মহাসড়কে ‘উল্লেখযোগ্য’ হারে বেড়েছে তৈরি পোশাক চুরি
তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এ প্লাস সোয়েটার লিমিটেড গত বছরের ২৯ অক্টোবর গাজীপুর কারখানা থেকে ৮টি কাভার্ডভ্যানে করে পোশাকের একটি চালান ব্রাজিলে পাঠানোর উদ্দেশে চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠায়।
পরের দিন ৮৯৮ কার্টন ভর্তি সোয়েটার চট্টগ্রামে পৌঁছায়। ক্রেতা-মনোনীত শিপিং প্রতিষ্ঠান এপিএল ১ লাখ ২৫ হাজার ডলারেরও বেশি মূল্যের চালানটি গ্রহণ করে ব্রাজিলে পাঠায়।
এ প্লাস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম তমিজ উদ্দিন ভূঁইয়া সেলিম দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে চালানবহনকারী জাহাজটি রওনা দেওয়ার পরই ব্রাজিলের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ড মিরসা পুরো অর্থ পরিশোধ করে।
তবে, দক্ষিণ আমেরিকার দেশটিতে চালানটি পাওয়ার পরপরই ৬ জানুয়ারি ব্রাজিলিয়ান ক্রেতার কাছ থেকে পাওয়া ভিডিও দেখে হতবাক হয়ে যান তমিজ উদ্দিন।
সম্প্রতি ডেইলি স্টারকে তমিজ উদ্দিন বলেন, 'ভিডিওতে দেখা গেছে যে, কিছু কার্টন সম্পূর্ণ খালি ছিল এবং অনেকগুলো কার্টন থেকে প্রচুর পরিমাণ পণ্য হারিয়ে গেছে।'
কখন, কোথায় এই চুরির ঘটনা ঘটেছে, তা জানতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তদন্ত করছে।
চট্টগ্রাম বন্দরে যাওয়ার পথে তৈরি পোশাক পণ্যের চালানে প্রায়ই যে চুরির ঘটনাগুলো ঘটছে, উপরের কাহিনিটি এর একটি উদাহরণ মাত্র। এর ফলে একদিকে রপ্তানিকারকদের যেমন আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে, অন্যদিকে তারা ক্রেতাদের বিশ্বাস ও অর্ডার হারানোর ঝুঁকিতে পড়ছেন।
চুরি রোধে ২০২১ সালের জুলাইয়ে একটি সভায় কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও এখনো সেগুলোর বাস্তবায়ন না হওয়ায় চুরি অব্যাহত রয়েছে। বৈঠকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর নেতারা অংশ নেন।
'সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তৈরি পোশাক পণ্যের চুরি উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু ভুক্তভোগী রপ্তানিকারকরা সবসময় এ ধরনের ঘটনা রিপোর্ট করেন না।'
এসব সিদ্ধান্তের মধ্যে রয়েছে কাভার্ডভ্যান ট্র্যাকিং, চুরি চক্রের সঙ্গে জড়িত চালক ও তাদের সহকারীদের পরিচয় যাচাই এবং চট্টগ্রামগামী মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন।
তৈরি পোশাকের এক রপ্তানিকারক জানান, ঢাকার ডেমরা, নারায়ণগঞ্জের মদনপুর, কুমিল্লা, ফেনী ও চট্টগ্রামের কয়েকটি বিচ্ছিন্ন স্থানে গাড়ি পার্ক করে চট্টগ্রাম বন্দরে যাওয়ার পথে কাভার্ডভ্যানচালক ও তাদের সহকারীরা।
'তারপরে তারা কাভার্ডভ্যানের দরজার সঙ্গে সংযুক্ত বোল্টের এক পাশ থেকে নাট খুলে দেয়, যাতে সিল করা প্যাডলকের ক্ষতি না করে এটি খোলা যায়। তারা প্রতিটি কার্টন থেকে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পণ্য চুরি করে পরবর্তীতে ঝুট ও বালি দিয়ে সেগুলো পূরণ করে আবার কার্টনগুলো সিল করে দেয়। বোল্টের নাটগুলো আবার লাগিয়ে দেওয়া হয়', বলেন তিনি।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মহাসড়কে এখনো সিসিটিভি বসানো হয়নি।'
বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে দেশ থেকে ৪২ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে।
বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর নেতা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, গত কয়েক বছরে তৈরি পোশাক পণ্যের চুরি উল্লেখযোগ্যহারে বেড়েছে। তবে চুরির সঠিক সংখ্যা কোনো সংগঠন বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছেই নেই।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) এক কর্মকর্তা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ নেতারা আমাদের জানিয়েছেন, গত বছর তৈরি পোশাক চুরির অন্তত ৩০টি ঘটনা ঘটেছে।' তবে প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই র্যাব কর্মকর্তা।
বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে মহাসড়কে ২টি, ২০২০ সালে ৯টি এবং ২০২১ সালের জুলাই পর্যন্ত পোশাক চুরির অন্তত ২২টি ঘটনা ঘটেছে।
গত ২৩ ডিসেম্বর ঢাকার ডেমরায় একটি পরিত্যক্ত কারখানায় অভিযান চালিয়ে ৬ কোটি টাকা মূল্যের চোরাই তৈরি পোশাক ও একটি কাভার্ডভ্যান জব্দ করে চক্রের প্রধান তৌহিদুল ইসলামসহ ৭ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-৪।
র্যাব কর্মকর্তারা জানান, তৌহিদুল ১০ বছর আগে ফুটপাতে কাপড় বিক্রি করতেন। পরবর্তীতে তিনি একটি চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন এবং ৩ বছরে কোটিপতি হয়ে উঠেন। বর্তমানে ঢাকায় তার একটি বাড়ি ও একটি দামি গাড়ি রয়েছে।
গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর কুমিল্লায় আন্তঃজেলা তৈরি পোশাক চোর চক্রের ৪ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। তাদের কাছ থেকে প্রায় ৪ কোটি টাকা মূল্যের চোরাই পোশাক পণ্য উদ্ধার ও একটি কাভার্ডভ্যান জব্দ করা হয়।
র্যাব-৪ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলাম জানান, ৭টি অভিযানে প্রায় ৩০ কোটি টাকা মূল্যের চোরাই গার্মেন্টস পণ্য উদ্ধার করা হয়েছে।
বিজিএমইএর পরিচালক রাজিব চৌধুরী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তৈরি পোশাক পণ্যের চুরি উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু ভুক্তভোগী রপ্তানিকারকরা সবসময় এ ধরনের ঘটনা রিপোর্ট করেন না।'
বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, 'তৈরি পোশাক পণ্যের চুরি বৃদ্ধির কারণ এ ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িতরা মামলা দায়েরের পর সহজেই জামিন পাচ্ছে। ফলে জেল থেকে বের হওয়ার পর তারা আবার চুরির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে।'
তৈরি পোশাক চুরির মামলা বিশেষ ক্ষমতা আইনে নথিভুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন রপ্তানিকারকরা। কারণ এই অপরাধ বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে এবং তৈরি পোশাক খাতকে ঝুঁকিতে ফেলছে।
রাজিব চৌধুরীর মতে, রপ্তানিকারকদের উচিত বোল্টের নাট ঢালাই করে দেওয়া।
Comments