‘মাইকে ঘোষণা দিয়ে’ মিলনকে পিটিয়ে হত্যা পুরোনো দ্বন্দ্বের জেরে, দাবি পরিবারের

নিহতের পরিবারের লোকজনের অভিযোগ, স্থানীয় প্রভাবশালী একটি পরিবারের সঙ্গে পুরোনো দ্বন্দ্বের জেরে মিলনকে হত্যা করে ‘গণপিটুনির’ নাটক সাজানো হয়েছে।
সিদ্ধিরগঞ্জের আটিগ্রামে মাইকে ঘোষণা দিয়ে এলাকাবাসী জড়ো হয়ে যুবককে পিটিয়ে হত্যা করে। ছবি: সংগৃহীত

'আমার পোলাডারে মাইরা শরীলো কিচ্ছু রাখে নাই। হাত-পায়ের রগটি কাইট্টা ফেলছে। আমার পোলা খারাপ মানলাম, তাই বইলা তারে মাইরা ফেলব? এইটা কি আইনে আছে?'

কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন ৬০ বছর বয়সী বৃদ্ধা সহিতুন নেছা। গত সোমবার দুপুরে দুর্বৃত্তরা তার ছোট ছেলে মো. মিলনকে হত্যা করে। তার দুই হাত ও পা ভাঙা এবং সারা শরীরে ছিল ধারাল অস্ত্রের আঘাত ও জখমের চিহ্ন।

স্থানীয় এলাকাবাসীর অনেকের দাবি, গণপিটুনিতে 'সন্ত্রাসী' মিলনের মৃত্যু হয়েছে।

কিন্তু নিহতের পরিবারের লোকজনের অভিযোগ, স্থানীয় প্রভাবশালী একটি পরিবারের সঙ্গে পুরোনো দ্বন্দ্বের জেরে মিলনকে হত্যা করে 'গণপিটুনির' নাটক সাজানো হয়েছে।

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের আটিগ্রাম এলাকায় স্ত্রী ও এক বছর বয়সী সন্তানকে নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকতেন মো. মিলন। ৩৬ বছর বয়সী এই যুবকের বিরুদ্ধে ডাকাতি ও সন্ত্রাসবিরোধী আইনসহ সাতটি মামলা ছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ।

তার বিরুদ্ধে চুরি, ছিনতাইসহ সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ স্থানীয় এলাকাবাসীরও।

সেদিনের ঘটনার পর 'গণপিটুনিতে' মিলনের মৃত্যুর খবর সামনে এলেও, প্রত্যক্ষদর্শী, পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে গত দুই দিনের অনুসন্ধানে ভিন্ন তথ্য পাওয়া গেছে।

জানা গেছে, মিলনের সঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দা মো. শাহজাহান ও তার পরিবারের লোকজনের দ্বন্দ্ব ছিল। বছরখানেক আগে মিলন ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগে থানায় মামলাও করেছিলেন শাহজাহান। ওই মামলায় গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন মিলন।

স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত এক সময়ের দুবাইপ্রবাসী শাহজাহান এলাকায় 'দুবাই শাহজাহান' বলে বেশি পরিচিত। মিলনকে হত্যার ঘটনা শাহজাহানের বাড়ির সামনেই ঘটেছে এবং এই ঘটনার সঙ্গে শাহজাহান ও তার ভাইদের সরাসরি সম্পৃক্ততার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

পিটিয়ে হত্যার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী দুজন পুরুষ ও এক নারীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।

দ্য ডেইলি স্টারকে তারা বলেন, 'ঘটনাটি ঘটেছে জোহরের নামাজের কিছুক্ষণ পর। দুপুর বেলা একটি মোটরসাইকেলে এলাকায় ঢোকেন মিলন। মোটরসাইকেলে আরও দুজন ছিলেন। শাহজাহানের বাড়ির সামনে তার সঙ্গে তর্কবিতর্ক হয় মিলন ও তার সঙ্গীদের। একপর্যায়ে শাহজাহান তার ভাইদের ডেকে এনে মিলন ও তার সহযোগীদের মারধর করেন।'

'মারধরের একপর্যায়ে দুজন পালিয়ে যেতে পারলেও, মিলনকে তারা আটকে ফেলেন। তখন ঘটনাস্থলে শাহজাহান ও তার ভাইরা ছাড়াও স্থানীয় ১০-১২ জন ছিল,' বলেন তারা।

প্রত্যক্ষদর্শীরা আরও বলেন, 'পরে মসজিদের মাইকে "দুবাই শাহজাহানের বাড়িতে ডাকাত পড়েছে" ঘোষণা করলে শতাধিক মানুষ সেখানে জড়ো হয় এবং তাদের পিটুনিতে ঘটনাস্থলেই মারা যান মিলন।'

ঘটনার সময় সন্তানকে স্কুল থেকে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছিলেন ৩৫ বছর বয়সী এক নারী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তিনজনরেই প্রথমে অনেক মাইর দেয়। সুযোগ পেয়ে দুজন পলাইয়া গেলেও মিলন আটকা পড়ে। মাইকে ডাকাত ঢুকছে অ্যানাউন্স হইলে আরও সবাই জড়ো হয়।'

পুলিশের তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রও 'শুরুতে শাহজাহান ও তার পরিবারের লোকজনের মারধরের' বিষয়টি দ্য ডেইলি স্টারকে নিশ্চিত করেছে।

জানতে চাইলে মঙ্গলবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এস এম জহিরুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরাঘটনাটি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছি। সবগুলো বিষয়ই আমরা ক্রসচেক করে দেখছি। ঘটনার সঙ্গে পুরোনো কোনো দ্বন্দ্ব প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে কি না, তাও খতিয়ে দেখছে পুলিশ। কেউ সন্ত্রাসী হলেও তাকে মারধর করে হত্যার কোনো সুযোগ নেই।'

ঘটনার সময় মিলনের সঙ্গে ছিলেন জোনায়েত হোসেন জনি (৩৪)। ঘটনাস্থলের কাছেই তার বাড়ি। মঙ্গলবার তার বাড়িতে গিয়ে তাকে গুরুতর আহত অবস্থায় পাওয়া যায়।

দ্য ডেইলি স্টারকে জনি জানান, তাকে কুপিয়ে আহত করেছে শাহজাহান ও তার ভাইয়েরা। তিনি কোনোমতে প্রাণ নিয়ে দৌড়ে পালাতে পেরেছেন। এ সময় তার মোবাইল ও মানিব্যাগ খোয়া যায়।

জনি বলেন, 'আমি পালিয়ে যাওয়ারও অন্তত ২০ মিনিট পর মাইকে ডাকাত পড়ার ঘোষণা হয়। এরপর মিলনের সঙ্গে কী হইছে আমি জানি না।'

মিলনের পরিবারের লোকজন ও স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা জানায়, মিলনের সঙ্গে এক সময় সখ্যতা ছিল শাহজাহানের। স্থানীয় মনোয়ার জুট মিলের যন্ত্রপাতি চুরি করে তা বিক্রির ভাগ শাহজাহানকে দিতেন মিলন।

কিন্তু বছরখানেক আগে শাহজাহানের বাড়ির নির্মাণসামগ্রী চুরির ঘটনায় মিলনের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠলে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়।

অবশ্য এ বিষয়টি অস্বীকার করেন শাহজাহানের পরিবারের লোকজন। গতকাল মঙ্গলবার শাহজাহানের বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি।

তার স্ত্রী আবিদা খাতুনের দাবি, তাদের বাড়িতে চুরির ঘটনায় মিলনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছিল। কিন্তু মিলনের মৃত্যুর ঘটনায় তার স্বামী বা পরিবারের কেউ জড়িত নয়।

মিলনের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিলেন স্থানীয় অনেক বাসিন্দাই। তাদের ভাষ্য, এলাকায় প্রায়ই চুরির ঘটনা ঘটে। মিলন ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে এসব ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ উঠত। ভয়ে অনেকেই তাদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করত না।

এসব নিয়ে মিলন ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত ছিলেন স্থানীয়রা।

মিলন ও তার সহযোগীদের হাতে ঘটনার দিন ধারালো অস্ত্র ছিল বলে স্থানীয়রা দাবি করলেও, পুলিশের জব্দ তালিকায় এমন কিছু ছিল না।

ঘটনাস্থলে যাওয়া সিদ্ধিরগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মোখলেসুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে মিলনকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্রের জখম ও হাত-পা ভাঙা অবস্থায় পাওয়া যায়। তবে ঘটনাস্থলে কোনো অস্ত্র পাওয়া যায়নি।'

এদিকে, মিলন হত্যার আগের রাতে তার দুই সহযোগী উজ্জ্বল আহমেদ (২৬) ও মো. হৃদয়কে (২৩) পিটিয়ে জখম করে পুলিশের হাতে তুলে দেয় স্থানীয়রা।

পরে তাদের দুজনকে পুরোনো একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠায় সিদ্ধিরগঞ্জ থানা পুলিশ।

হত্যার বিচার চান স্বজনরা

ময়নাতদন্ত ও আইনানুগ কার্যক্রম শেষে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সিদ্ধিরগঞ্জ পুল এলাকায় স্থানীয় একটি কবরস্থানে দাফন করা হয় মিলনের মরদেহ। কবরস্থানে নারীদের প্রবেশের রীতি নেই, তাই বাইরের সড়কে বসেছিলেন মিলনের বৃদ্ধা মা সহিতুন নেছা। পাশে শাশুড়ি খোদেজা বেগমের কোলে মিলনের এক বছর বয়সী কন্যা সন্তান মরিয়ম। তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা মিলনের স্ত্রী রহিমা বেগম অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন অদূরে ভ্যানগাড়িতে প্যাকেটবন্দি স্বামীর মরদেহের দিকে।

সহিতুন নেছার তিন ছেলের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন মিলন। ছেলের মৃত্যুর খবর পেয়ে চাঁদপুর থেকে নারায়ণগঞ্জে ছুটে এসেছেন তিনি। ছেলের কথা তুলতেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন এই বৃদ্ধা।

তিনি বলেন, 'আমার পোলাডায় খারাপ আছিল মানলাম। কিন্তু তারে তো ধইরা পুলিশে দিতো পারত। জেলে পঁইচা মরত। দুই মাস পর হইলেও, জেলে গিয়া তো চেহারাডা দেখতে পারতাম। তারে এমনে কেন মারল? কিচ্ছু রাহে নাই গো বাজানডার শরীলো।'

মিলনের মৃত্যুর ঘটনায় সোমবার রাতেই সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা হয়। ওই মামলার বাদী হন সহিতুন নেছা। মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে।

মিলনকে যেখানে হত্যা করা হয় তার পাশেই একটি বাসায় ভাড়া থাকেন মিলনের বড়ভাই মো. শরীফ। পেশায় ড্রেজার শ্রমিক শরীফ ঘটনার সময় ছিলেন কর্মস্থলে।

দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'আমি নিজে ওই এলাকায় থাকি। আমরা খোঁজখবর নিয়া জানছি, পুরোনো ঝগড়ার জেরে আমার ভাইডারে পিটাইয়া, কোপাইয়া মারছে শাহজাহান ও তার ভাইরা। তাগো লগেই প্রথমে ঝগড়াটা হইছে, তারপর এলাকাবাসীও নাকি মারছে। আমরা এত কইলাম কিন্তু পুলিশ আসামির তালিকায় কারও নাম দিলো না। পুলিশ কয়, আপনারা তো কাউকে দেখেন নাই মারতে।'

এই বিষয়ে জানতে চাইলে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু বকর সিদ্দিক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাদীপক্ষের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে হত্যা মামলা হয়েছে। এই ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন, তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে। পুলিশ মামলাটি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছে।'

তবে ঘটনার তিন দিন পেরিয়ে গেলেও এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।

এদিকে, পুলিশ স্থানীয় প্রভাবশালী লোকজনের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছেন অভিযোগ করে মিলনের শ্বশুর নজিবুল হক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'একজন লোক সন্ত্রাসী, চোর, ডাকাত—সবই তো মানলাম। কিন্তু তারে তো খুন করা হইছে। কারা খুন করল সেটা তো বাইর করা পুলিশের কাজ। কিন্তু পুলিশ তো তিন দিনেও কাউকে চিহ্নিত করতে পারল না। আমরা থানা পুলিশের কাছে নাম বললেও, তারা লিখল না। থানায় সুষ্ঠু তদন্ত না পাইলে আমরা কোর্টে যামু। এই খুনের বিচার আমরা চাই।'

Comments