দেশে তুলার চাহিদা ৮৫ লাখ বেল, উৎপাদন কেন ২ লাখ

মণপ্রতি উৎপাদন খরচ বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হলেও দাম বেড়েছে মাত্র ১০০ টাকা
লালমনিরহাট সদর উপজেলার জিরামপুর গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

আমদানি নির্ভরতা কমাতে দেশে বাড়ছে তুলার চাষ, তবে বাজারদর নিয়ে হতাশ চাষিরা। তারা জানান, বীজ, সার, ডিজেল ও কীটনাশকের দাম এবং কৃষি শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধিতে তুলা উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে।

গত বছর প্রতি মণ তুলা (আঁশ ও বীজ) বিক্রি হয়েছিল তিন হাজার ৮০০ টাকা দরে। এ বছর প্রতি মণ তুলার দাম বেড়েছে ১০০ টাকা। এতে উৎপাদিত তুলা বিক্রি করে আশানুরূপ লাভ করতে পারছেন না চাষিরা।

তারা জানান, প্রতি মণ তুলার দাম পাঁচ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হলে লাভবান হতে পারতেন।

তুলা চাষিরা দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, এ বছর প্রতি বিঘা জমিতে তুলা উৎপাদিত হয়েছে ১৪-১৬ মণ। এতে খরচ হয়েছে ১৬-২০ হাজার টাকা। গত বছর খরচ হয়েছিল ১১-১৪ হাজার টাকা।

তারা জানান, তুলা চাষের জন্য উঁচু জমির প্রয়োজন। সময় লাগে আট মাস (মধ্য জুলাই থেকে মধ্য মার্চ)। স্বল্পমেয়াদী জাতের তুলা চাষের সুযোগ পেলে তারা জমিতে অন্য ফসল উৎপাদনের সুযোগ পেতেন। এতে অনেকেই তুলা চাষে আগ্রহী হতো।

ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

তুলা উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, এ বছর রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলা লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, রংপুর ও নীলফামারীতে সাত হাজার চাষি দুই হাজার ৩৭৫ হেক্টর জমিতে তুলা চাষ করেছেন। গত বছর জমির পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৩৫২ হেক্টর।

এ বছর সারাদেশে ৪৬ হাজার হেক্টর জমিতে তুলা চাষ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে দুই লাখ ২৮ হাজার বেল (প্রতি বেলে ১৮২ কেজি)। গত বছর ৪৫ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে তুলা উৎপাদন হয়েছিল দুই লাখ ১০ হাজার বেল।  

দেশে প্রতি বছর তুলার চাহিদা রয়েছে প্রায় ৮৫ লাখ বেল। প্রতি বছর আমদানি করতে হয় প্রায় ৮৩ লাখ বেল। এতে খরচ হয় প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা।

চাষিদের উৎপাদিত প্রতি মণ তুলা থেকে আঁশ পাওয়া যায় ১২ কেজি আর বীজ ২৮ কেজি। বর্তমানে দেশের ১২টি স্পিনিং মিল চাষিদের কাছ থেকে উৎপাদিত তুলা কিনছে। তুলা বীজ থেকে উৎপন্ন হয় ভোজ্য তেল ও অয়েল কেক। দেশে চার জাতের তুলা- চরাঞ্চলের জন্য চর কটন, পাহাড়ের জন্য হিল কটন, সমতলের জন্য আপলাইন কটন ও বরেন্দ্র এলাকার জন্য ড্রাউট কটন চাষ হচ্ছে।  

লালমনিরহাট সদর উপজেলার চওড়াটারী গ্রামের তুলা চাষি মনজুর আহমেদ ডেইলি স্টারকে জানান, গত বছর থেকে তারা হাইব্রিড জাতের তুলা চাষ করছেন। দুই বছর আগে স্থানীয় জাতের তুলা চাষ করে কম ফলন পেয়েছিলেন।

তিনি বলেন, 'আমরা তুলার ফলন পাচ্ছি আশানুরূপ। কিন্তু বাজারদর নিয়ে হতাশ। প্রতি মণ তুলা পাঁচ হাজার টাকা দরে বিক্রি করতে পারলে প্রত্যাশিত লাভ পেতাম।'

'তুলা চাষে সময় লাগে আট মাস। এই সময়ে জমিতে দুই ধরনের ফসল উৎপন্ন করা যায়। বাজারদর বাড়াতে তুলা উন্নয়ন বোর্ড ব্যবস্থা নিলে আমরা উপকৃত হবো, বলেন এই চাষি।

একই উপজেলার জিরামপুর গ্রামের তুলা চাষি জুয়েল হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তুলা চাষ লাভজনক। খাদ্যশস্য উৎপাদনের প্রয়োজনীয়তা অধিক, তাই কম পরিমাণ জমিতে তুলা চাষ হচ্ছে। স্বল্পমেয়াদী জাতের তুলা চাষের সুযোগ পেলে চাষিরা আরও আগ্রহী হতেন।'

'৩-৪ মাসের মধ্যে তুলা উৎপাদন করতে পারলে জমিতে দুই ধরনের ফসল চাষ করতে পারতাম। বর্তমানে তুলা কর্তনের পর জমিতে এক ধরনের ফসল চাষ করতে পারছি', বলেন তিনি।

ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার ধরলা নদীর হকের চরের চাষি আকবর হোসেন ডেইলি স্টারকে জানান, গত তিন বছর ধরে তিনি চরাঞ্চলে তুলা চাষ করছেন, তবে বাজারদর কম হওয়ায় আশানুরূপ লাভ করতে পারছেন না।

'তুলা উন্নয়ন বোর্ড আমাদের বিনামূল্যে বীজ, সার ও কীটনাশক দিয়ে সহযোগিতা করছে। উৎপাদিত তুলা বিক্রি করতে বাজার ব্যবস্থার জন্য কোনো চিন্তা করতে হয় না। তবে তুলার বাজারদর নিয়ে আমাদের হতাশা রয়েছে', বলেন তিনি।

তুলা উন্নয়ন বোর্ডের কটন ইউনিট অফিসার রেজাউল করিম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তুলা চাষে কৃষকদের আগ্রহ বাড়ছে। তুলা চাষের জমিতে সাথী ফসল হিসেবে বিভিন্ন শাক-সবজি চাষের চর্চা শুরু হয়েছে। এতে সফলতাও পেয়েছেন কৃষকরা। বর্তমানে ৯০ শতাংশ কৃষকই হাইব্রিড জাতের তুলা চাষ করছেন। ১০ শতাংশ কৃষক স্থানীয় জাতের তুলা চাষ করছেন।'

'আমাদের উৎপাদিত তুলা আন্তর্জাতিক মানের। আমরা মাঠপর্যায়ে কৃষকদের তুলা চাষের পদ্ধতি শেখাচ্ছি', বলেন তিনি।

বগুড়ার তুলা ক্রেতা আব্দুল মান্নান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তুলা আমদানি নির্ভর শিল্পজাত পণ্য। আন্তর্জাতিক বাজারের দর অনুযায়ী দেশের চাষিদের কাছ থেকে তুলা কেনা হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে তুলার দর বাড়লে দেশের চাষিদের কাছ থেকে বেশি দরে কেনা হবে।'

'গত বছর চাষিদের কাছ থেকে প্রতি মণ তুলা কেনা হয়েছিল তিন হাজার ৮০০ টাকা দরে। এ বছর কেনা হচ্ছে তিন হাজার ৯০০ টাকায়। তুলা উন্নয়ন বোর্ড তুলার আন্তর্জাতিক বাজারদর মনিটর করে', বলেন তিনি।

তুলা উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী পরিচালক ড. ফখরে আলম ইবনে তাবিব ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দেশে তুলা চাষ সম্প্রসারিত করতে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। খাদ্যশস্য উৎপাদন যাতে ব্যাহত না হয়, এরকম জমি চিহ্নিত করা হয়েছে তুলা চাষের জন্য। তুলা চাষে কৃষকদের প্রণোদনা দিতে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এ বছরই সারাদেশে প্রশিক্ষিত ১২ হাজার ৩৭৫ কৃষকের মাঝে এ প্রণোদনা বিতরণ করা হবে।'

স্বল্পমেয়াদী জাতের তুলা চাষের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'তুলার বাজারদর নিয়ে স্পিনিং মিলের মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে।'

ড. ফখরে আলম বলেন, 'খাদ্যশস্য উৎপাদন ঠিক রেখে ২০৪০ সালের মধ্যে দুই লাখ হেক্টর জমি থেকে ১৫ লাখ ৮০ হাজার বেল তুলা উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে তুলা উন্নয়ন বোর্ডের।'

তিনি আরও বলেন, 'বস্ত্রশিল্পের অন্যতম কাঁচামাল তুলা। বস্ত্রশিল্প আমাদের দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। তুলা উৎপাদন বাড়লে আমদানি নির্ভরতা কমবে। এতে আমাদের দেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে। দেশে বর্তমানে চাহিদার মাত্র তিন শতাংশ তুলা উৎপন্ন হচ্ছে।'

Comments