ধান চাষে কৃষক ছাড়া সবাই লাভবান

উত্তরাঞ্চলের কৃষক- যারা বছরে ২ বার ধান চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করেন, তারা একটু লাভের আশায় বছরের পর বছর ধরে সংগ্রাম করে আসছেন। তবে গত ৫ বছরে উৎপাদন খরচ উল্লেখযোগ্য বাড়লেও ধানের দাম আনুপাতিক হারে বাড়েনি।
সম্প্রতি সার ও ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ার ফলে প্রান্তিক কৃষকদের পক্ষে ধান চাষ করে লাভ করা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ছবি: মোস্তফা সবুজ/স্টার

উত্তরাঞ্চলের কৃষক- যারা বছরে ২ বার ধান চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করেন, তারা একটু লাভের আশায় বছরের পর বছর ধরে সংগ্রাম করে আসছেন। তবে গত ৫ বছরে উৎপাদন খরচ উল্লেখযোগ্য বাড়লেও ধানের দাম আনুপাতিক হারে বাড়েনি।

বগুড়া, জয়পুরহাট, গাইবান্ধা ও দিনাজপুরের কৃষকরা জানান, সম্প্রতি সার ও ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ার ফলে প্রান্তিক কৃষকদের পক্ষে ধান চাষ করে লাভ করা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

সম্প্রতি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) বগুড়া অঞ্চলের কার্যালয় সিরাজগঞ্জ ,পাবনা, জয়পুরহাট এবং বগুড়া জেলায় চাষ করা আমন ধানের উৎপাদন খরচের হিসাব করেছে। দ্য ডেইলি স্টারের হাতে সেই হিসাবের একটি কপি এসেছে।

ছবি: মোস্তফা সবুজ/স্টার

এই নথিতে দেখা যায় যে, প্রতি বিঘা (৩৩ দশমিক) আমন ধান উৎপাদনে খরচ ধরা হয়েছে ১৮ হাজার ৬০৭ টাকা, যার ফলন ধরা হয়েছে ৬১৭ কেজি (প্রায় ১৫ দশমিক ৫ মণ)। বর্তমান সরকারি দামে কৃষক এই সাড়ে ১৫ মণ ধান বিক্রি করলে পাবেন ১৯ হাজার ৬৫৯ টাকা। এর মধ্যে এক বিঘা জমির খড়ের দাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ৩ হাজার টাকা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যে আরও দেখা যায়, চলমান আমন মৌসুমে প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে খরচ পড়ছে ৩০ টাকা এবং চালের খরচ প্রতি কেজি ৫০ টাকা। সেই হিসাবে ১ মণ (৪০ কেজি) ধান উৎপাদনে খরচ পড়ছে ১ হাজার ২০০ টাকা, অথচ বর্তমানে ১ কেজি ধানের দাম সরকার নির্ধারণ করেছে ২৭ টাকা। এই দামে ধান বিক্রি করলে কৃষক প্রতি মণে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন ১২০ টাকা।

বগুড়া, জয়পুরহাট, দিনাজপুর ও গাইবান্ধার কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কৃষি-সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া হিসাব থেকে বাস্তবে ধানের উৎপাদন খরচ একটু বেশি।

কৃষকরা বলেছেন, সবসময় আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্ধারিত খরচে ধান চাষ সম্ভব হয় না। এবার ধান চাষের প্রায় সব উপাদান, যেমন: সার, কীটনাশক, জমি চাষের খরচ ইত্যাদি বেড়েছে, যার ফলে ধান চাষের খরচও অতিরিক্ত হারে বেড়ে গেছে।

ছবি: মোস্তফা সবুজ/স্টার

তাছাড়া, অঞ্চলভেদে জমির ভাড়া কম-বেশি হয়। সে কারণে কোনো কোনো অঞ্চলে ধান চাষের খরচ আরও বেশি। সাধারণত যে এলাকায় ধান ছাড়াও জমিতে অন্য ফসল, যেমন: জয়পুরহাট ও বগুড়ায় আলু চাষ হয়, সেজন্য সেখানে প্রতি একর জমি প্রায় ৭৫ হাজার টাকায় এক বছরের জন্য ইজারা নিতে হয়। ঘোড়াঘাট উপজেলার জমিতে বছরে ২ বার ধান হয় এবং প্রতি একর ফসলি জমি এখানে ২২-২৪ হাজার টাকায় এক বছরের জন্য লিজ নিতে হয়।

অন্যদিকে, এ বছর ভারতে কমিশন ফর এগ্রিকালচারাল কস্টস অ্যান্ড প্রাইসেস (সিএসিপি) এক কুইন্টাল (১০০ কেজি) আমন ধান উৎপাদনে খরচ দেখিয়েছে মাত্র ১ হাজার ৩৬০ রুপি এবং ১ কুইন্টাল আমন ধানের দাম ভারত সরকার নির্ধারণ করে দিয়েছে ন্যূনতম ২ হাজার ৪০ রুপি, যাতে কৃষকরা প্রতি কুইন্টাল ধানে ৬৮০ টাকা লাভ করতে পারেন।

বর্তমানে বাংলাদেশে সরকার নির্ধারিত দামে এক কুইন্টাল ধান বিক্রি করলে প্রতি কুইন্টালে কৃষকদের ৩০০ টাকা লোকসান গুণতে হবে।

কৃষি অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ৫ বছর আগে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে আমন, বোরো এবং আউশের জন্য বিঘা প্রতি উৎপাদন খরচ ছিল যথাক্রমে ১১ হাজার ৫০০ টাকা, ১৩ হাজার ২৫০ টাকা এবং ৬ হাজার ৪৮৫ টাকা।

ছবি: মোস্তফা সবুজ/স্টার

চলতি মৌসুমে ৫ একর জমিতে আমন ধান চাষ করা দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার পশ্চিম পলশা গ্রামের কৃষক সেলিম সাজ্জাদ বলেন, 'ধান চাষকে কেন্দ্র করে যারা সেচ পাম্পের মালিক, পাওয়ার টিলারের মালিক, বীজ-সার-কীটনাশকের ডিলার-দোকানি, মাড়াই যন্ত্রের মালিক, তারা সবাই লাভ করছেন। তবে কৃষক যারা অনেক পরিশ্রম আর শঙ্কা নিয়ে ধান চাষ করছেন, কেবল তারাই কোনো লাভের মুখ দেখছেন না।'

পালশা গ্রামের কৃষকরা জানান, যাদের নিজেদের জমি আছে তারা ধান চাষ করলে কিছুটা লাভ করতে পারেন, কিন্তু এই গ্রামের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কৃষক জমি ইজারা নিয়ে ধান চাষ করছেন, যাদের এই পেশা থেকে কোনো লাভ বা উন্নতি হচ্ছে না।

বগুড়ার শাহজাহানপুর উপজেলার চকজোরা গ্রামের কৃষক আব্দুল মজিদ জানান, ২-৪ বিঘা জমিতে ধান চাষ করে সংসার চলে না। বাড়তি আয়ের জন্য তিনি এখন সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালাতে বাধ্য হয়েছেন।

তিনি বলেন, 'বাপের জনমেও কখনো আমন ধান চাষ করতে এত টাকা খরচ করতে হয়নি, যা এ বছরে হচ্ছে। এ বছর ধান বিক্রি করে কোনো লাভ হবে কি না তা নিয়ে শঙ্কায় আছি।'

ছবি: মোস্তফা সবুজ/স্টার

জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার মালটিয়া গ্রামের কৃষক রাশেদুল ইসলাম বলেন, 'এই মৌসুমে ফসল কাটার পর সব ধান বেঁচে দিতে হবে ঋণ পরিশোধের জন্য। সব কিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় এবার অতিরিক্ত খরচের ব্যবস্থা ঋণ নিয়ে করতে হচ্ছে। খরচের বাজেট ফেল করেছে এবার।'

'ভয় পাচ্ছি দায়-দেনা শোধের জন্য যদি সব ধান বিক্রি করে দিতে হয়, তবে পরিবারকে খাওয়ানোর জন্য আমাকে বাজার থেকে চাল কিনতে হবে এবং আলু চাষের জন্য আবার টাকা ধার করতে হবে', যোগ করেন তিনি।

ধান চাষে কেন লাভ হয় না? জানতে চাইলে দিনাজপুর কৃষি-সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. নুরুজ্জামান বলেন, 'কৃষকের বিভিন্ন রকমের জমি থাকে। কিছু জমি উঁচু কিছু নিচু। শুধু ধান চাষে লাভ না হলে কৃষককে ধানের পাশাপাশি অন্যান্য ফসলেরও চাষ করতে হবে। আমরা সবসময় তাদের সেই পরামর্শই দেই।'

Comments