চেয়ারম্যান বাবুর ছেলে রিফাত সাংবাদিক নাদিমের মাথায় ইট দিয়ে আঘাত করে: প্রত্যক্ষদর্শী

এ হত্যাকাণ্ড সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল আলম বাবুর নির্দেশে হয়েছে বলে দাবি নিহতের পরিবার ও স্থানীয় সাংবাদিকদের।
গত মঙ্গলবার রাতে বকশীগঞ্জ বাজার সংলগ্ন পাটহাটি এলাকায় নাদিমের ওপর হামলার ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ। ছবি: সংগৃহীত

জামালপুরের বকশীগঞ্জে গত বুধবার রাতে সাংবাদিক গোলাম রব্বানি নাদিমের ওপর হামলার সময় স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মাহমুদ আলম বাবুর ছেলে রিফাত ইট দিয়ে তার মাথায় আঘাত করেন বলে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সাংবাদিক মুজাহিদ বাবু জানিয়েছেন।

স্থানীয় সাংবাদিক মুজাহিদ বাবু আজ শুক্রবার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বকশীগঞ্জ বাজার থেকে আমি ও নাদিম বুধবার রাত ১০টার দিকে মোটরসাইকেলে বাড়ির দিকে যাচ্ছিলাম। আমরা কলেজের কাছাকাছি এলে নাদিমকে পেছন থেকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মোটরসাইকেল থেকে ফেলে দেওয়া হয়। সেখানে ১০-১২ জন সড়ক থেকে তাকে মারধর করতে করতে টেনে-হিঁচড়ে এক অন্ধকার গলিতে নিয়ে যান।'

মুজাহিদ বলেন, 'সেখানে একটি ইটের দেওয়াল ছিল। দেওয়ালের পেছনে চেয়ারম্যান বাবু দাঁড়িয়েছিলেন। আর তার ছেলে রিফাত সেই ইটের দেয়াল লাথি দিয়ে ভেঙে একটি ইট হাতে নেন এবং সেই ইট দিয়ে নাদিমের মাথায় আঘাত করেন।'  

মুজাহিদ আরও বলেন, 'প্রথমে আমি আটকাতে গেলে চেয়ারম্যানের ছেলে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে যে আমি এগিয়ে গেলে আমাকেও হত্যা করা হবে। ওদের লোক বেশি দেখে আমি আর এগিয়ে যাইনি।'

এ হত্যাকাণ্ড সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল আলম বাবুর নির্দেশে হয়েছে বলে দাবি নিহতের পরিবার ও স্থানীয় সাংবাদিকদের।

তারা বলছেন, সংবাদ প্রকাশের জেরে নাদিমকে হত্যা করা হয়েছে। 

বাবু চেয়ারম্যান গোপনে এক নারীকে বিয়ে করার সংবাদ প্রকাশের পর গত ১৭ মে নাদিম ও আরেক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন বাবু।

ময়মনসিংহ সাইবার ট্রাইব্যুনাল ৩০ মে মামলাটি খারিজ করে দেন। 

নাদিমের স্ত্রী মনিরা বেগম অভিযোগ করে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সংবাদ প্রকাশকে কেন্দ্র করে বাবু চেয়ারম্যান আমার স্বামীর ওপর ক্ষিপ্ত ছিলেন।'

চেয়ারম্যানের করা মামলা খারিজ হওয়ায় তার নেতৃত্বেই হামলা করে নাদিমকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি তার।

গত বুধবার রাতে বকশীগঞ্জ বাজারের পাটহাটি এলাকায় হামলার শিকার হন বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জামালপুর জেলা প্রতিনিধি নাদিম। পরদিন বৃহস্পতিবার দুপুরে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।

ইউপি চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবুর নির্দেশে নাদিমকে হত্যা করা হয়েছে বলে জামালপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি হাফিজ রায়হানের দাবি।

পুলিশ জানিয়েছে, সিসিটিভি ফুটেজ দেখে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত ৬ জনকে আটক করা হয়েছে। ফুটেজ দেখে চেয়ারম্যান বাবুর বোনের ছেলে রেজাউল ও বকশীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের উপদপ্তর সম্পাদক রাকিবুল্লাহ রাকিবসহ মনির, রিফাত ও সাইদকে চেনা গেছে। তাদের আটক করা হয়েছে।

এর আগে, এপ্রিল মাসে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহীনা বেগমের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দলীয় বিশৃঙ্খলা নিয়ে প্রতিবেদন করায় সাংবাদিক নাদিমের ওপর হামলা হয়েছিল।

বাবু চেয়ারম্যান উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহীনা বেগমের ঘনিষ্ঠ বলে স্থানীয়রা জানান।

স্থানীয়দের অভিযোগ, দলীয় প্রভাব খাটিয়ে বাবু চেয়ারম্যান এলাকায় মাদক চোরাকারবারি, চাঁদাবাজি, দালালিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।

সাধুরপাড়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাবু চেয়ারম্যান পেশায় ছিলেন কাঠমিস্ত্রি। অন্যায় অপকর্মের রোজগারে তিনি এখন কোটিপতি। এলাকায় অনেক জায়গা-জমির মালিক হয়েছেন। ঢাকায়ও বাড়ি আছে তার।'  

তিনি আরও বলেন, 'চাচাতো ভাই পুলিশের সাবেক এক এআইজির ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করেছেন বাবু। ভাইয়ের মাধ্যমে চাকরি পাইয়ে দিয়ে ও মাদক চোরাকারবারি করে কোটি কোটি টাকা বানিয়েছেন তিনি।'

বাবু চেয়ারম্যান তার সহযোগীদের মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেও অর্থের মালিক হয়েছেন বলে দাবি করেন তিনি।

নিহত সাংবাদিক নাদিমের মামাত ভাই লালন মিয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাবু চেয়ারম্যান আগে কাঠমিস্ত্রির কাজ করতেন। পরে মুদি দোকান চালাতেন। এরপর তিনি মাদক চোরাকারবারি ও ডলার ব্যবসার মাধ্যমে কোটিপতি হয়েছেন।'

তার দাবি, বাবু চেয়ারম্যান আগে বিএনপি করতেন। পরে টাকা পয়সা হয়ে গেলে আওয়ামী লীগে ঢুকে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। পরে দলের টিকিটে ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

বাবু চেয়ারম্যান পলাতক থাকায় এসব অভিযোগের বিষয়ে তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। তার মোবাইল ফোনও বন্ধ পাওয়া গেছে।

তার দলীয় প্রভাব খাটানোর বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহীনা বেগম তা অস্বীকার করে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাবু চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ ওঠায় তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা প্রক্রিয়াধীন আছে।' 

বাবু চেয়ারম্যানকে পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগের বিষয়ে পুলিশের সাবেক এআইজি মোখলেছুর রহমান পান্নাকে আজ শুক্রবার বিকেলে অন্তত ৬ বার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। মেসেজ পাঠালেও তার জবাব দেননি। তার পরিবারের কোনো সদস্যের সঙ্গেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

বাবু চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বকশীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ সোহেল রানা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মাহমুদুল আলম বাবু চেয়ারম্যান মাদক চোরাকারবারি কিংবা অন্য কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত কি না, আমাদের জানা নেই। তদন্ত করে দেখছি।' 

পুলিশের সাবেক এআইজির সঙ্গে বাবু চেয়ারম্যানের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি বলেন, 'বিষয়টি আমাদের জানা নেই।' 

হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আজ শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি বলেন, 'নাদিমের পরিবারকে দ্রুত মামলা করতে বলেছি। এসপিসহ আমরা তাদের বাড়িতে গিয়েছি। আমরা তাদের বলেছি যে আজ রাতের মধ্যেই তারা যেন মামলা করে।'

এ বিষয়ে জানতে জামালপুরের পুলিশ সুপার নাসির উদ্দিন আহম্মেদকে কয়েকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। 

জানতে চাইলে জামালপুরের এএসপি (দেওয়ানগঞ্জ সার্কেল) সুমন কান্তি চৌধুরী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সাংবাদিক নাদিম হত্যাকাণ্ডের আসামিদের গ্রেপ্তারে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি। আসামি যেই হোক না কেন, আমরা তাকে গ্রেপ্তার করব।'

Comments

The Daily Star  | English

Unrest emerges as a new threat to RMG recovery

The number of apparel work orders received by Bangladeshi companies from international retailers and brands for the autumn and winter seasons of 2025 dropped by nearly 10 percent compared to the past due to major shocks from the nationwide student movement and labour unrest in major industrial belts over the past two and half months.

9h ago