বর্ষাতেও চৌচির বরেন্দ্র অঞ্চলে আমনের জমি

বৃষ্টি-নির্ভর আমন চাষে কৃষকদের এখন ভূগর্ভস্থ পানি দিয়ে সেচ দিতে হচ্ছে। এতে বাড়ছে উৎপাদন ব্যয়। অতিরিক্ত খরচ থেকে বাঁচতে অনেকে ধান রোপণ না করে বৃষ্টির অপেক্ষায় আছেন।
আমন
রাজশাহীর তানোর উপজেলার মন্ডুমালা মাহালী পাড়ায় বৃষ্টির অভাবে চৌচির আমনের খেত। ১ আগস্ট ২০২৩। ছবি: সংগৃহীত

এ বছর বৃষ্টিপাত তুলনামূলকভাবে অনেক কম হওয়ায় আমন চাষে দিশেহারা বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষক।

বৃষ্টি-নির্ভর আমন চাষে কৃষকদের এখন ভূগর্ভস্থ পানি দিয়ে সেচ দিতে হচ্ছে। এতে বাড়ছে উৎপাদন ব্যয়। অতিরিক্ত খরচ থেকে বাঁচতে অনেকে ধান রোপণ না করে বৃষ্টির অপেক্ষায় আছেন।

অন্যদিকে, সেচ দেওয়া যাচ্ছে না অনেক উঁচু জমিতে। এসব জমি ও বীজতলা শুকিয়ে যাচ্ছে। মাটি ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে।

রাজশাহী অঞ্চলের মোট ৯ লাখ ৪৭ হাজার ১৬৩ হেক্টর জমির প্রায় ৩৩ শতাংশ বরেন্দ্র অঞ্চল। এ অঞ্চলের ৫৩ শতাংশ এলাকা উচ্চ বরেন্দ্র ও ৪৭ শতাংশ সমতল।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বরেন্দ্র অঞ্চলে ৩৫ হাজার ৫৭০ হেক্টর কৃষিজমি আছে, যা বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল।

অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ডেইলি স্টারকে জানান, সাধারণত রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে গত জুলাইয়ে প্রায় ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।

চলতি মৌসুমে এ অঞ্চলে মাসিক গড় বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে ১৪০ মিলিমিটার। দিনাজপুর ও সিলেট অঞ্চলে তা ৮০০ মিলিমিটারের বেশি।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনি বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বরেন্দ্র অঞ্চলের বার্ষিক গড় বৃষ্টি জাতীয় গড়ের চেয়ে কম। জাতীয় গড় ২ হাজার ৫০০ মিলিমিটারের বিপরীতে এ অঞ্চলে সাধারণত প্রায় ১ হাজার ৩০০ মিমি বৃষ্টি হয়। চলতি বছর বৃষ্টি আরও কমে গিয়ে খরা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।'

আমন
রাজশাহীর তানোর উপজেলার মন্ডুমালা মাহালী পাড়ায় আমনের খেত। ১ আগস্ট ২০২৩। ছবি: সংগৃহীত

তিনি আরও বলেন, 'গত ২০ বছরে এই অঞ্চলের বৃষ্টি মাত্র ৩ বার ৩০০ মিলিমিটার ছাড়িয়েছে। বেশিরভাগ বছরে জুন, জুলাই ও আগস্টে ২০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি হয়নি।' 

এ অবস্থায় জমি অনাবাদী পড়ে আছে এবং জমিও শুকিয়ে যাচ্ছে।

নওগাঁর পোরশা উপজেলার কামারধা গ্রামের কৃষক আলমগীর হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জুনের শেষ সপ্তাহে বৃষ্টি হলে ৭ বিঘা জমির মধ্যে আড়াই বিঘায় আমন রোপণ করি। জুলাইয়ে বৃষ্টি কম হওয়ায় বাকি জমি অনাবাদী পড়ে আছে।'

'জমি উঁচু হওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানি পাওয়া যায় না। তাই আমার আর কিছুই করার নেই,' যোগ করেন তিনি।

কৃষক হাবিবুর রহমান জানান, তার বীজতলায় ধানের চারা বড় হয়ে যাচ্ছে। সময়মতো চারা রোপণ করতে না পারলে ফলন কমে যাবে। 

রাজশাহীর তানোর উপজেলার কলমা গ্রামের মতিউর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমন চাষের এখনো সময় আছে। আমি বৃষ্টির অপেক্ষা করছি। বৃষ্টির পানি দিয়ে চারা রোপণ করতে পারলে খরচ কম হবে।'

পানির অভাব দেখা দেওয়ায় গভীর নলকূপের সেচের দাম বেড়ে গেছে বলে জানান তিনি।

ওই এলাকার কৃষক নুরুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত বছর বিঘাপ্রতি সেচ খরচ ছিল ৩ হাজার ৫০০ টাকা। এ বছর পাম্প অপারেটররা বিঘাপ্রতি সেচের খরচ বাড়িয়ে ৪ হাজার টাকা করেছে। অনেকে টাকা দিয়েও সেচের পানি পাচ্ছেন না।'

উৎপাদন ব্যয় কমাতে অনেক কৃষক বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করছেন বলেও জানান তিনি।

নাচোলের কৃষক মতিউর রহমান বলেন, 'ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে ১৬ বিঘা জমিতে আমন রোপণ করেছি। পানির অভাবে ৫ বিঘা জমি অনাবাদী আছে।'

এ বছর রাজশাহী অঞ্চলের ৪ জেলায় ৪ লাখ ৫ হাজার ৯ হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ১৩ লাখ ৮১ হাজার ৫৮৮ মেট্রিক টন ধান পাওয়ার আশা করা হচ্ছে।

রাজশাহী অঞ্চলের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক শামসুল ওয়াদুদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে শুরু হয়ে অক্টোবর পর্যন্ত আমন চাষের সময় আছে। কাজেই, চাষের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অসুবিধা হবে না।'

শামসুল ওয়াদুদ আরও বলেন, 'আমন কয়েক বছর ধরেই এখন আর বৃষ্টিনির্ভর ফসল নয়। চলন বিলের নিম্নাঞ্চলেও এখন আমন চাষে সেচের প্রয়োজন হচ্ছে।'

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এ পর্যন্ত ২৫ শতাংশ ধান রোপণ হওয়ার তথ্য পেয়েছে বলে জানান তিনি।

জেলাভিত্তিক তথ্যে দেখা যায়, জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী জেলায় আমন আবাদ ৫০ শতাংশের বেশি হলেও নাটোর ও নওগাঁয় মাত্র ১৫ শতাংশ আমন আবাদ হয়েছে।

নাটোর ও নওগাঁ জেলায় আউশ ও পাটের আবাদ বেড়ে যাওয়ায় আমন রোপণে দেরি হচ্ছে। সেখানে কৃষকরা আউশ ধান ও পাট কাটার পর আমন রোপণ করবেন বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

Comments