পাটের উৎপাদন খরচ বাড়লেও বাড়েনি দাম

পাটচাষি খয়বর আলী (৫২) হতাশ ও নির্বাক। উৎপাদিত পাট হাটে বিক্রি করতে এসে তার মাথায় হাত। আশা করেছিলেন গত বছরের তুলনায় এ বছর বেশি দামে পাট বিক্রি করতে পারবেন। কিন্তু, বিধি বাম।
পাট
লালমনিরহাট সদর উপজেলার বড়বাড়ী হাটে পাটচাষি খয়বর আলী। ৭ সেপ্টেম্বর ২০২২। ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

পাটচাষি খয়বর আলী (৫২) হতাশ ও নির্বাক। উৎপাদিত পাট হাটে বিক্রি করতে এসে তার মাথায় হাত। আশা করেছিলেন গত বছরের তুলনায় এ বছর বেশি দামে পাট বিক্রি করতে পারবেন। কিন্তু, বিধি বাম।

গত বছরের তুলনায় খয়বর আলীকে কম দামে পাট বিক্রি করতে হয়েছে। গত বছর তিনি প্রতি মণ পাট বিক্রি করেছিলেন ৩ হাজার টাকা থেকে ৩ হাজার ৩০০ টাকা দরে। এ বছর পাট বিক্রি করতে হয়েছে ২ হাজার ৬০০ টাকা থেকে ২ হাজার ৯০০ টাকা মণ দরে।

লালমনিরহাট সদর উপজেলার বড়বাড়ী গ্রামের কৃষক খয়বর আলী পাটচাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। তার মতো অন্য পাটচাষিরাও হতাশ।

খয়বর আলী দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, এবার ৩ বিঘা জমিতে পাটচাষ করে ফলন পেয়েছেন ১৭ মণ। খরচ হয়েছে ৪৬ হাজার টাকা। গত বছর ৩ বিঘা জমি থেকে পাট পেয়েছিলেন ১৯ মণ আর খরচ হয়েছিল ৪০ হাজার টাকা।

পাট
লালমনিরহাট সদর উপজেলার বড়বাড়ী হাটে পাট বিক্রি করতে এসেছেন কৃষকরা। ৭ সেপ্টেম্বর ২০২২। ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

এ বছর তেল, সার, কীটনাশকের দাম ও শ্রমিক মজুরি বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়েছে। তিনি বলেন, 'পাট চাষ করে আমাদের ক্ষতি হচ্ছে। পাট চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি।'

লালমনিরহাট সদর উপজেলার গোকুন্ডা গ্রামের কৃষক দেলোয়ার হোসেন (৬০) ডেইলি স্টারকে জানান, গত বছর তিনি ৮ বিঘা জমিতে পাটচাষ করেছিলেন। এ বছর চাষ করেছেন ৫ বিঘা জমিতে।

তিনি বলেন, 'পাটে লাভ করতে পারছি না। ভেবেছিলাম এ বছর প্রতি মণ পাট ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করতে পারবো। তা বিক্রি করতে হচ্ছে ৩ হাজার টাকার কমে।'

'এ বছর ৫ বিঘা জমি থেকে পাটের ফলন হয়েছে ২৯ মণ। উৎপাদন খরচ হয়েছে ৭৬ হাজার টাকা,' যোগ করেন তিনি।

কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, চলতি বছর রংপুর অঞ্চলের ৫ জেলা—লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, রংপুর, নীলফামারী ও গাইবান্ধায় ৭০ হাজার কৃষক ৫১ হাজার ৬২৭ হেক্টর জমিতে পাট চাষ করেছেন। গত বছর পাট চাষ হয়েছিল ৫৬ হাজার ৪১২ হেক্টর জমিতে।

এ বছর লালমনিরহাটে পাট চাষ হয়েছে ৪ হাজার ৮৫ হেক্টর, কুড়িগ্রামে ১৬ হাজার ৫৭৭ হেক্টর, নীলফামারীতে ৬ হাজার ৭১০ হেক্টর, গাইবান্ধায় ১৫ হাজার হেক্টর ও রংপুরে ৯ হাজার ২৫৫ হেক্টর জমিতে।

এ বছর পাটের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৮০ মেট্রিক টন। প্রতি বিঘা জমিতে পাট উৎপন্ন হয়েছে ৬ থেকে ৭ মণ।

কুড়িগ্রামের রাজিবপুর উপজেলার কোদালকাটি গ্রামের কৃষক মজিবর রহমান (৬৫) ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এ বছর প্রতি বিঘায় ৫-৬ মণ পাটের ফলন পেয়েছি। কোনো কোনো কৃষক পেয়েছেন ৩-৪ মণ।'

'গত বছরের তুলনায় প্রতি বিঘা জমিতে পাটের উৎপাদন খরচ বেড়েছে ২-৩ হাজার টাকা। প্রতি বিঘা জমিতে পাট উৎপাদনে খরচ হয়েছে ১৩-১৬ হাজার টাকা।'

পাট
লালমনিরহাট সদর উপজেলার বড়বাড়ী হাটে পাট বেচাকেনা। ৭ সেপ্টেম্বর ২০২২। ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

'গত বছর ১০ বিঘা জমিতে পাট চাষ করলেও এ বছর চাষ করেছি ৬ বিঘা জমিতে,' যোগ করেন তিনি।

তার মতে, 'গত কয়েক বছর ধরে পাট চাষ করে লাভ করতে পারছি না। প্রতি মণ পাটের দাম ৩ হাজার ৬০০ টাকা থেকে ৪ হাজার টাকা হলে পাট চাষে লাভ হবে।'

কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার যাদুরচর গ্রামের কৃষক সফিয়ার রহমান (৫৬) ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পাট উৎপাদনে খরচ বাড়লেও পাটের দাম না বাড়ায় লোকসান হচ্ছে। ৪ বিঘা জমি থেকে পাট পেয়েছি ১৭ মণ। মণপ্রতি ২ হাজার ৮০০ টাকা দরে ৪৭ হাজার ৬০০ টাকায় পাট বিক্রি করেছি।'

তিনি আরও বলেন, '৪ বিঘা জমিতে পাট চাষ করতে খরচ হয়েছে ৫৬ হাজার টাকা। এ বছর পাট চাষ করে ৯ হাজার টাকা লোকসানে পড়েছি।'

লালমনিরহাট সদর উপজেলা বড়বাড়ী হাটে পাট ব্যবসায়ী নুর ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আঁশের গুণগতমান অনুযায়ী কৃষকদের কাছ থেকে প্রতি মণ পাট ২ হাজার ৬০০ টাকা থেকে ২ হাজার ৯০০ টাকা দরে কিনছি। প্রতি মণ পাট ৮০-১০০ টাকা লাভে মহাজনদের কাছে বিক্রি করছি।'

'আমরাও ভেবেছিলাম এ বছর পাটের দাম বাড়বে। কিন্তু, বাড়েনি। উল্টো গত বছরের তুলনায় কমেছে।'

তিনি আরও বলেন, 'কৃষকরা যখন কম দামে পাট বিক্রি করেন তখন তাদেরকে খুব হতাশ দেখায়। তাদের মুখে হাসি থাকে না।'

কুড়িগ্রামে পাটের মহাজন রনজিত সাহা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কোম্পানিগুলো এখনো পাট কিনতে শুরু করেনি। কৃষক ও খুচরা ব্যবসায়ীর কাছ থেকে পাট কিনে গুদামে রাখছি। কোম্পানি কত টাকা দরে পাট কিনবে তা জানি না।'

'সরকারিভাবে পাটের দাম নির্ধারণ করা থাকলে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা উপকৃত হতেন' বলে মন্তব্য করেন তিনি।

লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক হামিদুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত বছরের তুলনায় পাটের দাম কম হওয়ায় কৃষক হতাশ। তেল, সার, কীটনাশক ও আর শ্রমিকের মজুরি বেড়ে যাওয়ায় এ বছর পাট উৎপাদনে কৃষককে বেশি খরচ করতে হয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'পাটচাষে কৃষক লাভবান না হওয়ায় প্রতি বছর পাট চাষ কমে যাচ্ছে। কৃষকদের দাবি সরকারিভাবে পাটের দাম নির্ধারণ করা হলে তারা পাট চাষ নিয়ে নিশ্চিত থাকতে পারতেন।'

Comments