পশুর নদী খননের বালি থেকে ৩০০ একর কৃষিজমি রক্ষার দাবি

মোংলা বন্দরকে সচল রাখতে পশুর নদীর খননকাজ চলছে। সেখান থেকে উত্তোলিত বালু মোংলার চিলা এলাকায় ৭০০ একর জমিতে ফেলা হয়েছে। এখন বাকি বালু খুলনার দাকোপ উপজেলার বানিশান্তা ইউনিয়নের ৩০০ একর কৃষিজমিতে ফেলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
পশুর নদী খননের বালু বানিশান্তা ইউনিয়নের এই ৩০০ একর কৃষিজমিতে ফেলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ছবি: স্টার

মোংলা বন্দরকে সচল রাখতে পশুর নদীর খননকাজ চলছে। সেখান থেকে উত্তোলিত বালু মোংলার চিলা এলাকায় ৭০০ একর জমিতে ফেলা হয়েছে। এখন বাকি বালু খুলনার দাকোপ উপজেলার বানিশান্তা ইউনিয়নের ৩০০ একর কৃষিজমিতে ফেলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

তবে, এতে ওই ৩ ফসলি জমি পতিত হওয়ার পাশাপাশি কৃষি-নির্ভরশীল অন্তত ৫ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

তারা জানান, এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের জন্য দীর্ঘ প্রায় দেড় বছর ধরে তারা আন্দোলন-সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। কিন্তু, এখনো এই সমস্যার সমাধান হয়নি। বরং মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি প্রশাসনের সহায়তায় বালু ভরাট করার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন।

পশুর নদী খননের বালু বানিশান্তা ইউনিয়নের এই ৩০০ একর কৃষিজমিতে ফেলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ছবি: স্টার

বানিশান্তা ইউনিয়নের কৃষিজমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটির নেতা ও স্থানীয় কৃষক সত্যজিৎ গাইন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার ৭ বিঘা জমি আছে। এর ওপর আমার পরিবার নির্ভরশীল। এই জমিতে আমি তরমুজ ও ধান চাষ করি। কৃষির বাইরে আমি অন্য কোনো কাজ করতে পারি না। কৃষিকাজই এই অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষের পেশা। এই জমিতে বালু ফেলা হলে আমাদের জীবন-জীবিকার ওপর যে হুমকি আসবে, তা কোনোভাবেই সমাধান করা সম্ভব নয়। তখন বাস্তুহারা হওয়া ছাড়া আমাদের কোনো উপায় থাকবে না।'

'আমরা মোংলার চিলাতে দেখেছি, জমি হুকুম-দখল করে ৫-৬ ফুট বালু ফেলার কথা বলে এখন কমপক্ষে ২৫-৩০ ফুট উঁচু করে বালু ফেলা হচ্ছে। যেভাবে বালু ফেলা হচ্ছে, তাতে আজীবনের জন্য ওই জমিতে কিছু হবে না। বানিশান্তায় বালু ফেললে একই অবস্থা হবে। এলাকার মানুষ প্রয়োজনে জীবন দেবে। তবে, কৃষিজমিতে বালু ফেলতে দেবে না। আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি আমরা সব ধরনের প্রতিরোধ অব্যাহত রাখব', বলেন তিনি।

এই কৃষক আরও বলেন, 'বন্দর কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে ক্ষতিপূরণ বাবদ টাকা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু, আমরা সেটা নেইনি। আমরা অর্থ চাই না, আমাদের জমি রক্ষা করতে চাই।'

ওই গ্রামের আরেক কৃষক গৌতম রায় ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কৃষিজমি বালু দিয়ে ভরাট করার বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের আদেশ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা উপেক্ষা করে নেওয়া ওই সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে। মোংলা বন্দরকে টিকিয়ে রাখতে ও পশুর নদীর প্রাণ রক্ষায় নদী খনন জরুরি। কিন্তু, একইসঙ্গে নদী খনন করা বালু কোথায় রাখা হবে, তার একটি বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা থাকা জরুরি।'

'বাগেরহাটের রামপালে খান জাহান আলী বিমানবন্দরের ৬৩২ একর জায়গা অব্যবহৃত পড়ে আছে বছরের পর বছর। সে জায়গায় বালু ফেলা যেতে পারে। কিন্তু, বন্দর কর্তৃপক্ষ তা করছে না। নদী খননের সমস্যা সমাধানের জন্য পরিকল্পিত উপায় খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু, কোনোভাবেই মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ আমাদের কৃষিজমি রক্ষার কোনো চিন্তা না করে ৩ ফসলি জমিতে বালু ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা কোনোভাবেই এখানে বালু ফেলতে দেবো না', বলেন তিনি।

কৃষিজমি রক্ষার দাবিতে স্থানীয়দের আন্দোলন। ছবি: সংগৃহীত

ইতোমধ্যে বন্দর কর্তৃপক্ষ বাগেরহাটের মোংলার চিলা এলাকায় ৭০০ একর জায়গায় বালু ফেলেছে। সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, মোংলা বন্দরের পশ্চিম পাশ দিয়ে বয়ে চলা পশুর নদীর পাড়ে বানিশান্তা ইউনিয়ন। পানি উন্নয়ন বেড়িবাঁধের পশ্চিম পাশে বিস্তীর্ণ মাঠ। বর্ষা কম হওয়ায় মাঠে এখনো তেমন পানি উঠেনি। বানিশান্তা বাজারের প্রায় প্রতিটা দোকানেই অসংখ্য মানুষের আনাগোনা এবং কথাবার্তা চলছে এই বালু ফেলাকে কেন্দ্র করেই।

প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো আন্দোলনে অংশ নিচ্ছেন নারী-পুরুষ সবাই। উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা সবার মুখে। দেশের অন্যান্য জায়গায় পড়াশোনা করে নিজগ্রামে ফিরে এসে আন্দোলনে অংশ নিচ্ছেন অনেকেই। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো সামাজিক সংগঠন এই এলাকায় এসে আন্দোলনের একাত্মতা ঘোষণা করছে।

কাজের বিবরণী থেকে জানা যায়, ২০২০ সালের জানুয়ারিতে একনেক সভায় অনুমোদিত পশুর নদী খনন প্রকল্পের আওতায় পশুর নদী থেকে প্রায় ২১৬ লাখ ঘনমিটার মাটি ও বালু উত্তোলন করা হবে। ওই মাটি ও বালু দাকোপ ও মোংলা উপজেলার বিভিন্ন খাস ও ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিতে ফেলা হবে। এরমধ্যে দাকোপ উপজেলার বানিশান্তা ইউনিয়নের ৩০০ একর জমিতে খননকৃত মাটি ও বালু ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যা এখন পশুর নদী পাড়ের মানুষের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সুন্দরবন অঞ্চলের প্রাণ-প্রকৃতির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এই সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানিয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামাল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সমীক্ষা ছাড়াই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যা হাজারো মানুষের জীবন-জীবিকাকে হুমকির মুখে ফেলবে। পরিবেশ ধ্বংস করবে।'

বাপা মোংলা শাখার আহ্বায়ক মো. নূর আলম শেখ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সরকারি নথিতে বানিশান্তা এলাকায় বালি ফেলাকে কেন্দ্র করে সংঘাতের আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে। সেখানে বিকল্প প্রস্তাবও রয়েছে। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীও চান না ফসলি জমি নষ্ট হোক। আর এটা ৩ ফসলি জমি। যেখানে ব্যাপক ধান ও তরমুজ উৎপাদন হয়। সেখানে একাধিক বিকল্প থাকার পরও জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করে শিল্প মালিকদের স্বার্থরক্ষায় ওই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।'

সিদ্ধান্তটি উচ্চ আদালতের আদেশ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশনা উপেক্ষা করে নেওয়া বলে উল্লেখ করে তা বাতিলের দাবি জানিয়েছেন নূর আলম শেখ।

কৃষিজমি রক্ষার দাবিতে স্থানীয়দের আন্দোলন। ছবি: সংগৃহীত

স্থানীয়রা বলছেন, এভাবে বালু ফেললে বানিশান্তা এলাকার অন্তর ৫ গ্রাম বানিশান্তা, আমতলা, ভোজনখালি, খাজুরা, ঢাংমারি গ্রামের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। 

স্থানীয় চেয়ারম্যান সুদেব কুমার রায় ডেইলি স্টারকে বলেন, 'হুকুম দখলের জন্য ২ বছর আগে যখন ভূমি অফিসের কাছে প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছিল, তখন বলা হয়েছিল হুকুম-দখল করলে জনরোষ সৃষ্টি হবে। এখন হচ্ছেও তাই।'

'মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ বিকল্প হিসেবে খান জাহান আলী বিমানবন্দরের জায়গা, মোংলা বন্দরে নিজস্ব জায়গায় বালু ফেলতে পারে। কিন্তু, তারা তা করছে না। তাদের নজর আমাদের ৩ ফসলি জমির ওপর', যোগ করেন তিনি।

গত ৫ আগস্ট বাপা, বেলা, ব্র্যাক, টিআইবি, বাদাবন, আইআরভি, পরিবেশ সুরক্ষা মঞ্চ, এএলআরডি, নিজেরা করি ও অ্যাকশন এইড স্থানীয় বানিশান্তা বাজারে জনসভা করেন। জনসভায় কয়েক হাজার মানুষ অংশ নেন।

গত ২৭ জুলাই মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ পুলিশ নিয়ে হুকুম-দখলের জন্য লাল প্লাগ ও সাইনবোর্ড টানাতে আসলে জনগণের প্রতিরোধের মুখে ফিরে যায়। গত ৯ আগস্ট একই কাজ করতে এসে তারা আবারও প্রতিরোধের মুখে পড়েন। পরে স্থানীয়রা মিছিলও করেন।

খুলনা জেলা প্রশাসক মো. মনিরুজ্জামান তালুকদার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জমি অধিগ্রহণের যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে তা মোংলা বন্দরের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এটি দেখভালের দায়িত্ব এখন তাদের।'

'তারপরও আমি সম্প্রতি বানিশান্তা এলাকা পরিদর্শন করেছি, সেখানকার মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। সেখানে প্রায় সবারই পেশা কৃষিকাজ। এই জমিতে ধান ও তরমুজের চাষ হয়। সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে সমাধানের একটি উপায় নিশ্চয়ই হবে', যোগ করেন জেলা প্রশাসক।

বানিশান্তায় যে ৩০০ একর জমিতে বালু ফেলা হবে, তাতে জমির উর্বরতা বা কৃষিজমি নষ্ট হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে মোংলা বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ মুসা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এখানে যে কৃষিজমির কথা বলা হচ্ছে, এটা সম্পূর্ণ অসত্য কথা। এখানে কোনো কৃষিজমি ছিল না। খালি জমি। এই জমিতে তেমন কোনো ফসল নেই। সরকার এই জমির জন্য ১০ বছরের ক্ষতিপূরণ দিয়েছেন। মোংলা বন্দরের নাব্যতা রক্ষায় দেড় বছর আগে থেকে তাদের সঙ্গে কথা বলছি আমরা। মোংলা এলাকায় ৭০০ একর জমিতে বালু ফেলা হয়েছে। আরও ৩০০ একর দরকার। ৭ মিটার থেকে ৯ মিটার ড্রেজিং করতে হবে।'

তিনি আরও বলেন, 'পশুর নদীর পূর্ব পাড়ে বালু ফেলার জায়গা নেই। কারণ সেখানে সব কল-কারখানা। তাই পশুর নদীর পশ্চিম পাশে বানিশান্তা এলাকায় জমির দরকার পড়েছে। যদি কিছু জমির ক্ষতিও হয়, কৃষিজমির কত টাকার ক্ষতি হয়েছে, তা বিবেচনায় নিয়ে ৭ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে', বলেন তিনি।

পশুর নদী খননের বালু বানিশান্তা ইউনিয়নের এই ৩০০ একর কৃষিজমিতে ফেলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ছবি: স্টার

'কিছু লোক জাস্ট ক্রিয়েটিং নুইসেন্স। কিছু পরিবেশের লোকজন টাকা-পয়সা দেয়, তা দিয়ে তারা (এলাকাবাসী) আন্দোলন করছে। আমার লোক ব্যানার লাগিয়ে দিয়েছে, তা খুলে ফেলছে। আমরা ২ বছরের জন্য নিচ্ছি। আমরা অধিগ্রহণ করছি না তো! হুকুম দখল। ২ বছরের জন্য। এরপর তারা তাদের জমি ফেরত পাবে। আমরা ক্ষতিপূরণ দিচ্ছি ১০ বছরের জন্য। কিন্তু, ওকুপাই করছি ২ বছরের জন্য', যোগ করেন তিনি।

বিকল্প কোনো ব্যবস্থা ছিল কি না বা এখনো আছে কি না? জানতে চাইলে মোহাম্মদ মুসা বলেন, 'খান জাহান আলী বিমানবন্দর ড্রেজিং এরিয়া থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে। তাই অত দূরে পাইপ দিয়ে বালু ফলা সম্ভব নয়। আর মোংলা বন্দরের যে নিজস্ব জায়গার কথা বলা হয়েছে, আমরা সেখানেও বালু ফেলছি।'

মোংলা বন্দরের নিজস্ব অগ্রগতি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বানিশান্তায় জনরোষের সৃষ্টি হতে পারে। তা যদি ঘটে এবং স্থানীয় জনগণ যদি বালু ফেলতে বাধা সৃষ্টি করে, তারপরও আপনারা এই কাজ করবেন কি না বা এর বিকল্প কোনো উপায় খুঁজবেন কি না, এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, 'মোংলা বন্দর সচল রাখার জন্য, দেশের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার জন্য এবং বন্দরকে আরও কার্যকর করার জন্য পশুর নদীর ড্রেজিং করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। তাই দেশের স্বার্থে, বন্দরের স্বার্থে আমাদেরকে এই কাজ চালিয়ে যেতেই হবে।'

Comments