ডেইলি স্টারের অনুসন্ধান

এনআরবিসি ব্যাংকের বোর্ডরুমে অস্ত্রধারী

অর্থপাচার, ঋণ অনিয়ম, অতিরিক্ত ব্যয় ও নিয়োগ সংক্রান্ত অনিয়মের অভিযোগে প্রায়ই খবরের শিরোনাম হয় নন-রেসিডেন্ট বাংলাদেশি কমার্শিয়াল (এনআরবিসি) ব্যাংক। ৭০০ কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারির অভিযোগে ২০১৭ সালে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়া ও তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেওয়ান মুজিবুর রহমানকে অপসারণে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংককে।

তৎকালীন চেয়ারম্যান ফরাসত আলীকে বোর্ড থেকে পদত্যাগ করতে হয়। মুজিব ও ফরাসতকে পরিচালক পদ থেকে দুই বছরের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক নিষিদ্ধ করে এবং পরবর্তীকালে বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়।

কিন্তু নতুন পর্ষদে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেয়েছেন এমন একজন, যার বিরুদ্ধে আগেই অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল এবং ব্যাংকটিতে এখনো অনিয়ম অব্যাহত আছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

ব্যাংকটির সভার কার্যবিবরণী এবং অভ্যন্তরীণ তদন্ত প্রতিবেদন, ব্যাংক স্টেটমেন্ট, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন ও সুপ্রিম কোর্টের নথির শত শত পৃষ্ঠা গত ছয় মাস ধরে বিশ্লেষণ করে দ্য ডেইলি স্টার ব্যাংকটির অভ্যন্তরীণ অসংখ্য অনিয়ম, এমনকি অস্ত্র দিয়ে ভীতি সৃষ্টির করার মতো ঘটনার বিষয়েও জানতে পেরেছে।

চার পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রথম পর্বে ঋণ কেলেঙ্কারি ও বোর্ডরুমে বন্দুক নিয়ে প্রবেশ করার ঘটনা তুলে ধরা হলো।

 

এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ৪০তম সভা হয় ২০১৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি। সভায় ব্যাংকটির বর্তমান চেয়ারম্যান পারভেজ তমাল ও পরিচালক আদনান ইমামের সঙ্গে প্রবেশ করেন এক ব্যক্তি, যার হাতে ছিল একটি সাব-মেশিনগান। তমাল ও আদনান তখন ছিলেন পরিচালনা পর্ষদের সদস্য।

নথি থেকে জানা গেছে, পরিচালনা পর্ষদের আরেক সদস্য আবু বকর চৌধুরী চলে যেতে বলার আগ পর্যন্ত ওই কক্ষেই অবস্থান করছিলেন সেই বন্দুকধারী।

এর আগে ২০১৫ সালের ২০ ডিসেম্বর পরিচালনা পর্ষদের ৩৯তম সভায় পারভেজ ও অল্টারনেটিভ ডিরেক্টর আবু মোহাম্মদ সাইদুর রহমান তৎকালীন বোর্ড চেয়ারম্যান ফরাসত আলীকে লাঞ্ছিত করেন বলে অভিযোগ ওঠে।

ওই সময় পরিচালনা পর্ষদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে ব্যাংক থেকে ৬৪ কোটি টাকা পাচার ও ১৬৫ কোটি টাকা পাচারচেষ্টার অভিযোগের অভ্যন্তরীণ তদন্ত চলছিল বোর্ডে।

অভিযোগটি উঠেছিল তিনজন পরিচালক—পারভেজ, আদনান ও রফিকুল ইসলাম মিয়া আরজুর বিরুদ্ধে। তাদের মধ্যে রফিকুল ব্যাংকটির বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান। এই অভিযোগ আছে আরও একজন স্পন্সর শেয়ারহোল্ডার এএম তুষার ইকবাল রহমানের বিরুদ্ধেও। ওই সময় বোর্ডে ১৮ জন সদস্য ছিলেন।

পরিচালনা পর্ষদের অল্টারনেটিভ ডিরেক্টর সাইদুর রহমান ও একেএম মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধেও বোর্ডে তদন্ত চলছিল। সাইদুর রহমানের ছেলে হলেন এএম তুষার ইকবাল রহমান।

তাদের মধ্যে পাঁচজন বর্তমানে ব্যাংকটির বোর্ড সদস্য।

গত ছয় মাসে দ্য ডেইলি স্টার ব্যাংকটির সভার কার্যবিবরণী ও অভ্যন্তরীণ তদন্ত প্রতিবেদনের পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্টের নথিও দেখেছে। এগুলোতে দেখা গেছে কীভাবে এই ছয়জন নিজেদের বা তাদের বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ আছে—এমন প্রতিষ্ঠানের নামে বেনামি ঋণ নিতে জোট বেঁধেছে।

পারভেজ ও আদনানসহ ছয়জনই তাদের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং দাবি করেছেন যে, ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে তাদের ফাঁসানোর চেষ্টা করা হয়েছে।

পারভেজ তমাল বোর্ডরুমে ঢোকার সময় তার সঙ্গে ছিলেন অস্ত্রধারী দেহরক্ষী। ছবি: সংগৃহীত, সিসিটিভি ফুটেজ থেকে
 

আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ নিয়ে ব্যাংকের তদন্তে অসন্তুষ্ট হয়েই পারভেজ ও আদনান 'বোর্ড কর্মকর্তাদের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করতে' সাবমেশিন গান নিয়ে আসেন। বোর্ড সভায় বন্দুক আনার এই ঘটনার দুই বছরের মধ্যে ২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর সর্বসম্মতভাবে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন পারভেজ তমাল। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত তিনি এই পদে আছেন।

বোর্ডরুমে বন্দুক আনার কারণ

২০১৬ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত পরিচালনা পর্ষদের ৪৮তম সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়, আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ নিয়ে ব্যাংকের তদন্তে অসন্তুষ্ট হয়েই পারভেজ ও আদনান 'বোর্ড কর্মকর্তাদের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করতে' সাবমেশিন গান নিয়ে আসেন।

এতে আরও বলা হয়েছে, সহিংসতা সৃষ্টি ও অস্ত্র প্রদর্শনের উদ্দেশ্য ছিল অভিযুক্ত পরিচালক ও তাদের সহযোগীদের বেনামি ঋণ ও বেনামি চুক্তিসহ অন্যান্য অপকর্ম আড়াল করার জন্য বোর্ডের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা।

পারভেজ তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং বন্দুকধারী ব্যক্তিকে বোর্ডরুমে নেওয়ার স্বপক্ষে দাবি করেছেন যে তিনি তার লাইসেন্সপ্রাপ্ত দেহরক্ষী।

বোর্ড সভায় বন্দুক আনার এই ঘটনার দুই বছরের মধ্যে ২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর সর্বসম্মতভাবে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন পারভেজ তমাল। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত তিনি এই পদে আছেন। একইসঙ্গে পরিচালনা পর্ষদ ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে রফিকুল ও নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে আদনানকে মনোনয়ন দেয়।

৫৬তম বোর্ড সভার কার্যবিবরণী অনুসারে, তাদের বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন সেই বছরই বাতিল করা হয়েছিল।

এনআরবিসি ব্যাংক ও রাশিয়ার করপোরেট রেজিস্ট্রি ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, বরিশালের বাসিন্দা পারভেজ প্রবাসী ছিলেন এবং রাশিয়ায় 'আইটি ডিস্ট্রিবিউশন, রিয়েল এস্টেট হোল্ডিং ও লজিস্টিক কনসালটেশন' সংশ্লিষ্ট ব্যবসায় জড়িত ছিলেন।

ডেইলি স্টারের হাতে আসা নথিপত্রে দেখা যায়, বোর্ড চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে পারভেজের বিরুদ্ধে বেনামি ঋণ, অবৈধভাবে মুনাফা অর্জন, ব্যাংকিং নীতি লঙ্ঘন ও আর্থিক তছরুপের আরও অভিযোগ উঠেছে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যে কোম্পানিকে পারভেজ বেনামি ঋণ নেওয়ার জন্য ব্যবহার করতেন বলে বোর্ড তদন্ত করেছিল, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সেই ল্যানটা সার্ভিসেসকে কোটি কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়।

২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা স্পন্সর পরিচালক পারভেজ। ২০১৬ সালে এনআরবিসি ব্যাংকের স্পন্সর পরিচালকদের মূলধন ছিল ৫২০ কোটি টাকা।

এর মধ্যে পারভেজের ২০ কোটি, তুষারের ২০ কোটি, ফিরোজের ২০ কোটি, রফিকুলের ২০ কোটি ও আদনানের ১০ কোটি টাকার শেয়ার মূলধন রয়েছে বলে ব্যাংকের নথি সূত্রে জানা গেছে।

পরিচালনা পর্ষদের ৪৮তম সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, পূবালী কনস্ট্রাকশন, এনইএস ট্রেডিং, ভলান্টারি অর্গানাইজেশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট (ভিওএসডি) নামে একটি এনজিও, ল্যানটা সার্ভিসেস ও অর্নিতা অ্যাগ্রোর নামে ৬৪ কোটি টাকা বেনামি ঋণ নিয়েছেন পারভেজ, আদনান, রফিকুল, তুষার ও ফিরোজ। এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পরিচালকদের সংশ্লিষ্টতার তথ্য প্রকাশ না করেই এ ঋণ নেওয়া হয়েছে।

কে কত নিল

২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংক একটি কমিটি গঠন করে এবং পাঁচজন পরিচালকসহ আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে ওঠা অর্থপাচারসহ বেশ কয়েকটি অভিযোগের তদন্ত শুরু করে।

পরিচালনা পর্ষদের ৪৮তম সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, পূবালী কনস্ট্রাকশন, এনইএস ট্রেডিং, ভলান্টারি অর্গানাইজেশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট (ভিওএসডি) নামে একটি এনজিও, ল্যানটা সার্ভিসেস ও অর্নিতা অ্যাগ্রোর নামে ৬৪ কোটি টাকা বেনামি ঋণ নিয়েছেন পারভেজ, আদনান, রফিকুল, তুষার ও ফিরোজ। এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পরিচালকদের সংশ্লিষ্টতার তথ্য প্রকাশ না করেই এ ঋণ নেওয়া হয়েছে।

ব্যাংকিং পরিভাষায় এগুলোকে 'সম্পর্কিত পক্ষের ঋণ' বলা হয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, এই ধরনের ঋণের ক্ষেত্রে ঋণদাতা ব্যাংকের পরিচালকদের অবশ্যই ঋণগ্রহীতা কোম্পানির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ঘোষণা করতে হবে।

এই ৬৪ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে আদনান একাই এনইএস ট্রেডিং (১৯ কোটি) ও পূবালী কনস্ট্রাকশনের (নয় কোটি) নামে ২৮ কোটি টাকার দুটি 'বেনামি ঋণ' নিয়েছেন। ৪৬ ও ৪৮তম বোর্ড সভার কার্যবিবরণীতে দেখা যায়, মোস্তাফিজুর, তুষার ও ফিরোজের সঙ্গে মিলে অর্নিতা অ্যাগ্রোর নামে আরও তিন কোটি টাকা ঋণ নেন তিনি।

ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ তদন্তে দেখা গেছে, অর্নিতা অ্যাগ্রো আদনান ও মোস্তাফিজুরের মালিকানাধীন এবং ঋণের তিন কোটি টাকা দুদিনের মধ্যে আইপিই ক্যাপিটালের ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়।

জয়েন্ট স্টক কোম্পানির নথিতে দেখা যায়, আইপিই ক্যাপিটাল আদনান ইমামের পারিবারিক ব্যবসা এবং তিনি সেই প্রতিষ্ঠানের একজন পরিচালক।

এনআরবিসি ব্যাংকের ওয়েবসাইটে আদনানকে যুক্তরাজ্যের নাগরিক এবং বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (সিআইপি) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যার লন্ডন ও ঢাকায় রিয়েল এস্টেট ও প্রাইভেট ইক্যুইটিসহ বিভিন্ন ব্যবসা রয়েছে।

ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এনইএস ট্রেডিং আদনান এবং তার ব্যবসায়িক অংশীদার ও শ্যালকের মালিকানাধীন, যিনি লন্ডনে বাস করেন।

তদন্ত কমিটির সামনে আদনানের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, পূবালী কনস্ট্রাকশনের মালিক তারই এক কর্মচারী এবং পূবালী কনস্ট্রাকশনের জন্য নয় কোটি টাকা ঋণ আদনানের শ্বশুরের জমির বিপরীতে নেওয়া হয়।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, পারভেজও পূবালী কনস্ট্রাকশনের সঙ্গে যুক্ত। তদন্ত শুরুর আগে তিনি পূবালী কনস্ট্রাকশনের অ্যাকাউন্টে দুই কিস্তিতে অন্তত ৮৭ লাখ টাকা স্থানান্তর করেন।

২০১৬ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর ফজলে কবির তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে লেখা এক চিঠিতে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গোপন তদন্তে দেখা গেছে, আদনান অর্নিতা অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজের নাম ব্যবহার করে তিন কোটি টাকার 'বেনামি' ঋণ নিয়েছেন।

ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের ৪৪-৪৮তম সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়, বোর্ড সদস্যরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করেছেন যে, অডিট কমিটির চেয়ারম্যান হয়েও রফিকুল আমানতকারীদের অর্থ আত্মসাৎ করা থেকে আদনানকে বিরত রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন।

পরিচালনা পর্ষদের ৪৪তম সভায় বোর্ড সদস্যরা বলেছিলেন, আদনান তার প্রতিষ্ঠান আদ্রিতা ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে এনআরবিসি ব্যাংকের বনানী শাখার অভ্যন্তরীণ কাজের জন্য প্রকৃত ব্যয় ৫৬ লাখ টাকার বিপরীতে এক কোটি টাকার বিল জমা দিয়েছেন, যেখানে তার জালিয়াতির বিষয়টি স্পষ্ট।

৩০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া এনজিও ভিএসডিওর প্রতিষ্ঠাতা ব্যাংকটির বর্তমান পরিচালক মোস্তাফিজুর।

একাধিক বোর্ড সভার কার্যবিবরণী অনুযায়ী, বর্তমান চেয়ারম্যান পারভেজ ল্যানটা সার্ভিসেসের নামে তিন কোটি টাকা বেনামি ঋণ নিয়েছেন।

যেদিন ল্যানটাকে তিন কোটি টাকা ঋণ সুবিধা দেওয়া হয়, সেদিনই পারভেজ তার নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে লিয়েন হিসেবে এফডিআর আকারে এক কোটি টাকা ল্যানটার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করেন।

ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ল্যানটা সার্ভিসেসের অনুকূলে ঋণ বিতরণের সুবিধার্থে পারভেজ ওই অর্থ জমা রেখেছিলেন।

বোর্ডরুম থেকে কোর্টরুম

এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের এপ্রিলে পারভেজ, আদনান ও রফিকুলকে বোর্ড থেকে সরিয়ে দেওয়া হলে তারা তিনজন বিষয়টি নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হন।

বিচারপতি মো. রেজাউল হাসানের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই তিনজনকে পদে পুনর্বহাল করলেও তাদের শেয়ার সাময়িকভাবে জব্দ করে ব্যাংকে সংযুক্ত করেন। একইসঙ্গে যেসব বোর্ড মিটিংয়ে তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্ত বিষয়ে আলোচনা হবে, তাদের সেসব সভার বাইরে রাখার নির্দেশও দেন আদালত।

ব্যাংকিং আইন অনুযায়ী ওই তিনজনকে অব্যাহতি দেওয়ার এখতিয়ার বোর্ডের নেই—এর ওপর ভিত্তি করেই তাদের পদে পুনবর্হাল রাখার সিদ্ধান্ত দেন আদালত। 'তবে তার মানে এই নয় যে, ব্যাংক বা পরিচালনা পর্ষদ আইন অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারবে না।'

আদালত রায়ে বলেন, আবেদনকারীরা (অভিযুক্ত পরিচালকরা) ফাঁকফোকরের মাধ্যমে বেনামি ঋণ নেওয়ার পথ তৈরি করেছেন।

রায় অনুযায়ী, বোর্ডের তদন্ত রিপোর্টে পূবালী কনস্ট্রাকশন ও এনইএস ট্রেডিংয়ের ঋণের সঙ্গে আদনান ইমামের যোগসাজশ এবং এসব প্রতিষ্ঠানে তার সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

বেঞ্চ আরও বলেন, ল্যানটার সঙ্গে পারভেজ ও রফিকুলের যোগসূত্রের প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেছে এবং পূবালী কনস্ট্রাকশন ও এনইএস ট্রেডিংয়ের সঙ্গে পারভেজের সংশ্লিষ্টতার দৃশ্যমান যোগসূত্র রয়েছে এবং এর মাধ্যমে প্রমাণ পাওয়া যায় যে আবেদনকারী ওই ব্যাংক থেকে বেনামি ঋণ নিয়েছেন এবং ওই দুই সংস্থার পেছনে থাকা ব্যক্তি তিনি।

মাত্র দুই মাসের মধ্যে ল্যানটার ঋণসীমা দুই কোটি টাকা বাড়িয়ে সাড়ে ছয় কোটি টাকা করা হয়। ২০২০ সালের ১৮ এপ্রিল ঋণসীমা আরও বাড়িয়ে সাড়ে নয় কোটি টাকা করা হয়। পরবর্তী আরও তিনটি সভা শেষে আরও ৫০ লাখ টাকা 'প্রণোদনা ঋণ' পায় ল্যানটা। ২০২১ সালে ল্যানটার সাড়ে নয় কোটি টাকার ঋণসীমা নবায়ন করা হয়। নথিপত্রে দেখা যায়, মাত্র দুই বছরে প্রতিষ্ঠানটিকে গাড়ির জন্য চার কোটি ২৮ লাখ টাকার তিনটি ঋণ দেওয়া হয়েছে।

ল্যানটা সার্ভিসেসের জন্য ভালোবাসা

ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের এসব অনুসন্ধান ও আপিল বিভাগের রায়ের তিন বছর পর ল্যানটা সার্ভিসেসকে এনআরবিসি ব্যাংক অন্তত ১৪ কোটি টাকা ঋণ দেয় বলে একাধিক সভার কার্যবিবরণী থেকে জানা গেছে।

২০১৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি পারভেজের নেতৃত্বাধীন পরিচালনা পর্ষদের সভায় ল্যানটাকে সাড়ে চার কোটি টাকার সমন্বিত ঋণ সুবিধা দেওয়া হয়।

সভার কার্যবিবরণীতে দেখা যায়, পারভেজের বিরুদ্ধে ল্যানটার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তদন্ত ও বেনামী ঋণ নেওয়ার জন্য তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হাইকোর্ট ব্যাংককে যে নির্দেশ দিয়েছে, সেসব নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি।

মাত্র দুই মাসের মধ্যে ল্যানটার ঋণসীমা দুই কোটি টাকা বাড়িয়ে সাড়ে ছয় কোটি টাকা করা হয়। ২০২০ সালের ১৮ এপ্রিল ঋণসীমা আরও বাড়িয়ে সাড়ে নয় কোটি টাকা করা হয়। পরবর্তী আরও তিনটি সভা শেষে আরও ৫০ লাখ টাকা 'প্রণোদনা ঋণ' পায় ল্যানটা। ২০২১ সালে ল্যানটার সাড়ে নয় কোটি টাকার ঋণসীমা নবায়ন করা হয়।

নথিপত্রে দেখা যায়, মাত্র দুই বছরে প্রতিষ্ঠানটিকে গাড়ির জন্য চার কোটি ২৮ লাখ টাকার তিনটি ঋণ দেওয়া হয়েছে।

পারভেজ পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হওয়ার পর ল্যানটা সার্ভিসেসের সাবসিডিয়ারি কোম্পানি ল্যানটা ফরচুনা প্রপার্টিজ ২০১৯ সালের জুনে ৮৭ লাখ টাকার চুক্তিসহ একাধিকবার ব্যাংকের ইন্টেরিয়র ডিজাইনের কাজ পায়।

উভয় প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফয়সাল বিন আলম ব্যাংকটির একজন গ্রাহক।

প্রভিডেন্ট ফান্ড চুরি

এই দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এনআরবিসি ব্যাংকের জুনিয়র টেলার ও অ্যাসিস্ট্যান্ট টেলারদের প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকেও অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।

এনআরবিসি ব্যাংক চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের নিয়োগ প্রক্রিয়া নিজেরা সম্পন্ন করে না। এনআরবিসি ম্যানেজমেন্ট নামে ভিন্ন একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিয়োগের কাজটি করা হয়।

নথিপত্রে দেখা যায়, ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এনআরবিসি ম্যানেজমেন্টের মালিকানায় অন্যান্যদের মধ্যে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত পারভেজ, আদনান, রফিকুল ও মোস্তাফিজুরও ছিলেন।

এনআরবিসি ম্যানেজমেন্টের প্রভিডেন্ট ফান্ড, ল্যানটা সার্ভিসেস ও এনআরবিসি ম্যানেজমেন্টের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বিবরণীতে দেখা যায় যে কীভাবে ল্যানটা সার্ভিসেস বিভিন্ন সময়ে প্রভিডেন্ট ফান্ডের ব্যাংক অ্যাকাউন্টটিকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছে।

ওই অর্থ ব্যাংকের কনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে এনআরবিসি ম্যানেজমেন্টের অ্যাকাউন্টে এবং পরে ল্যানটা সার্ভিসেসে যায়। মূলত এই অর্থ কোথায় যাচ্ছে, সেটি আড়াল করতেই এনআরবিসি ম্যানেজমেন্টের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে তা স্থানান্তর করা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে।

উদাহরণস্বরূপ, ২০২১ সালের ২৬ এপ্রিল প্রভিডেন্ট ফান্ডের হিসাব থেকে এনআরবিসি ম্যানেজমেন্টের অ্যাকাউন্টে এক কোটি টাকা স্থানান্তর করা হয়। একই দিন প্রভিডেন্ট ফান্ডের অ্যাকাউন্ট থেকে ৬০ লাখ টাকা ল্যানটা সার্ভিসেসে স্থানান্তর করা হয়।

প্রায় দেড় বছর পর ২০২২ সালের অক্টোবরে প্রভিডেন্ট ফান্ড অ্যাকাউন্টে এক কোটি টাকা ফেরত দেয় এনআরবিসি ম্যানেজমেন্ট।

কিন্তু ডেইলি স্টারের হাতে থাকা এনআরবিসি ম্যানেজমেন্টের কয়েকশ পৃষ্ঠার লেনদেন বিবরণীর কোথাও দেখা যায়নি যে ওই ৬০ লাখ টাকা ফেরত দিয়েছে ল্যানটা সার্ভিসেস।

এটা হতেই পারে যে ব্যক্তিগতভাবে আমার পরিচিত কারোর এখানে একটি অ্যাকাউন্ট আছে। ওভারড্রাফট সুবিধা দেওয়ার সময় আমি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলাম না। তাই কে ঋণ পেয়েছে, সে বিষয়ে আমার কোনো হস্তক্ষেপ ছিল না। আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো মিথ্যা, বানোয়াট এবং ব্যক্তিগতভাবে আমার মানহানি ও কর্তৃপক্ষকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে এসব অভিযোগ তোলা হয়েছে।

পারভেজ তমাল, চেয়ারম্যান, এনআরবিসি ব্যাংক

অস্বীকার

পারভেজ সব অস্বীকার করে দাবি করেছেন, দ্য ডেইলি স্টারের হাতে থাকা নথিগুলো ভুয়া অথবা বানোয়াট।

মতিঝিলের অফিসে দেওয়া সাক্ষাত্কারে পারভেজ বন্দুকধারীকে বোর্ডরুমের ভেতরে নেওয়ার পক্ষে যুক্তি হিসেবে বলেছেন, আগ্নেয়াস্ত্রটি তার লাইসেন্সকৃত এবং প্রকৃতপক্ষে এই ঘটনাটিকে বড় করে দেখানো হচ্ছে।

তিনি বলেন, 'সে (বন্দুকধারী) আমাকে স্বাভাবিকভাবেই বোর্ডরুমে নিয়ে যায়... আমি বোর্ডের হুমকিতে ছিলাম, এমনকি আমি লিখিত আবেদন করে র‌্যাবের কাছেও নিরাপত্তা  চেয়েছিলাম।'

তবে, বিচারকার্যক্রম চলাকালীন হাইকোর্ট বন্দুকের বিষয়টির জন্য পারভেজকে তিরস্কার করে বলেন, 'কারো ব্যক্তিগত বন্দুকধারী বা দেহরক্ষীকে ব্যাংকের ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া উচিত নয়।'

ল্যানটা সার্ভিসেসকে ঋণ সুবিধা দেওয়ার বিষয়টিও অস্বীকার করেছেন পারভেজ।

তিনি বলেন, 'এটা হতেই পারে যে ব্যক্তিগতভাবে আমার পরিচিত কারোর এখানে একটি অ্যাকাউন্ট আছে। ওভারড্রাফট সুবিধা দেওয়ার সময় আমি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলাম না। তাই কে ঋণ পেয়েছে, সে বিষয়ে আমার কোনো হস্তক্ষেপ ছিল না।'

পূবালী কনস্ট্রাকশন, অর্নিটা অ্যাগ্রো বা এনইএস ট্রেডিংয়ের সঙ্গে কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন আদনান ইমাম।

তিনি বলেন, 'অভিযোগগুলো মিথ্যা, বানোয়াট এবং ব্যক্তিগতভাবে আমার মানহানি ও কর্তৃপক্ষকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে এসব অভিযোগ তোলা হয়েছে।'

পারভেজ ও তমাল উভয়েই বলেছেন, মিথ্যা নথির ওপর ভিত্তি করে হাইকোর্টের রায়টি দেওয়া হয়েছিল।

আদনান বলেন, 'হাইকোর্টের রায়ে আমাকে ও ব্যাংকের অন্যান্য বর্তমান পরিচালকদের ফাঁসানোর জন্য তৎকালীন চেয়ারম্যান ও তার সহযোগীদের তৈরি করা প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। রায়ের রেফারেন্সটি অনুসন্ধান বা পর্যবেক্ষণমূলক ছিল না, বরং এটিতে তথাকথিত তদন্ত প্রতিবেদনের সরাসরি উল্লেখ ছিল। সহজ কথায়, সাবেক চেয়ারম্যানের করা মিথ্যা প্রতিবেদন থেকে বিচারক শুধু আমার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো পড়ে শোনান। এটা বিচারকের কোনো মতামত নয়।'

তবে হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, তারা এনআরবিসি ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনের সঙ্গে একমত। কারণ কমিটির তদন্ত প্রক্রিয়ায় 'কোনো পেটেন্ট বা সুপ্ত অনিয়ম বা অবৈধতা বা গ্রহণযোগ্যতা অভাব সংশ্লিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি'।

হাইকোর্টের রায়ের বিষয়টি উল্লেখ করা হলে পারভেজ বলেন, 'আপিল বিভাগ রায়টি বাতিল করেছে…। এটি একটি আইনগত বিষয় এবং যিনি দায়িত্বে আছেন, তিনি তার পছন্দ অনুযায়ী তথ্য সরবরাহ করতে পারেন।'

কিন্তু আপিল বিভাগ হাইকোর্ট বিভাগের পুরো রায় বাতিল করেননি। আপিল বিভাগ কেবল রায়ের যে অংশটি পারভেজ ও অন্যান্যদের শেয়ার সাময়িক জব্দ করেছিল, সেটুকু বাতিল করেছে।

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, তার প্রতিষ্ঠিত ভিওএসডি এনজিও একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের বিধি মোতাবেক সেই প্রতিষ্ঠানটির জন্য ঋণ নেওয়া হয়েছে।.

বাংলাদেশ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, এগুলো 'সম্পর্কিত পক্ষে'র ঋণ।

তিনি বলেন, 'যখন এই ধরনের ঋণ মঞ্জুর করা হয় তখন তাদের উচিত ছিল ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক ঘোষণা করা।'

মন্তব্য জানার জন্য তুষার ইকবালকে কল ও মেসেজ করা হলেও তিনি এর জবাব দেননি।

সাইদুর রহমান সাবেক বোর্ড চেয়ারম্যানকে লাঞ্ছিত করার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

তিনি বলেন, 'তারা এমন একটি কোম্পানির জন্য ঋণ মঞ্জুর করার জন্য চাপ দিচ্ছিল, যাদের ওই ঋণ নেওয়ার যথাযথ সক্ষমতা ছিল না। পারভেজ ও আমি দুজনেই আমাদের প্রিমিয়াম কীভাবে ব্যয় করা হয়েছিল তার জবাবদিহি চাইলে চেয়ারম্যান সভা স্থগিত করেন।'

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, এনআরবিসি নিয়ে একাধিক তদন্ত হয়েছে এবং প্রয়োজনে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, 'চেয়ারম্যানের (পারভেজ) বন্দুকধারী কাউকে নিয়ে বোর্ডরুমে যাওয়ার বিষয়ে আমরা কোনো অভিযোগ শুনিনি। আমাদের কাছে প্রমাণ থাকলে অভিযোগটি যাচাই-বাছাই করতে পারতাম।'

Comments