বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনে রংপুরে জনপ্রিয় হচ্ছে ভার্মি কম্পোস্ট

ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদন ও বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন রংপুর বিভাগের লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী ও রংপুরের প্রায় ১০ হাজার কৃষক। তাদের অধিকাংশই প্রান্তিক চাষি।
ভার্মি কম্পোস্ট
কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার পশ্চিম সরকারপাড়া গ্রামে ভার্মি কম্পোস্ট তৈরি করছেন আমেনা বেগম। ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদন ও বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন রংপুর বিভাগের লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী ও রংপুরের প্রায় ১০ হাজার কৃষক। তাদের অধিকাংশই প্রান্তিক চাষি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, একজন কৃষক বছরে ৩-১০ মেট্রিক টন পর্যন্ত ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদন করছেন। তারা প্রতি কেজি ভার্মি কম্পোস্ট সার বিক্রি করছেন ১১-১২ টাকা দরে। তাদের উৎপাদন খরচ ৬-৭ টাকা।

ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদনকারী কৃষকরা একই সঙ্গে ১০-৩০ কেজি পর্যন্ত কেঁচো উৎপাদন করছেন। প্রতি কেজি কেঁচো বিক্রি করছেন ৯০০-১২০০ টাকা কেজি দরে।

বসতভিটা ও স্বল্প পরিমাণ জমিতে শাকসবজি উৎপাদনে ভার্মি কম্পোস্ট ব্যবহার অনেক বেড়েছে।

রংপুর বিভাগীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর দ্য ডেইলি স্টারকে এ তথ্য জানিয়েছে।

ভার্মি কম্পোস্ট
কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার পশ্চিম সরকারপাড়া গ্রামে ভার্মি কম্পোস্ট তৈরি করছেন সলিমুদ্দিন। ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার ব্রহ্মপুত্র পাড়ের ভট্টপাড়া গ্রামের প্রান্তিক চাষি আদুরী বেগম (৫০) ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত এক বছর ধরে ১০টি রিংয়ের মাধ্যমে ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন করছি। প্রতি ৩ সপ্তাহ পরপর প্রতি রিং থেকে ২০ কেজি ভার্মি কম্পোস্ট ও এক কেজি কেঁচো উৎপাদন করছি।'

প্রতি ৩ সপ্তাহে তিনি ১০টি রিং থেকে ২০০ কেজি ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন করে তা বিক্রি করছেন ২ হাজার ৪০০ টাকায়। ১০ কেজি কেঁচো বিক্রি করে পাচ্ছেন ৯ হাজার টাকা।

ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদনে প্রতি ৩ সপ্তাহে তাকে ১ হাজার ৩০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা খরচ করতে হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

'ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদনে গোবর, ডিমের খোসা, শাকসবজির পরিত্যক্ত অংশ, ব্যবহৃত চা-পাতার অবশিষ্ট অংশ ও পচে যাওয়া গাছের পাতা ব্যবহার করছি,' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'আমাকে গোবর কিনতে হয় বলে উৎপাদন খরচ একটু বেশি। যাদের গোবর কিনতে হয় না তাদের উৎপাদন খরচ কম।'

'ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদন ও বিক্রি করে আশানুরূপ লাভবান হচ্ছি। এ টাকা দিয়ে আমাদের ২ ছেলেকে কলেজে পড়াচ্ছি,' যোগ করেন তিনি।

চিলমারী উপজেলার পশ্চিম সরকারপাড়া গ্রামের প্রান্তিক চাষি সলিমুদ্দিন (৫৬) ডেইলি স্টারকে বলেন, 'একটি বেসরকারি সংস্থায় ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদনের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়েছি। সংস্থাটি কেঁচো দিয়ে সহযোগিতা করেছে। ২ বছর আগে ২ কেজি কেঁচো দিয়ে ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন শুরু করি। এখন ১০টি রিঙে ১০ কেজি কেঁচো দিয়ে ভার্মি কম্পোস্ট তৈরি করছি।'

'স্থানীয় সার ব্যবসায়ীদের কাছে ভার্মি কম্পোস্ট বিক্রি করছি। বেসরকারি সংস্থাটি আমাদের কাছ থেকে কেঁচো কিনে নেয়। ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন ও বিক্রি করে যা আয় করছি তা দিয়ে সংসার ভালোভাবে চলছে।'

চিলমারীতে ৫০০-৬০০ প্রান্তিক চাষি ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন করছেন বলে জানান তিনি।

চিলমারীতে সাসটেইনড অপরচুনিটিজ ফর নিউট্রিশন গভর্নেন্স (সঙ্গো) প্রকল্পের মাধ্যমে প্রান্তিক কৃষকদের ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদনে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। তাদের কেঁচো দিয়ে সহযোগিতা করা হয়। তাদের উৎপাদিত কেঁচো কিনে নতুন চাষিদের বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের আর্থিক সহায়তায় যৌথভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বেসরকারি সংস্থা আরডিআরএস বাংলাদেশ ও কর্ডএইড।

প্রকল্পটির চিলমারী উপজেলা ব্যবস্থাপক আহসানুল কবির বুলু ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রান্তিক কৃষকরা ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন করে তা নিজেদের বসতভিটা ও স্বল্প পরিমাণ জমিতে শাকসবজিতে ব্যবহার করছেন। তারা উৎপাদিত ভার্মি কম্পোস্ট বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন।'

'আমরা বিষমুক্ত শাকসবজি উৎপাদনে কৃষকদের উৎসাহী করতে তাদেরকে ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদনে সহযোগিতা করছি। বর্তমানে এই সারের ব্যবহার অনেক বেড়েছে।'

লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার সারপুকুর গ্রামের কৃষক নজরুল ইসলাম (৬০) ডেইলি স্টারকে বলেন, '২০টি রিঙের মাধ্যমে প্রতি ৩ সপ্তাহে ৪০০ কেজি ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন করছি। স্থানীয় সার ব্যবসায়ীদের কাছে তা বিক্রি করে লাভবান হচ্ছি। উৎপাদিত কেঁচো বেশ কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা কিনে নিচ্ছে।'

'যেহেতু আমাকে গোবর কিনতে হয় না সেজন্য প্রতি কেজি ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদনে খরচ হয় ৩-৪ টাকা,' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'আমি নিজেও ভার্মি কম্পোস্ট ব্যবহার করে শাকসবজি উৎপাদন করছি।'

রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার মধুপুর গ্রামের প্রান্তিক কৃষক সুভাষ চন্দ্র সেন (৫০) ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ভার্মি কম্পোস্ট কেনার জন্য সার ব্যবসায়ীরা অগ্রিম টাকা দিচ্ছেন। স্থানীয়ভাবে কৃষকরাও ভার্মি কম্পোস্ট কিনে থাকেন। অনেক কৃষক কেঁচো কিনে নিচ্ছেন।'

তিনি জানান, গত ৩ বছর ধরে তিনি ১৫টি রিং দিয়ে ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন করছেন। আগের তুলনায় ভার্মি কম্পোস্ট সারের ব্যবহার বেড়েছে।

চিলমারী উপজেলার সার ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কৃষকদের কাছ থেকে প্রতি কেজি ভার্মি কম্পোস্ট সার ১১-১২ টাকা দরে কিনে তা ১৬-১৭ টাকা দরে বিক্রি করছি। আগের তুলনায় এ সারের বিক্রি কয়েক গুণ বেড়েছে। ভার্মি কম্পোস্ট সারের জন্য কৃষককে অগ্রিম টাকা দিয়ে থাকি।'

লালমনিরহাট সদর উপজেলার মহেন্দ্রনগর গ্রামের কৃষক নারায়ণ চন্দ্র বর্মণ (৬৫) ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ভার্মি কম্পোস্ট ব্যবহার করে সবজি চাষ করলে আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায়।'

কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিপ্লব কুমার মোহন্ত ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কৃষি বিভাগ ও কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা প্রান্তিক কৃষকদের ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদনে উৎসাহ ও পরামর্শ দিচ্ছে। বিষমুক্ত শাকসবজি উৎপাদনে ভার্মি কম্পোস্ট ব্যবহার জরুরি। এ সার উৎপাদন করে প্রান্তিক চাষিরা লাভবান হচ্ছেন। অনেকের সংসার চলছে। এই সারের ব্যবহার প্রতিদিন বাড়ছে।'

Comments