ব্রি-২৮ ধানে ব্লাস্ট রোগ, হাওরের কৃষকের মলিন ঈদ

হাকালুকি হাওরের কৃষক সামসুল ইসলামের পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৭। হাওরে বর্গা চাষ করা ধান বেচেই পরিবার চালাতে হয় তাকে।কিন্তু, তার চাষ করা ধানের খেতে দেখা দিয়েছে ব্লাস্ট রোগ।
ব্লাস্ট রোগে নষ্ট হয়ে যাওয়া ধানখেত দেখতে এসেছেন হাকালুকি হাওরের এক কৃষক। ছবি: স্টার

হাকালুকি হাওরের কৃষক সামসুল ইসলামের পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৭। হাওরে বর্গা চাষ করা ধান বেচেই পরিবার চালাতে হয় তাকে।কিন্তু, তার চাষ করা ধানের খেতে দেখা দিয়েছে ব্লাস্ট রোগ।

আজ শনিবার ঈদের দিন দ্য ডেইলি স্টারকে সামসুল ইসলাম বলেন, 'গাজী বীজ না পাওয়ায় বর্গা ৪ কিয়ার খেতে (১ কিয়ার প্রায় ৩০ শতক) ব্রি-২৮ ধান লাগাইছিলাম। প্রতি কিয়ারে ১৫-১৮ মন ধান পাইমু আশা আছিল। যখন ধান আসার কথা তখন বেমার লাগি গেছে। গাছ ভালা, পাতা ভালা, কিন্তু ধান জ্বইল্লা শেষ।'

ধানখেতে ব্লাস্ট রোগ দেখা দেওয়ায় অসহায় হয়ে পড়েছেন মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার মদনগৌরীর এই কৃষক। বলেন, 'হয়ত চিকিৎসা করলে ভালা অইতো। কিন্তু কৃষি বিভাগের লোক আইছে না। তারার অবহেলায় আমরা আরও শেষ অই গেছি। গেল বছরও এই অবস্থা আছিল।'

'মনে করছিলাম ঈদোর আগে ধান কাটিলিমু। ঈদটা বালা যাইব। কিন্তু এই ৪ কিয়ারে কাঁচি লাগানির পরিস্থিতি নাই। প্রতি কিয়ারে ৫-৬ হাজার টাকা খরচ হইছে। বড় বেকায়দায় পড়ি গেলাম। সারা বছর কিতা খাইতাম, চিন্তাত ঘুম লাগে না,' বলেন সামসুল।

আজও মনে দুঃখ নিয়ে ধানখেতে এসেছেন তিনি। কষ্ট পাচ্ছেন, তাও চেয়ে চেয়ে দেখছেন, কীভাবে তার কষ্টের ফসল নষ্ট হচ্ছে। তিনি বলেন, 'আজকে ঈদোর দিনেও আইছি আমার সোনার ধানটা দেখতে। বড় কষ্ট লাগে। কিন্তু কারে বিচার দিতাম। বড় অসহায় হই গেলাম। ধান দেখলেই চোখের জল চলি আই।'

ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত ধানের শীষ। ছবি: স্টার

কোরবানপুর এলাকার কৃষক মাখন মিয়াও প্রায় ১৬ কিয়ার বর্গাচাষের ১০ কিয়ার জমিতে ব্রি-২৮ জাতের ধান রোপণ করেছিলেন। ব্লাস্ট রোগে নষ্ট হয়েছে তার ধানও।

মাখন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সমিতি থেকে ঋণ এনে চাষ করছি। ভাবছিলাম ধানের ফলন অইলে সমিতিরে টাকা দিয়া দিমু। কিন্তু কপাল খারাপ। ধান সব চিটা অই গেছে। চিন্তা অইল কেমনে সমিতির টাকা দিমু। কৃষি বিভাগ একবারও আমরার খোঁজ নিছে না। তারা পরামর্শ দিলে আমরার উপকার অইলো নে।'

মদনগৌরীর কৃষক মো. সাতিরুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার জায়গা একদম পুকে খাইয়া লাইছে। কিতা থাকি এ অবস্থা অইছে আমরা বুঝতে পারছি না। হাওলাত আনছি। এখন এই ঋণ শোধ করমু কেমনে, আর ভাত খাইমু কেমনে। কৃষি বিভাগও কোনদিন আমরারে দেখতে আইছে না।'

'২৮-বীজ আমি নিতে চাইনি। কিন্তু জোর করে দিছে। নতুন নতুন যে ধান আসছে। এটা নিয়ে কোনো আলোচনাও নাই। কৃষি বিভাগ জোর করে এই ধানটা আমাদের দিছে। তাই এই ক্ষতির দায় তাদের,' বলেন তিনি।

মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া-বড়লেখা-জুড়ী উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত হাকালুকি হাওর, সদর উপজেলার কাউয়াদিঘি হাওর এবং শ্রীমঙ্গল উপজেলার হাইল হাওরের হাওরাঞ্চলে বোরো আবাদের ব্রি-২৮ ধানে আক্রমণ করেছে ব্লাস্ট রোগ। ফসলহানিতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকরা।

সরজমিনে হাইল হাওরাঞ্চলে গিয়ে দেখা যায়, মাঠের পর মাঠ ধানের শীষ বাতাসে দোল খাচ্ছে। কিন্তু ধান কাটার কোনো আগ্রহ নেই অধিকাংশ কৃষকের।

কৃষকরা জানান, কয়েকদিন আগে আকস্মিক ব্লাস্ট রোগ দেখা দেয়। মুহূর্তেই স্বপ্ন ফিকে হয়ে যায় তাদের। পুরো জমির ধান এখন চিটা। অনেকে কিছু ধান কেটেছেন গরুর খাদ্যের জন্য। বাকি ধান জমিতেই পড়ে আছে।

এই অভিযোগ এ হাওরের কৃষক নিমার আলী, বদরুল ইসলাম, মাখন মিয়া, সাহাব উদ্দিন, নাজিম উদ্দিন ও মহিবুল ইসলামের।

কৃষকরা বলছেন, সরকার সহায়তা না করলে তাদের পক্ষে আর চাষ করা সম্ভব হবে না। একইসঙ্গে ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও বর্গা চাষিদের আর্থিক সহায়তা না করলে পরিবার পরিজন নিয়ে তাদের না খেয়ে থাকতে হবে।

জানতে চাইলে মৌলভীবাজার জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শামছুদ্দিন আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'হাওরে ব্লাস্ট রোগে কিছু ধানের জমি নষ্ট হয়েছে। কৃষি বিভাগ কৃষকদের পাশে আছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা তৈরি করা শুরু হয়েছে।'

কৃষকদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'বিষয়টি মাথায় রেখে আগামীবার বীজ বিতরণ করা হবে। প্রত্যেক ইউনিয়নে একজন দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত থাকেন। একজনকে দিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সচেতনতা তৈরি করা সম্ভব নয়। তবু আমরা চেষ্টা করছি।'

Comments