বরগুনায় লবণাক্ত জমিতে বোরো আবাদে রেকর্ড ফলন

এ বছর বরগুনা জেলায় ৯ হাজার ৭৮ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হয়েছে।
বরগুনা, বোরো চাষ, লবণাক্ত জমি, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, ব্রি,
এ বছর বরগুনার ৯ হাজার ৭৮ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। ছবি: সোহরাব হোসেন/স্টার

বরগুনার উপকূলীয় ও লবণাক্ত জমিতে লবণ সহিষ্ণু জাতের বোরো আবাদে রেকর্ড ফলন হয়েছে। এ বছর জেলার ৯ হাজার ৭৮ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হয়েছে।

বরগুনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক বদরুল আলম জানান, এ বছর বরগুনা জেলায় ৯ হাজার ৭৮ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে- সদর উপজেলায় ৩ হাজার ১৫ হেক্টর, তালতলীতে ৩ হাজার হেক্টর, আমতলীতে ১ হাজার ৯০০ হেক্টর, বামনায় ৪৬০ হেক্টর, বেতাগীতে ৩৫৩ হেক্টর এবং পাথরঘাটায় ৩৫০ হেক্টরে।

গত বছর ৮ হাজার ২৭০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হলেও এ বছর ৮০৮ হেক্টর জমিতে বেশি বোরো আবাদ হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, 'আমন ফসল ওঠার পর এই এলাকার কৃষি জমিতে  ৮ থেকে ৯ পিপিটি মাত্রার লবণাক্ততা থাকে। কিন্তু, কয়েকটি লবণ সহিষ্ণু জাতের বোরো ধান এখানে প্রথমবারের মতো চাষ করা হয়েছে এবং প্রথমবারই রেকর্ড পরিমাণ ফলন পাওয়া গেছে। আমনের দ্বিগুণ ফলন পাওয়ায় কৃষকরাও খুশি।'

তিনি আরও বলেন, 'প্রণোদনার আওতায় প্রত্যেক কৃষককে ১০ কেজি করে বীজ, ২০ কেজি সার বিনামূল্যে দেওয়া হয়েছে।'

তিনি জানান, বরগুনা সদর উপজেলার চরগাছিয়া গ্রামের একটি মাঠের ২০০ বিঘা জমি প্রথমবারের মতো বোরো চাষের আওতায় আনা হয়েছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) উদ্ভাবিত নতুন জাতের বোরো ব্রিধান ৬৭, ৭৪, ৮৯, ৯২, ৯৯ ও বঙ্গবন্ধু ধান ১০০। সম্প্রতি সেখানে শস্য কর্তনে রেকর্ড ফলন পাওয়া গেছে। প্রতি বিঘা জমিতে ব্রিধান ৮৯ হয়েছে ৩৭ মণ, ব্রি ৬৭ হয়েছে ২৮ মণ, ব্রি৭৪ পাওয়া গেছে ২৮ মন, ব্রি৯৯ হয়েছে ২৮ মণ ও ব্রি ৯২ হয়েছে ৩৩ মণ।

শস্য কর্তন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মহাপরিচালক শাহজাহান কবীর বলেন, 'ধানের অবিশ্বাস্য ফলন হয়েছে। দেশের আর কোথাও বিঘাতে ৩৬ মণ ফলন পাওয়া যায়নি। অথচ উপকূলীয় এলাকার এসব জমি পতিত থাকে, যা আমাদের জন্য বিরাট ক্ষতির।'

বরগুনা সদর উপজেলার চরগাছিয়া গ্রামের কৃষক মাসুদ হাওলাদার (৪০) এবছর ৮০ শতাংশ জমিতে ব্রি ৭৪ জাতের বোরো ধান চাষ করেছেন। জমি চাষাবাদ, সেচ, সারসহ তার খরচ হয়েছে ৩১ হাজার টাকা। ওই জমিতে তিনি পেয়েছেন ১০০ মণ ধান। প্রতি মণ ধান এক হাজার টাকা করে তিনি ১ লাখ টাকার ধান উৎপাদন করেছেন। এতে তার লাভ  হয়েছ প্রায় ৭০ হাজার টাকা।

মাসুদ হাওলাদার বলেন, 'এই জমিতে লবণাক্ততার পরিমাণ এত বেশি ছিল যে, বছরে আমন ধান ছাড়া আর কোনো ফসল ফলাতে পারতাম না। কিন্তু, এবছর কৃষি অফিসের পরামর্শে বোরো ধান চাষ করে ভালো ফলন পেয়েছি।'

একই গ্রামের শাহজাহান ফকির (৪৫) জানান, তিনিও ৯০ শতাংশ জমিতে বোরো ধান চাষ করেছেন। এতে চাষাবাদ, সেচ, সার, ওষুধসহ মোট খরচ হয়েছে প্রায় ৩৪ হাজার টাকা। তিনি এ জমিতে ধান পেয়েছেন ১৩৫ মণ যার বাজার মূল্য প্রায় ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। তার লাভ হয়েছে প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার টাকা।

শাহজাহান ফকির বলেন, 'আমাদের জমিতে বছরে শুধুমাত্র একটি ফসল ফলাতে পারতাম। লবণাক্ততার কারণে জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত প্রায় ৭ মাস জম পতিত থাকত। কিন্তু, কৃষি অফিসের পরামর্শে এ বছর সেই লবণাক্ত জমিতে বোরো ধানের চাষ করে ভালো ফলন পেয়েছি।'

ওই গ্রামের আরেক কৃষক মাসুদ চৌধুরী (৪৫) ১ একর জমিতে ৩০ হাজার টাকা খরচ করে ব্রি ৮৯ জাতের বোরো ধান চাষ করে ১১০ মণ ধান পেয়েছেন। যার বাজার মূল্য ১ লাখ ১০ হাজার  টাকা। এতে তার ৮০ হাজার টাকা লাভ হয়েছে।

তিনি বলেন, 'আমাদের গ্রামের প্রায় ৩০০ কৃষক বোরো ধানের আবাদ করেছেন। এসব জমি লবণাক্ততার কারণে বছরের ৭-৮ মাস পতিত থাকত। এখন থেকে প্রতি বছর আমরা আরও জমিতে বোরো ধানের চাষ করব।'

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগ ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের যৌথ উদ্যোগে এবং উপকূলীয় শস্য নিবিড়িকরণ কর্মসূচির আওতায় এই গ্রামের ২০০ বিঘা (২৭ হেক্টর) জমিতে ব্রি ধান৬৭, ব্রি ধান৭৪, ব্রি ধান৮৯, ব্রি ধান৯২, ব্রি ধান৯৭ ও ব্রি ধান৯৯ জাতের ধান চাষ করা হয়েছে। ৩০০ জন কৃষককে বীজ, সেচ, সারসহ সব উপকরণ বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়েছে। খাল থেকে পানি এনে সেচ সুবিধা দেওয়া হয়েছে৷ প্রয়োজনীয় পরামর্শও দেওয়া হয়েছে।

উল্লেখ্য, দেশের প্রায় ২৫ শতাংশ এলাকা হচ্ছে উপকূলীয় এলাকা। বরিশাল অঞ্চলের বরগুনা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী ও বরিশাল জেলায় শুকনো মওসুমে অনেক জমি পতিত থাকে। লবণাক্ততার কারণে বেশিরভাগ এলাকায় সারা বছরে একটি ফসল হয়। আমন ধান তোলার পর বছরের বাকি সময়টা মাঠের পর মাঠ জমি পতিত পড়ে থাকে। এছাড়া, লবণ পানির ভয়াবহতার কারণে প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে উপকূলীয় এলাকায় ৫ লাখ হেক্টরের বেশি জমি অনাবাদী থেকে যায়। এর একটি কারণ হচ্ছে সেচ সুবিধার অভাব। যদিও এই অঞ্চলে বড় বড় নদী যেমন তেতুলিয়া, বলেশ্বর, বিষখালী, পায়রা, কীর্তনখোলাসহ বিভিন্ন নদীতে মিষ্টি পানির অনেক প্রাপ্যতা রয়েছে। সেজন্য, সেচ সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে পতিত জমিকে চাষের আওতায় আনার মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এবং বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে 'উপকূলীয় শস্য নিবিড়িকরণ' কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

এই কর্মসূচির মাধ্যমে বোরো ২০২২-২৩ মওসুমে বরিশাল অঞ্চলে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ বিঘা (৪৭০ হেক্টর) জমিতে ব্রি উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল; যেমন ব্রি ধান৭৪, ব্রি ধান৮৯ ও ব্রি ধান৯২ এবং লবনসহনশীল জাত যেমন ব্রি ধান৬৭, ব্রি ধান৯৭ ও ব্রি ধান৯৯ জাতের প্রদর্শনী স্থাপন করা হয়েছে।

Comments