে, তা বাস্তবায়ন অনেক কঠিন। কিন্তু, মালয়েশিয়াকে উন্নত দেশের তালিকায় আনতে এসব জরুরি।

Comments

The Daily Star  | English

Abdul Hamid returns home after treatment in Thailand

Two police officials were withdrawn and two others suspended for negligence in duty regarding the former president's departure from the country

6h ago