গাজী টায়ারসে অগ্নিকাণ্ড

বছর পেরিয়ে গেলেও নিখোঁজদের খোঁজ পাননি স্বজনরা

গত বছর গাজী টায়ারসে অগ্নিকাণ্ডে নিখোঁজদের পরিবারের সদস্যরা ছবি ধরে আছেন। ছবিটি সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার বরাব এলাকা থেকে তোলা। ছবি: স্টার

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে গাজী টায়ারস কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের এক বছর পেরিয়ে গেছে। তবে এক বছর পরও অন্তত ১৮২ জনের খোঁজ পাওয়া যায়নি। নিখোঁজদের পরিবারের সদস্যরা এখনো স্বজনদের অপেক্ষায় আছেন।

তাদের একজন ৫৫ বছরের হরমুজা বেগম। গাজী টায়ারসে অগ্নিকাণ্ডে নিখোঁজ হন তার ২২ বছর বয়সী ছেলে আব্দুর রহমান। তিনি ছিলেন তাঁত শ্রমিক।

হরমুজা বেগম বলেন, 'বন্ধু-বান্ধবের লগেই সে গেছিলো। ডিউটি শেষ করে বাইত আইবো মনে করছিলাম। কিন্তু বোঝো না শয়তান টানলো, আর ফেরে নাই। বন্ধু-বান্ধব ১০ থেকে ১২ জন গেছে, কেউই আর ফেরে নাই।'

তিনি বলেন, 'আমার ধারণা, আমার ছেলে আগুনে পুড়ে মারা গেছে। এ নিয়ে কারো প্রতি আমার কোনো রাগ-ক্ষোভ নেই। তবে একটাই আক্ষেপ, ছেলের লাশটাও চোখে দেখার মতো নসিব হলো না আমার।'

গত এক বছরে নিখোঁজদের পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা বারবার জেলা প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছেন। কিন্তু কোনো উত্তর মেলেনি।

গত বছরের ২৯ আগস্ট আগুন পুরোপুরি নেভানোর আগের দিন পুড়ে যাওয়া ছয় তলা কারখানা ভবনের বেসমেন্টে শেষবারের মতো তল্লাশি চালানো হয়। এরপর থেকে পুলিশ কিংবা ফায়ার সার্ভিস, কেউই আর ভবনটিতে ঢুকে কোনো অভিযান চালায়নি।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে সরকারি তদন্ত কমিটি সুপারিশ করেছিল, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটি অপসারণের মাধ্যমে উদ্ধার কাজ সম্পন্ন করা যায়। ভবনটি মালিকপক্ষকেই অপসারণ করতে হবে। তবে এখনো সে ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

যোগাযোগ করা হলে বর্তমান জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিয়া বলেন, 'তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে আমি বিস্তারিত বলতে পারব না। কিন্তু নিখোঁজদের পরিবারের সদস্যরা একাধিকবার আমাদের কাছে এসেছিলেন। আমরা পুলিশকে তাদের সন্ধান করতে বলেছি।'

তিনি আরও বলেন, 'নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনরা একটি আবেদন করেছিলেন, আমি সেটিকে মার্ক করে জেলা পুলিশকে কাজ করতে বলেছি। আশা করি, খুব দ্রুতই কোনো আপডেট দেওয়া যাবে।'

জেলা পুলিশের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার মেহেদী ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রশাসনের করা তালিকা ধরে পুলিশ নিখোঁজদের সন্ধানে কাজ করছে।'

তিনি বলেন, 'নিখোঁজদের ব্যবহৃত মুঠোফোন নম্বরের সর্বশেষ লোকেশন ও ওই নম্বরটি কোথাও সচল আছে কি না—এসব বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এজন্য কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলছেন ও ফিজিক্যালি তদন্ত করছেন।'

তবে নিখোঁজের তালিকায় থাকা কাউকে এখন পর্যন্ত শনাক্ত করা যায়নি বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।

জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের (জোন–২) উপ-সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ ওসমান গনি বলেন, 'গত বছরের ২৯ আগস্টের পর আর কোনো তল্লাশি অভিযান হয়নি। এ ব্যাপারে আমরা কোনো নির্দেশনা পাইনি।'

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গাজী টায়ারস লিমিটেডের এক শীর্ষ কর্মকর্তা মুঠোফোনে বলেন, 'কারখানার প্রহরায় এখনো আমাদের নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মীরা আছেন। ছয়তলা ভবনটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে এবং গত বছরের ২৯ আগস্ট বুয়েট বিশেষজ্ঞ দল এটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করার পর থেকে কারো প্রবেশ নেই।'

তিনি আরও বলেন, 'জেলা প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের ছাড়পত্র ছাড়া এখানে কিছুই করা সম্ভব নয়।'

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫ অগাস্ট প্রথমবার এই কারখানায় লুটপাট চালানো হয়। ওই সময়ও কারখানাটির বেশকিছু স্থাপনায় আগুন দেওয়া হয়। তখন লুটপাট চলে ৮ অগাস্ট পর্যন্ত। তারপর থেকে কারখানার ওই ভবনের বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ বন্ধ ছিল।

ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিটের টানা ২২ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। আগুন পুরোপুরি নেভে পাঁচ দিন পর। দীর্ঘ সময় ধরে জ্বলতে থাকা আগুনে ভবনটি 'ঝুঁকিপূর্ণ' হওয়ায় সেখানে উদ্ধার অভিযান চালানো যায়নি।

কিন্তু ২৫ আগস্ট সাবেক মন্ত্রী ও কারখানার মালিক গোলাম দস্তগীর গাজী গ্রেপ্তারের পর দ্বিতীয় দফায় লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ ঘটে। এতে অন্তত ১৮২ জন নিখোঁজ হন। তখন ভয়াবহ আগুনে ছয়তলা ভবনটি গ্রাস করে। টানা পাঁচ দিন ধরে আগুন জ্বলতে থাকে, অবশেষে দমকল বাহিনী তা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।

আগুন নেভানোর পর ভবনটির বেজমেন্টে প্রাথমিক একটি উদ্ধার অভিযান চালিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস। কিন্তু সেখানে হতাহত কাউকে পাওয়া যায়নি। পরে আর কোনো উদ্ধার অভিযান এ ভবনটিতে চালানো হয়নি।

এখনো উত্তর খুঁজছে নিখোঁজদের পরিবার

গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর ভোরে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে উপজেলার রূপসী মোড়ে অবস্থিত গাজী টায়ারসের মালিক আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী এবং নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের চারবারের সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজীকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওইদিন রাতে রূপগঞ্জের টায়ার প্রস্তুতকারী কারখানাটিতে লুটপাটের পর অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।

অগ্নিসংযোগের পরদিন সকাল থেকেই আশপাশের এলাকার নিখোঁজদের স্বজনরা কারখানার ফটকে জড়ো হন। প্রশাসন স্বজনদের কাছ থেকে নিখোঁজদের ছবি ও তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র রেখে নাম নিবন্ধন শুরু করে।

জেলা প্রশাসনের তালিকায় থাকা নিখোঁজ অন্তত ৪৫ জনের পরিবার ও প্রতিবেশীর সঙ্গে কথা বলেছেন এ প্রতিবেদক।

প্রতিবেশীরা জানান, গত এক বছরে নিখোঁজ ব্যক্তিদের এলাকায় দেখেননি তারা।

নিখোঁজদের একজন মো. আরিফ। ২৭ বছর বয়সী আরিফ টেক্সটাইল মিলে চাকরি করতেন। বছর ঘুরলেও দুই সন্তানের বাবার কোনো খোঁজ না পেয়ে দিশেহারা স্ত্রী ফারজানা। সাত বছরের এক ছেলে আয়ান ও ১৮ মাসের নাঈম হাসানকে নিয়ে অনিশ্চয়তায় দিন কাটছে তার।

'বাঁইচা আছে এই আশা নিয়াই এক বছরে এসপি-ডিসি সবার কাছে গেছি। কেউতো এইডাও কয় না যে, উনি মইরা গেছে। দিন যাইতাছে সবার ঠিকমতোই, কিন্তু আমাদের জীবনডা তো থাইমা আছে,' বলেন তিনি।

ঘটনার দিন ট্রাক চালিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরেন নূর হোসেন। প্রতিবেশী আরেক ট্রাকচালক অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে নিয়ে রূপসী এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে যান। সঙ্গে ছিল ৫ বছর বয়সী ছেলে আব্দুল্লাহ। রাত নয়টার দিকে ছেলেকে বাসায় দিয়ে বোনের স্বামী মো. রাসেলের (৩৪) সঙ্গে যান গাজী টায়ারস কারখানায়। তারপর দুজনের কেউই আর ফেরেননি।

ভোলার নূর হোসেন দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে রূপগঞ্জের কাজীপাড়া এলাকার দুই কক্ষের বাসায় ভাড়া থাকতেন। স্বামী নিখোঁজ হওয়ার পর ওই বাসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন নূরের স্ত্রী পারভীন বেগম। বর্তমানে একই এলাকায় এক কক্ষের একটি টিনের ঘরে তিন সন্তানকে নিয়ে থাকছেন তিনি।

তিনি বলেন, 'ননদের জামাইর লগে গেছিল গাজীর কারখানায়। রাত তিনটা পর্যন্ত তার ফোন বাজছে। মানুষটা তো আর ফিরল না। কিন্তু উনি মারা গেছেন সেই ঘোষণাও দিতেছে না। উনি কয়েকটা কিস্তি করে গেছিলেন, সেই কিস্তির টাকাও মাফ হইতেছে না ডেথ সার্টিফিকেট না থাকায়। তিনটা ছেলেমেয়েরে পড়াশোনা করানো তো আমার লাইগা কষ্ট হইয়া যাইতেছে। একটা বিধবা ভাতার কার্ড পাইলেও তো আমার কাজে লাগতো।'

নূর হোসেন ও রাসেলের সন্ধান পেতে নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালেও খোঁজ করেছেন স্বজনরা। এমনকি কারাগারেও খোঁজ নিয়েছেন। কিন্তু সন্ধান মেলেনি কোথাও। সংসার চালাতে এখন স্থানীয় একটি কারখানায় চাকরি নিয়েছেন পারভীন।

পারভীনের মা খাদিজা বেগম বলেন, 'মইরা গেলে হাড্ডিটা তো আছে। তাই দিতো আমাগো। কিন্তু একটা বছর হইয়া গেলো, কিছুই তো করলো না সরকার।'

ওইদিন নিখোঁজ হন উপজেলার মৈকূলী এলাকার দুই ভাই ইলেকট্রিক মিস্ত্রি সাব্বির শিকদার (২৬) ও শাহাদাত শিকদার (৩০) এবং তাদের বোনের স্বামী জামির আলী (৩৬)।

সাব্বির ও শাহাদাতের মা নুরুন্নাহার বলেন, 'যার কাছে যাই সেই কয় খালি ধৈর্য ধরতে। একটা বছর ধৈর্যই তো ধরছি। এখন আমি শ্যাষ। মার কইলজাডা কেমন করে সেইটা তোমরা বুঝবা না।'

একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে দিশেহারা নিখোঁজ ব্যাটারি কারখানার শ্রমিক মো. আমান উল্লাহর (২১) মা রাশিদা বেগম। তিনি বলেন, 'আমার স্বামী ১০ বছর ধইরা স্ট্রোক কইরা বাসায় বইসা আছে। ছেলেটাই সংসার চালাইতো। ও নিখোঁজ হওয়ার পর আগের বাসা ছাইড়া দিছি। নতুন যে বাসায় ভাড়া থাকি তারও তিনমাসের ভাড়া জইমা গেছে।'

সরকারি তদন্ত

গত বছরের ২৭ অগাস্ট তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হামিদুর রহমানকে প্রধান করে আট সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।  পরে ১২ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসকের কাছে ৩২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন দাখিল করেন কমিটির প্রধান।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, যদি ৫ আগস্টের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করতো, তাহলে প্রায় তিন সপ্তাহ পরে ভয়াবহ আগুন লাগা এড়ানো সম্ভব হতো।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছয় তলা ভবনের চতুর্থ ও পঞ্চম তলায় তামা ও রাসায়নিক লুট করতে গিয়ে একদল অনুপ্রবেশকারী নিচতলার গেট বন্ধ করে আগুন ধরিয়ে চলে যায়। ভবনে দাহ্য পদার্থ থাকার কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

আগুনের ঘটনার পাঁচদিন পর গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর কারখানাটির সামনে গণ-শুনানির আয়োজন করে জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি।

ওই সময় নিখোঁজ ৮০টি পরিবারের সদস্যরা তাতে অংশ নেন। গণ-শুনানি শেষে নিখোঁজ স্বজনরা বাধা উপেক্ষা করে ভবনে ঢোকেন এবং ভবনটি থেকে ১৫ খণ্ড হাড় উদ্ধার করেন। পরে তা পুলিশের কাছে জমা রাখা হয়।

হাড়গুলোর ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য তখন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের কাছে পাঠানোর কথা জানিয়েছিলেন জেলা পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদার।

তবে গত বৃহস্পতিবার যোগাযোগ করা হলে এ পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, 'সিআইডির ফরেনসিক বিভাগ থেকে এ হাড়গুলোর বিষয়ে কোনো আপডেট জানানো হয়নি।'

Comments

The Daily Star  | English

High Court gets 25 new judges

SC sources said this is one of the largest batches of appointments to the HC in recent years

47m ago