প্রচলিত কৃষির ধারণা পাল্টে দিয়েছেন যে কৃষক

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হলেও, কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত কৃষকরা এখনো সমাজে অবহেলিত। তবে প্রচলিত ধারণা পাল্টে দিয়েছেন পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার কৃষক শাজাহান আলি বাদশা।
প্রচলিত কৃষির ধারণা
নিজের খামারে শাজাহান আলি বাদশা। ছবি: আহমেদ হুমায়ুন কবির তপু/স্টার

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হলেও, কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত কৃষকরা এখনো সমাজে অবহেলিত। তবে প্রচলিত ধারণা পাল্টে দিয়েছেন পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার কৃষক শাজাহান আলি বাদশা।

উপজেলার বক্তারপুর গ্রামের প্রান্তিক কৃষক পরিবারের সন্তান বাদশা লেখাপড়া শেষ করে চেয়েছিলেন চাকরি করতে। পরিবারের দারিদ্র্যতার কারণে ছাত্রজীবনেই তাকে কাঁধে তুলে নিতে হয়েছিল লাঙ্গল-জোয়াল।

প্রয়োজনের তাগিদে কৃষি কাজ শুরু করলেও, উদ্ভাবনী কৃষি তাকে সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করে। তাই চাকরির কথা না ভেবে নিজেকে কৃষির সঙ্গেই সম্পৃক্ত রেখেছেন।

প্রায় ৪ যুগের কৃষিকাজ শাজাহান আলিকে এনে দিয়েছে সাফল্য। পাশাপাশি পেয়েছেন সম্মাননা, রাষ্ট্রীয় পদক। দেশের কৃষকদের জন্য আদর্শ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে শাজাহান আলি বাদশা এআইপি পদক (কৃষিতে সর্বোচ্চ সম্মাননা অ্যাগ্রিকালচার ইম্পরট্যান্ট পারসন) অর্জন করেছেন।

কৃষক শাজাহান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, '১৯৭৮ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর কলেজে পড়ার খরচ যোগানোর জন্য বাবার কাছ থেকে আড়াই বিঘা জমি নিয়ে প্রথমে বেগুন চাষ শুরু করি।'

'প্রথম বছর ৩৬ হাজার টাকার বেগুন বিক্রি করি। তখনই চাষাবাদের প্রতি আগ্রহ জন্মে। প্রথম সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে আরও কয়েক বিঘা জমি ইজারা নিয়ে বেগুন ও কলা চাষ শুরু করি।'

তিনি জানান, প্রথম দিকে চাষাবাদের পাশাপাশি নিজেই হাট-বাজারে গিয়ে উৎপাদিত সবজি বিক্রি করতেন। তাই লাভের পুরোটাই নিজের কাছে থাকত।

প্রচলিত কৃষির ধারণা
নিজের খামারে ফসলের পরিচর্যায় শাজাহান আলি বাদশা। ছবি: আহমেদ হুমায়ুন কবির তপু/স্টার

বাদশা আরও বলেন, 'কলেজে পড়ার সময় কৃষকের মতো মাঠে কাজ করায় অনেক বন্ধুরা মিশতে চাইত না। আমি হতাশ হইনি।'

কৃষিকাজের মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সংকল্প নিয়ে ছাত্রজীবন থেকেই এ কাজে তিনি নিজেকে নিয়োজিত রাখেন।

প্রথাগত চাষাবাদের বাইরে গিয়ে শাজাহান আলি বেশ কয়েক জাতের লাভজনক ফসলের বাণিজ্যিক চাষে মনযোগী হন।

নিজের বেশি জমি না থাকলেও, অন্যের কাছ থেকে জমি ইজারা নিয়ে বেগুন, কলা, ফুলকপি ও পেঁপে চাষ শুরু করেন।

মাত্র ৭ বছরেই পরিকল্পিতভাবে উৎপাদন করে বছরে কয়েক লাখ টাকা উপার্জন করতে সক্ষম হন শাজাহান।

১৯৮০'র দশকে স্নাতক শেষ করে চাকরি না খুঁজে কৃষিকাজেই মনযোগী হন তিনি। সাফল্য ধরা দেয় ১৯৯০'র দশকে। সে সময় তিনি উন্নত জাতের পেঁপে চাষ করে দেশব্যাপী সারা ফেলেন।

বাদশা বলেন, 'উন্নত হাইব্রিড জাতের পেঁপে আবাদ করে লাভ করায় তখন প্রায় ১০০ বিঘা জমি লিজ নিয়ে পেঁপের বাণিজ্যিক আবাদ শুরু করি।'

সে সময় বছরে কয়েক কোটি টাকার পেঁপে বিক্রি করেন তিনি। তার পেঁপে চাষের সংবাদ গণমাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার পর তাকে অনেকে 'পেঁপে বাদশা' আখ্যা দেন।

এ সাফল্যের কারণে ১৯৯১ সালে প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড, ১৯৯৭ সালে বঙ্গবন্ধু পদক ও ১৯৯৮ সালে স্বর্ণপদকে ভূষিত হন তিনি।

২০০৪ সালে ঝড়ে তার পেঁপে বাগানের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। তিনি থেমে যাননি। নতুন করে আবার শুরু করেন নানান ধরনের লাভজনক ফসলের আবাদ।

বর্তমানে তার ৬৩ একরের নিজস্ব কৃষি খামার আছে। সেখানে ৬০ এর বেশি প্রজাতির দেশি-বিদেশি ফল ও ফসলের বাণিজ্যিক আবাদ হচ্ছে।

বাদশা জানান, তার প্রতিষ্ঠিত 'মামনি কৃষি খামারে' আছে ১২ একরের মেওয়া বাগান, ৮ একরের লিচু বাগান, ৭ একরের পেঁপে বাগান, ২ একরের অ্যাভক্যাডো বাগান ও ৩ একরের ড্রাগন বাগান।

এ ছাড়া বেল, জলপাই, মাল্টা, কলা, কদবেল ও বারোমাসি আমসহ নানান ধরনের ফল-ফসলের বাণিজ্যিক আবাদ করছেন তিনি।

ধান, পাট ও চৈতালি ফসলের আবাদ তো নিয়মিতভাবে আছেই।

শুধু ফসল আবাদই নয়, উৎপাদিত ফসল গ্রাহকের কাছে পোঁছে দিতে নিজেই মার্কেটিংয়ের কাজ করেন শাজাহান আলি।

তার উৎপাদিত এসব পণ্য স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি রাজধানীতে বিক্রি করার জন্য ঢাকায় নিজস্ব শো রুম ও ওয়্যারহাউজ স্থাপন করেছেন। তার খামারের পণ্য পরিবহনের জন্য আছে নিজস্ব পরিবহন।

শাজাহান আলি বাদশার মতে, 'দেশের কৃষকরা উৎপাদন করলেও, বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়া মধ্যসত্ত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণে। তাই কৃষকরা পণ্যের সঠিক দাম পায় না।'

উৎপাদন থেকে বাজারজাতকরণ পর্যন্ত সবকিছুই নিজেই নিয়ন্ত্রণ করায় পণ্যের সঠিক দাম পাওয়ার পাশাপাশি, গ্রাহক পর্যায়েও তিনি ন্যায্য দামে পণ্য দিতে পারছেন।

পরিকল্পিত কৃষিকাজের পাশাপাশি মধ্যসত্ত্বভোগীদের দাপট কমানো গেলে কৃষকরা বাণিজ্যিক সাফল্য পাবে বলে মনে করেন তিনি।

পাবনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা সাইফুল আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শাজাহান আলি বাদশা পরিকল্পিত উপায়ে নানান ফসলের বাণিজ্যিক আবাদ করে সফলতা পেয়েছেন। তাকে দেখে এ অঞ্চলে কৃষকদের মধ্যে উৎসাহ সৃষ্টি হয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'গত ৪ দশকে শাজাহান আলি বাদশা কৃষিকাজ করে শুধু নিজে আর্থিকভাবে সফল হয়েছেন তা নয়। পুরো এলাকার আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছেন। অভূতপূর্ব সাফল্যের কারণে তাকে কৃষিক্ষেত্রের সর্বোচ্চ জাতীয় সম্মান এআইপি পদকে ভূষিত করা হয়েছে। তিনি কৃষকদের গর্ব।'

শাজাহান আলি বাদশা বলেন, 'এক সময় কৃষিকাজ করার কারণে অনেকে আমার কাছ থেকে দূরে থাকতেন। এখন নিজেকে একজন কৃষক হিসেবে পরিচয় দিতে আমি গর্ববোধ করি।'

Comments