কৃষকই ভরসা

আবদুল হক গতকাল ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখেন হাড় হিম করা ঠাণ্ডা পড়েছে, ঘন কুয়াশায় ঢেকে রয়েছে চারপাশ। আর দশটি দিনের মতো এই আবহাওয়াতেও তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে পরেন মাঠের উদ্দেশে।
খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার তেঁতুলতলা বিলে থেকে সোনার ফসল হাতে এক কৃষকের হাসি। উপজেলা জুড়েই কৃষকরা এখন ফসল কাটতে ব্যস্ত। গতকাল শনিবার পর্যন্ত খুলনার ৯৩ হাজার ১৮৫ হেক্টর কৃষি জমিতে আমন ধানের অন্তত ৭০ শতাংশ কাটা হয়েছে। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

আবদুল হক গতকাল ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখেন হাড় হিম করা ঠাণ্ডা পড়েছে, ঘন কুয়াশায় ঢেকে রয়েছে চারপাশ। আর দশটি দিনের মতো এই আবহাওয়াতেও তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে পরেন মাঠের উদ্দেশে।

৪৬ বছর বয়সী এই কৃষক আমন ধান কাটতে বরিশালের বাকেরগঞ্জে নিজের খেতে যান।

গতকাল বিকালে ধান কেটে ফেরার পর দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কুয়াশা এতো বেশি, পাশের মানুষটার চেহারাও দেখা যায় না।'

বহু বছর ধরে প্রায় ৬ একর জমিতে আমন চাষ করছেন আবদুল। এই জমির একটি অংশ তিনি লিজ নিয়েছেন।

রোদ, ঝড়, বৃষ্টি—কোনোকিছুতেই তার কাজ বন্ধ থাকে না। উৎপাদিত ফসলের একটি অংশ তিনি পরিবারের জন্য রাখেন।

আবদুলের মতো সারা দেশের কৃষক ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাঠে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন খাদ্য উৎপাদনে। তাদের পরিশ্রমেই জাতির খাদ্য নিরাপত্তা তৈরি হয়।

চাষকৃত ফসলের ভালো দাম পাওয়ার, এমনকি নিজেদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের নিশ্চয়তা ছাড়াই তারা বছরের পর বছর কাজ করে যাচ্ছেন।

২০২২ সাল জুড়ে তারা খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনে মাঠে কাজ করে গেছেন। যার ফলশ্রুতিতে জাতিকে কেবলমাত্র বিশ্ব বাজারের ওপর নির্ভরতা থেকে মুক্ত রাখতে পেরেছে। করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্ব বাজারে সরবরাহ শৃঙ্খলে যেমন প্রভাব পরেছে, তেমনি দামও বেড়েছে কয়েক গুণ।

রপ্তানি ও রেমিট্যান্স কমে যাওয়া, ডলার সংকট, জ্বালানি ও সারের মূল্যবৃদ্ধিসহ বাংলাদেশের অর্থনীতি অগণিত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলেও খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে কৃষকের প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল।

বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ হানা দিলেও দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রচুর পরিমাণে আমনের ফলন হচ্ছে।

ফসল উৎপাদনের পরিমাণ নিয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব এখনো পাওয়া যায়নি। তবে, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) অনুমান করছে, ২০২২ সালে আমন ধানের উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৬৩ লাখ টন, যা একটি রেকর্ড।

গতকাল শনিবার ব্রির মহাপরিচালক মো. শাহজাহান কবির এক অনুষ্ঠানে বলেন, গত বছর দেশের কৃষক আমনসহ প্রায় ৩ কোটি ৯৭ লাখ টন বিভিন্ন জাতের ধান উৎপাদন করেছে। যা দৈনিক মাথাপিছু ৪০৫ গ্রাম হারে ২ কোটি ৫২ লাখ টন ধানের চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি।

তিনি বলেন, 'কিছু ত্রুটি বিবেচনায় নিলেও আগামী জুন পর্যন্ত দেশে চালের কোনো সংকট থাকবে না।'

এ ছাড়া, মার্কিন কৃষি বিভাগ বাংলাদেশে আমন ধানের উৎপাদন বৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে।

ডিসেম্বরের শুরুতে খাদ্য ও কৃষি সংস্থা পূর্বাভাস দিয়েছে, বাংলাদেশে ২০২২ সালে ৫ কোটি ৬৪ লাখ টন ধান কাটা হবে, যা আগের বছরের তুলনায় সামান্য কম কিন্তু ৫ বছরের গড় ৫ কোটি ৪৯ লাখ টনের চেয়ে বেশি।

জাতিসংঘের সংস্থাটি পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ২০২২ সালে বাংলাদেশে গম ও ভুট্টার বেশি উৎপাদন হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'জ্বালানি ও সারের উচ্চমূল্যের কারণে ২০২২ সাল কৃষকদের জন্য চ্যালেঞ্জিং ছিল। সেইসঙ্গে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ধান উৎপাদন নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছিল।'

তবে উদ্বেগ সত্ত্বেও ধানের উৎপাদন সন্তোষজনক ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, 'এর ক্রেডিট আমাদের কৃষকদের। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও তারা তাদের কাজ চালিয়ে গেছেন এবং এর ফলে দেশ খাদ্য সংকটে পড়েনি।'

তিনি আরও বলেন, 'সরকার ও কৃষি সংস্থাগুলোও সক্রিয়ভাবে কাজ করেছে এবং কৃষকের পাশে দাঁড়িয়েছে।'

কৃষকদের পরিশ্রমের ফলে সারা বছর জুড়ে সবজির উৎপাদন হয়েছে যথেষ্ট। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়সহ অন্যান্য অপ্রত্যাশিত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের পরেও ধান ও শাকসবজির ক্ষেত্রে দেশকে প্রায় স্বনির্ভর করে তুলেছেন এই কৃষকরা।

আবাদি জমির পরিমাণ কমে যাওয়া, সেচ ও সারের খরচ বৃদ্ধিসহ শত প্রতিকূলতার মধ্যেও কৃষক হাল ছাড়েননি।

২০২০ সালে যখন করোনা মহামারি বিশ্বকে স্থবির করে দিয়েছিল, বাংলাদেশও লকডাউন দিতে বাধ্য হয়েছিল, দেশের তথা বিশ্বের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পরেছিল, তখনো মাঠে ছিলেন কৃষক। জাতির মুখে খাবার তুলে দিতে করোনার ঝুঁকির মধ্যেও তারা নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন।

বর্তমানে কৃষক একই মাঠে বছরে ২টির বেশি ফসল ফলান।

২০২০ সালে বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ ধান উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছিল।

গত মার্চে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার একটি প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে বাংলাদেশ এগ্রিকালচার ইনফরমেশন সার্ভিস জানিয়েছে, সবজি উৎপাদনেও বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়।

ইউএসডিএ আরেকটি প্রতিবেদনে বলেছে, ভারত ও চীনের পর বাংলাদেশ মৎস্য উৎপাদনে তৃতীয় স্থানে রয়েছে।

তবে কৃষকের প্রভাব ও তাদের সাফল্য আরও বেশি।

এফএওর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টানা ১৮ বছরে বাংলাদেশে ফলের উৎপাদন গড়ে ১১ শতাংশ বেড়েছে।

কাঁঠাল উৎপাদনে বাংলাদেশ দ্বিতীয়, আম উৎপাদনে সপ্তম, পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম এবং পেঁপে উৎপাদনে ১৪তম।

ফল খাওয়ার পরিমাণও গত এক দশকে দ্বিগুণ বেড়েছে বাংলাদেশে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ জানান, গত ৫০ বছরে মাথাপিছু খাদ্যের প্রাপ্যতা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।

তিনি বলেন, 'খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে, কিন্তু বিপণন ব্যবস্থা প্রতিকূল হওয়ায় সাধারণ কৃষকের ভাগ্যের উন্নতি হয়নি। কৃষির জন্য খরচ বেশি এবং এর জন্য ব্যাংক ঋণও পাওয়া যাচ্ছে না।'

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা খুলনার বটিয়াঘাটার ক্ষুদ্র কৃষক বিভাস মণ্ডল জানান, স্থানীয় ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারণে তারা ধানের ভালো দাম পাচ্ছেন না।

তিনি বলেন, 'তারা (সিন্ডিকেট) স্থানীয় বাজারে দাম নির্ধারণ করে দেয়। ওই দামের বাইরে আমরা বিক্রি করতে পারি না।'

তিনি আরও বলেন, 'আমরা ঠিকমতো সেচের পানি পাই না। বেশিরভাগ জলাশয় থেকে হয় পানি নেওয়া যায় না আর না হয় অবৈধভাবে ভরাট করা হয়েছে।'

মৌসুমে বৃষ্টি না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত ডিজেলচালিত শ্যালো মেশিনের মাধ্যমে তার জমিতে সেচ দিয়েছে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করে।

তিনি বলেন, 'সেচের জন্য প্রতি একরে ১০ হাজার টাকা খরচ করতে হয়েছে। অথচ, এর আগের বছর খরচ হয়েছিল ৮ হাজার টাকা।'

অগ্নিপরীক্ষা এখানেই থেমে নেই।

সরকার প্রতি বস্তা সারের দাম ১ হাজার ১০০ টাকা নির্ধারণ করলেও কৃষককে এরচেয়ে বেশি খরচ করতে হয়েছে।

আগস্টের শুরুতে সরকার জ্বালানির দাম ৫১ শতাংশ এবং ইউরিয়ার দাম সাড়ে ৩৬ শতাংশ বাড়ানোর পর রাজশাহীর তানোরের লিয়াকত আলীকেও জমি তৈরি ও সেচের জন্য বাড়তি খরচ করতে হয়েছিল।

শ্রমিকের খরচও বেড়েছে জানিয়ে লিয়াকত বলেন, 'এক বস্তা ইউরিয়া সারের জন্য কমপক্ষে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বেশি দিতে হয়েছে। আমি এই মৌসুমে আলু চাষ করছি। সার ও সেচের জন্য যে বাড়তি খরচ করতে হয়েছে সেটা উঠাতে পারব বলে আশা করছি।'

তিনি আরও বলেন, 'ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে মাত্র এক বস্তা সার পাই। অথচ সার দরকার ৫ থেকে ১০ বস্তা। তখন খোলা বাজার থেকে চড়া দামে সার কিনতে বাধ্য হই।'

কীটনাশকের দামও বেড়েছে বলে জানান তিনি।

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের কৃষক আব্দুর রউফ জানান, গত বছরের তুলনায় এবার কৃষক আমনের দাম বেশি পেয়েছেন।

তিনি বলেন, 'উৎপাদন ব্যয় বেশি হওয়ায় চিন্তায় ছিলাম। কিন্তু দাম ভালো পেয়ে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে।'

আবদুল হক বরিশালের প্রত্যন্ত দুধল গ্রামে ফসল কেটে বাড়ি ফেরার পথে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমনের দাম বেড়ে যাওয়া আমাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে।'

তিনি আরও বলেন, 'দাম বেশি পেলে ডিজেলের জন্য যে বাড়তি খরচ হয়েছে এবং আরও অনেক কিছুর কারণে বাড়তি খরচ করতে হয়েছে তা অনেকটাই পুষিয়ে যাবে।'

খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার তেঁতুলতলা বিলে থেকে সোনার ফসল হাতে এক কৃষকের হাসি। উপজেলা জুড়েই কৃষকরা এখন ফসল কাটতে ব্যস্ত। গতকাল শনিবার পর্যন্ত খুলনার ৯৩ হাজার ১৮৫ হেক্টর কৃষি জমিতে আমন ধানের অন্তত ৭০ শতাংশ কাটা হয়েছে। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

Comments