ঈদের আগের রাতে ঝরলো বিজয়নগরের ১২ প্রাণ
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার ১১ জন বাসিন্দা ঈদের আগের রাতে পৃথক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন, তাদের মধ্যে পাঁচজনই প্রবাসী। অপর একজনকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়েছে।
এ ছাড়া, ঈদের আগের দিন সকালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত এক যুবক নিহত ঈদের দিন সকালে মারা গেছেন। তিনি ছিলেন সৌদি আরব প্রবাসী। ঈদের তিনদিন পর তার সৌরি আরব ফিরে যাওয়ার কথা ছিল।
সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে চারজন মালয়েশিয়ার একটি এক্সপ্রেসওয়েতে, ছয়জন ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে এবং দুজন বিজয়নগরের গ্রামীণ সড়কে দুর্ঘটনায় মারা যান।
পৃথক এসব ঘটনার সংবাদে বিজয়নগরে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। ঈদের আগের রাতে প্রিয়জন হারানো পরিবারগুলোর ঈদ আনন্দ বিষাদে পরিণত হওয়ার পাশাপাশি তাদের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম।
ঈদের দিনে প্রত্যেক বাড়িতে যখন উৎসবের আমেজ ছিল তখন কোনো আনন্দ আয়োজনের বালাই ছিল না মালয়েশিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত আব্দুল্লাহ, আরিফুল, সোহেল ও আসকর আলীদের বাড়িতে।
শোকে-বিষাদে এই চার প্রবাসীর স্মৃতি আঁকড়ে কাঁদছেন বাবা-মাসহ পরিবারের সদস্যরা।
তাদের বাড়ি বিজয়নগর উপজেলার হরষপুর ইউনিয়নের এক্তারপুর গ্রামে।
আজ শুক্রবার দুপুরে এক্তারপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, নিহত চারজনের পরিবারেই এবার নিরানন্দের ঈদ। দুই সন্তান আব্দুল্লাহ ও আরিফুলকে হারানোর শোকে পাথর হয়ে গেছেন তাদের বৃদ্ধা মা আলেয়া খাতুন। সদ্য বিবাহিত আব্দুল্লাহর স্ত্রী তানিয়া আক্তারের কথা বলার শক্তিটুকুও যেন নেই।
উপার্জনক্ষম দুই ছেলেকে হারিয়ে নির্বাক আব্দুল্লাহ ও আরিফুলের বাবা আব্দুল করিম কান্নাজড়িত কণ্ঠে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার তিন ছেলেই মালয়েশিয়াতে থাকে। মেঝ ছেলে হেলাল বাদে বাকি দুই ছেলের একসঙ্গে মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না।'
তিনি জানান, তিন ছেলেকে মালয়েশিয়াতে পাঠাতে তার ছয় লাখ টাকা ঋণ করতে হয়েছে৷ এখন দুই সন্তানের মরদেহ নিজ খরচে দেশে আনার সামর্থ্য তার নেই। রাষ্ট্রীয় খরচে দ্রুত তাদের মরদেহ দেশে আনার দাবি জানান তিনি।
ওই বাড়িতেই কথা হয় নিহত আব্দুল্লাহর শ্বশুর ও একই এলাকার জালালপুর গ্রামের মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, 'একমাত্র মেয়ে তানিয়াকে মাত্র আট মাস আগে বিয়ে দিয়েছি। তার কোনো সন্তানও হয়নি। এখন আমার মেয়েটার সব শেষ হয়ে গেল।'
বুধবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে নরসিংদী সদর উপজেলার মাধবদী টাটাপাড়া এলাকায় পিকআপ ভ্যান ও মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে নারী ও শিশুসহ যে ছয়জন নিহত হয়েছেন, তাদের সবার বাড়ি বিজয়নগরে।
তাদের মধ্যে হরষপুর ইউনিয়নের পাইকপাড়া গ্রামের একই বাড়ির চারজন ও পার্শ্ববর্তী চান্দুরা ইউনিয়নের জালালপুর গ্রামের দুজন।
নিহতরা হলেন—পাইকপাড়া গ্রামের আব্দুল মুমিনের ছেলে মজিবুর রহমান (২৭), তার ভাগ্নে আবু হোরায়রাহ (৯), ভাগ্নি মীম আক্তার (২০), তার চাচা জসিম উদ্দিন (৩০) এবং প্রতিবেশী গ্রাম জালালপুরের হেলাল ও বাবুল।
নিহতের পরিবারের সদস্যদের বরাত দিয়ে হরষপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সারওয়ার রহমান ভূঞা জানান, ঈদে বাড়ি ফিরতে ঢাকা থেকে একটি মাইক্রোবাসে করে বিজয়নগরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছিলেন নারী ও শিশুসহ মোট ১৩ জন যাত্রী। যাত্রাপথে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি পিকআপ ভ্যানের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হলে মাইক্রোবাসটি দুমড়ে-মুচড়ে গিয়ে ঘটনাস্থলেই এক শিশু মারা যায়।
স্থানীয়রা গুরুতর আহত অবস্থায় ১৩ জনকে উদ্ধার করে নরসিংদী জেলা সদর হাসপাতালে পাঠান। হাসপাতালে নেওয়ার পথে এক নারীসহ আরও তিনজনের মৃত্যু হয়। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আরও দুজন মারা যান।
সারওয়ার জানান, মাইক্রোবাসটিতে থাকা সবাই রাজধানীর উত্তরা ও খিলক্ষেত এলাকায় পর্দার ব্যবসা করতেন। সবার গন্তব্য একই এলাকায় হওয়ার সুবাদে একসঙ্গে তারা ঈদ উদযাপন করতে বাড়ি ফিরছিলেন।
বুধবার রাত ৮টার দিকে একই উপজেলার ইছাপুরা ইউনিয়নের ধীতপুর গ্রামে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে সাইফুল ইসলাম (১৮) নামে এক যুবককে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। নিহত যুবক চম্পকনগর ইউনিয়নের সাটিরপাড়া গ্রামের কাশেম মিয়ার ছেলে।
বিজয়নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আসাদুল ইসলাম জানান, ধীতপুর গ্রামের জিল্লু মেম্বারের ছেলের সঙ্গে সাইফুলের মোবাইল ফোনে বাদানুবাদ হয়। প্রতিশোধ নিতে জিল্লু মেম্বারের ছেলে ও তার এক বন্ধু মিলে সাইফুলকে সাটিরপাড়া গ্রাম থেকে ডেকে ধীতপুর গ্রামে তাদের বাড়ির পুকুর পাড়ে নিয়ে যায়৷ সেখানে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে সাইফুলের বুকে ও পিঠে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করা হয়। পরে তাকে পার্শ্ববর্তী হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে চারজনকে আটক করেছে পুলিশ।
বুধবার সকাল ১১টার দিকে বিজয়নগরের পাহাড়পুর ইউনিয়নের গোয়ালনগর গ্রামে বাড়ির পাশের গ্রামীণ সড়কে সিএনজিচালিত অটোরিকশার চাপায় স্থানীয় কাজী আব্দুল মান্নান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির শিশু শিক্ষার্থী রোহান (৮) নিহত হন।
ঈদের দিন সকালে সবাই যখন ঈদগাহ মাঠে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখনই সৌদি আরব প্রবাসী শফিকুল ইসলামের (২৫) মৃত্যুর খবর আসে পরিবারের কাছে।
বুধবার দুপুরে নিজের মোটরসাইকেল নিয়ে বিজয়নগরের আউলিয়াবাজার থেকে ভিটিদাউদপুর গ্রামের নিজ বাড়িতে ফেরার পথে গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে গুরুতর আহত হন শফিকুল।
তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার সকাল পৌনে ৮টার দিকে মারা যান তিনি।
Comments