ব্রয়লারের মাংস জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ না: কৃষি মন্ত্রণালয়

ব্রয়লার মুরগি। ছবি: সুমন আলী/ স্টার

উৎস নির্বিশেষে ব্রয়লার মুরগির মাংসে অ্যান্টিবায়োটিক ও ভারী ধাতুর অবশিষ্ট অংশের উপস্থিতি সর্বোচ্চ সহনশীল মাত্রার চেয়ে অনেক কম। ফলে ব্রয়লার মুরগির মাংস জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ না বলে জানিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়।

আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে সচিবালয়ে তথ্য অধিদপ্তরের সম্মেলনে কক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে একটি গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরে কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক এ তথ্য জানান।

কৃষিমন্ত্রী বলেন, বর্তমান সরকার দেশের সব মানুষের জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিসম্মত খাবার নিশ্চিত করতে প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। পুষ্টিসম্মত খাবার হলো মাছ, মাংস, দুধ, ডিম ও শাক-সবজি, ফল প্রভৃতি। এর মধ্যে ব্রয়লার মুরগির মাংস বাংলাদেশে সবচেয়ে সস্তা ও সহজলভ্য আমিষের উৎস। কিন্তু আমাদের দেশে মাথাপিছু মুরগির মাংস খাওয়ার পরিমাণ অন্যান্য দেশের তুলনায় খুবই কম। এর কারণ হলো, সব শ্রেণি-পেশার (উচ্চবিত্ত-নিম্নবিত্ত) মানুষের বদ্ধমূল ধারণা বাণিজ্যিকভিত্তিতে উৎপাদিত মুরগির মাংসে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর অ্যান্টিবায়োটিক ও ভারী ধাতু আছে; ফার্মের মুরগির মাংসের স্বাদ কম; উচ্চবিত্তরা মনে করেন, এটা গরিবের মাংস এবং মুরগির খাবারে ট্যানারির বর্জ্য ব্যবহার করা হয়।

তিনি বলেন, মুরগির খাবারে ট্যানারির বর্জ্য ব্যবহারের ধারণা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কেননা, দেশে বর্তমানে হাঁস-মুরগির খাবারের চাহিদার পরিমাণ ৯৫ লাখ টন। গবাদি পশুর ১৪৫ লাখ টনসহ মোট ২৪০ লাখ টন। অথচ মোট ট্যানারির বর্জ্য হয় মাত্র ৮৫ হাজার টন।

পরিসংখ্যান তুলে ধরে কৃষিমন্ত্রী বলেন, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, মাথাপিছু ব্রয়লার মাংস খাওয়ার দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে ইসরাইল (৭২ কেজি); দ্বিতীয় অবস্থানে ত্রিনিদাদ ও টোবাগো (৬৫ কেজি) এবং তৃতীয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (৫৮ কেজি)। বাংলাদেশে মাথাপিছু মুরগির মাংস খাওয়ার পরিমাণ মাত্র ২৭ কেজি। বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রি সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) তথ্য অনুসারে, বর্তমানে দেশের জিডিপিতে পোল্ট্রি খাতের অবদান ১ দশমিক ৫ থেকে ১ দশমিক ৬ শতাংশ। এ ছাড়া, এ খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৬০ লাখ লোক জড়িত। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে মোট প্রায় ২ লাখ ৫ হাজার ২৩১টি বাণিজ্যিক পোল্ট্রি খামার রয়েছে। এর মধ্যে নিবন্ধিত পোল্ট্রি খামার ৮৭ হাজার ২৭৩টি।

রাজ্জাক বলেন, ব্রয়লার মুরগির মাংস খাওয়া নিরাপদ কি না এ নিয়ে আমাদের অনেকের মধ্যেই ভ্রান্ত ধারণা বা দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক প্রচারণায় দেখা যায় যে, ব্রয়লার মাংসে অ্যান্টিবায়োটিক, হেভি মেটাল এবং অন্যান্য ক্ষতিকর পদার্থের উপস্থিতি রয়েছে। এ ধরনের বিভ্রান্তিমূলক তথ্যের ফলে সাধারণ জনগণের মধ্যে অনেক সময় ব্রয়লার মাংস সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা ছড়িয়ে পড়ে এবং জনগণ ব্রয়লার মাংস খাওয়া কমিয়ে দেয়।

ব্রয়লার মুরগির মাংস নিরাপদ কি না, তা জানতে গত বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত কৃষি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়ন ও উদ্যোগে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের অধীনে একটি গবেষণা করা হয়। এই গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রয়লার মুরগির মাংসে, হাড়ে, কম্পোজিটে (কলিজা, কিডনি ও গিজার্ডের সমন্বয়) এবং মুরগির খাদ্যে কী পরিমাণ অ্যান্টিবায়োটিক ও ভারী ধাতু আছে তা নির্ণয় করা, বলেন কৃষিমন্ত্রী।

আব্দুর রাজ্জাক
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে সচিবালয়ে তথ্য অধিদপ্তরের সম্মেলনে কক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক | ছবি: টেলিভিশন থেকে নেওয়া

তিনি জানান, গবেষণার জন্য ঢাকা, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও বরিশালের ব্রয়লার খামার এবং বাজার থেকে ব্রয়লারের মাংস, হাড়, কম্পোজিট ও ব্রয়লার খাদ্যের নমুনা এবং ঢাকার ৩টি সুপার শপ থেকে ব্রয়লার মুরগির নমুনা সংগ্রহ করা হয়। সংগৃহীত প্রায় ১ হাজার ২০০টি ব্রয়লার মুরগি এবং ৩০টি ব্রয়লার মুরগির খাদ্য থেকে ৩১৫টি নমুনা প্রস্তুত করে বহুল ব্যবহৃত ১০টি অ্যান্টিবায়োটিক এবং ৩টি ভারী ধাতুর অবশিষ্ট অংশের পরিমাণ পরীক্ষা করা হয়।

মোট ১০টির মধ্যে ৭টি অ্যান্টিবায়োটিক (এনরোফ্লক্সাসিন, সিপরোফ্লক্সাসিন, নিওমাইসিন, টাইলোসিন, কলিস্টিন, অ্যামোক্সাসিলিন এবং সালফাডায়াজিন) পরীক্ষণের জন্য নমুনাগুলো এসজিএস বাংলাদেশ লিমিটেডের মাধ্যমে ভারতের চেন্নাইয়ে এসজিএস ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়। বাকি ৩টি অ্যান্টিবায়োটিক (ক্লোরামফেনিকল, অক্সিটেট্রাসাইক্লিন ও ডক্সিসাইক্লিন) এবং ৩টি ভারী ধাতু (আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম ও লেড) পরীক্ষণের জন্য নমুনাগুলো প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অধীনে সাভারের আইএসও সার্টিফায়েড অ্যান্ড অ্যাক্রেডিটেড কোয়ালিটি কন্ট্রোল ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়, জানান কৃষিমন্ত্রী।
 
তিনি বলেন, গবেষণার ফলাফলে দেখা যায় যে, ব্রয়লার মুরগির মাংসে, হাড়ে এবং কম্পোজিটে মূলত দুটি অ্যান্টিবায়োটিক (অক্সিটেট্রাসাইক্লিন ও ডক্সিসাইক্লিন) এবং ৩টি হেভি মেটালের (আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম ও লেড) সামান্য উপস্থিতি রয়েছে, যা অস্বাভাবিক নয় এবং সর্বোচ্চ সহনশীল সীমার অনেক নিচে। খামার ও বাজারে প্রাপ্ত ব্রয়লার মাংসের চেয়ে সুপার শপের ব্রয়লার মাংসে অ্যান্টিবায়োটিক এবং হেভি মেটালের পরিমাণ কম রয়েছে।

গবেষণার ফলাফল তুলে ধরে কৃষিমন্ত্রী বলেন, ব্রয়লার মাংসে গড়ে পিপিবি অক্সিটেট্রাসাইক্লিন ৮ দশমিক শূন্য শতাংশ, ডক্সিসাইক্লিন ৯ দশমিক ১ শতাংশ, আর্সেনিক ৬ দশমিক ২, ক্রোমিয়াম ১৯০ দশমিক ৭ ও লেড ২৫৯ দশমিক ১ শতাংশ রয়েছে। সর্বোচ্চ সহনশীল সীমার চেয়ে যথাক্রমে যা ১২ দশমিক ৫ গুণ, ১০ দশমিক ৯ গুণ, ৬ দশমিক ৫ গুণ, ৫ দশমিক ২ গুণ ও ২৩ দশমিক ১ গুণ নিচে রয়েছে। 

ব্রয়লার মুরগির হাড়ে গড়ে ৫৩ দশমিক ৭ পিপিবি অক্সিটেট্রাসাইক্লিন, ডক্সিসাইক্লিন ২৭ দশমিক শূন্য, আর্সেনিক ৭ দশমিক ২, ক্রোমিয়াম ৪৩৯ দশমিক ৯ ও লেড ৪৬৪ দশমিক ৬ রয়েছে। সর্বোচ্চ সীমার চেয়ে যা যথাক্রমে ১ দশমিক ৮ গুণ, ৩ দশমিক ৭ গুণ, ৫ দশমিক ৫ গুণ, ২ দশমিক ২৭ গুণ ও ১২ দশমিক ৯ গুণ নিচে রয়েছে।

কম্পোজিটে গড়ে পিপিবি অক্সিটেট্রাসাইক্লিন ১৪ দশমিক ৫, ডক্সিসাইক্লিন ১৭ দশমিক ২, আর্সেনিক ১০ দশমিক ৯, ক্রোমিয়াম ২৩৯ দশমিক ২ ও ক্রোমিয়াম ৩০৭ দশমিক ৬ পিপিবি। এটি সর্বোচ্চ অবশিষ্ট সীমার চেয়ে যথাক্রমে ৬ দশমিক ৮ গুণ, ৫ দশমিক ৮ গুণ, ৩ দশমিক ৬ গুণ, ৪ দশমিক ১৮ গুণ ও ১৯ দশমিক ৫ গুণ নিচে।

ব্রয়লার মুরগির খাদ্যে গড়ে শূন্য দশমিক ৮ পিপিবি অক্সিটেট্রাসাইক্লিন, ডক্সিসাইক্লিন ১৯ দশমিক ২, টাইলোসিন ৪ দশমিক ১৯, আর্সেনিক ৭ দশমিক ৬, ক্রোমিয়াম ২ হাজার ১৫৩ দশমিক ৩ এবং লেড রয়েছে ৪৭৮ দশমিক ৬ পিপিবি। যা আর্সেনিকের ক্ষেত্রে ১৮৪ দশমিক ২ গুণ, ক্রোমিয়াম ৯ দশমিক ২ গুণ ও লেডের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অবশিষ্ট সীমার চেয়ে ২০ দশমিক ৮ গুণ নিচে রয়েছে বলে জানান তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

India, Pakistan agree to ceasefire

Announces Trump after rivals launch multiple attacks on key military installations; Islamabad, New Delhi confirm truce

2h ago