মালয়েশিয়ায় পাচার: বন-জঙ্গল, খাল দিয়ে হাঁটিয়ে নেওয়া হয় ভুক্তভোগীদের

ঢাকার এক দালাল রাসেল মিয়াকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তাকে মালয়েশিয়ায় নিয়ে যাবেন আর একটি নির্মাণ সাইটে কাজ পাইয়ে দেবেন।

ভিয়েতনাম হয়ে মালয়েশিয়ায় নিয়ে যাওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয় রাসেলকে। দালালের কথায় আশ্বস্ত হয়ে মাদারীপুরের শিবচরের ৩০ বছর বয়সী ওই যুবক ঢাকার একটি ট্রাভেল এজেন্সির মালিক দালাল রফিক খাঁর সঙ্গে ৪ লাখ টাকায় চুক্তি করেন।

গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উড়োজাহাজে ওঠেন রাসেল। তিন দিন পর তিনি তার স্ত্রী শাহিদা আক্তারকে ফোনে জানান, তিনি থাইল্যান্ডে আটক।

'আমাদের কম্বোডিয়ায় যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। সেখানে গভীর জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটে এবং কাঁধ সমান পানি খালের মধ্য দিয়ে হেঁটে আমরা থাইল্যান্ডে ঢুকি।

গত ২০ ডিসেম্বর থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ সংখলায় একটি ট্রাকে করে মালয়েশিয়া সীমান্তে নেওয়ার সময় ইমিগ্রেশন পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করলে তিনিসহ ১৪ বাংলাদেশিকে কারাগারে পাঠানো হয়।

রাসেল এবং অন্য নয় জন থাইল্যান্ডের আদালতের দেওয়া জরিমানা পরিশোধের পর ৩১ জানুয়ারি বাংলাদেশে ফিরে আসেন।

'আমাকে কলকাতা হয়ে ভিয়েতনামে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর দালালের লোকেরা আমাদের কম্বোডিয়ার ভিসার ব্যবস্থা করে। আমাদের বাধ্য হয়ে কম্বোডিয়া যেতে হয় এবং ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটে এবং কাঁধ সমান পানি পার হয়ে থাইল্যান্ডে ঢুকি,' গত বৃহস্পতিবার এ প্রতিবেদককে কথাগুলো বলছিলেন রাসেল।

'এরপর ওই ১৫ বাংলাদেশিকে একটি ছোট ট্রাকে ওঠানো হয়। ২২ ঘণ্টা ধরে ট্রাকটি চলে। মালয়েশিয়া সীমান্ত থেকে যখন ৩০ কিলোমিটার দূরে তখন ইমিগ্রেশন পুলিশ আমাদের আটক করে, বলছিলেন রাসেল।

তিনি জানান, ১১ বছর ধরে মালয়েশিয়ায় ওয়েল্ডিং টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। দেশে তিনি তার চার সদস্যের সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন আর তাই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটিতে ফিরতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন তিনি।

সম্প্রতি ডেইলি স্টারের সাথে কথা হয় থইল্যান্ডে গ্রেপ্তার কক্সবাজারের মো. আবু সাজ্জাতের মা জান্নাত বেগমের। তিনি বলছিলেন, 'থাইল্যান্ডে আমার ছেলের গ্রেপ্তারের খবর শুনে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি।'

তিনি বলেন, এক দালাল তার ছেলের কাছ থেকে ৪ লাখ টাকা চাঁদা নিলেও বিস্তারিত জানাতে পারেননি।

'সাজ্জাতের এটাই প্রথম মালয়েশিয়ায় যাওয়া। তার বড়ভাই সেখানে কাজ করে,' বলেন জান্নাত বেগম।

থাই সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুয়ায়ী, গ্রেপ্তারকৃতরা প্রত্যেকেই দালালদের চার লাখ থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা পর্যন্ত দিয়েছে।

থাইল্যান্ডে বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সেলর (শ্রম কল্যাণ) ফাহাদ পারভেজ বসুনিয়া বলেছেন, তারা গ্রেপ্তারের বিষয় জানেন এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছেন।

মানবপাচার প্রতিরোধে কাজ করা ব্যক্তিদের অভিযোগ, সিন্ডিকেট সদস্যরা ইমিগ্রেশন পুলিশের একাংশকে ঘুষ দিয়ে ঢাকা বিমানবন্দরে শ্রমিকদের ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্সের কাজ করে।

তারা বলেন, যদি শ্রমিকরা টুরিস্ট ভিসায় দেশ ছাড়েন, তাহলে কেন এবং কোথায় যাচ্ছেন তা পর্যবেক্ষণের জন্য কর্তৃপক্ষের অবশ্যই একটি শক্তিশালী ব্যবস্থা থাকতে হবে, কারণ তাদের গ্রেপ্তার বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে।

যদি কেউ ট্যুরিস্ট ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও দেশে ফিরে না আসে তবে অভিবাসন বিভাগকে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে।

মালয়েশিয়ায় মানবপাচার চলছে দীর্ঘদিন ধরে। কর্তৃপক্ষ যখন একটি নির্দিষ্ট রুটে নজরদারি জোরদার করে, তখন আন্তঃদেশীয় পাচারকারী চক্রগুলো নতুন রুট খুঁজে বেড়ায়।

মানব পাচার নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন এমন কর্মকর্তারা বলছেন, দালালরা এখন চাকরিপ্রার্থীদের প্রথমে শ্রীলঙ্কা ও নেপালে নিয়ে যাচ্ছে, যেখান থেকে তাদের ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তারপরে গাড়ি ও ট্রাকে করে মালয়েশিয়া সীমান্তে নিয়ে যাওয়ার আগে তাদের থাইল্যান্ডে লুকিয়ে থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে।

তারা বলছেন, কিছু পাচারকারী চাকরিপ্রার্থীদের মিয়ানমার হয়ে থাইল্যান্ডেও নিয়ে যাচ্ছে। তাদের অনেককে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ায় গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।

বেশ কয়েক বছর আগে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে সমুদ্রে নৌকাডুবিতে অনেক ভাগ্যহত গিয়েছিলেন, আবার কেউ কেউ থাইল্যান্ডের গভীর জঙ্গলে অনাহার ও নির্যাতনে মারা গিয়েছিলেন, যেখানে আন্তঃদেশীয় পাচারকারী চক্রের সদস্যরা মুক্তিপণের জন্য তাদের জিম্মি করে রেখেছিল।

বাংলাদেশি ভাগ্যান্বেষীদের গ্রেপ্তারের খবর প্রায়ই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়।

গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের ২২ জুন থাইল্যান্ডের সংখলা প্রদেশে চার থাই নাগরিকসহ ১৯ বাংলাদেশি অভিবাসনপ্রত্যাশীকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২৩ সেপ্টেম্বর বৌদ্ধ ভিক্ষুর ছদ্মবেশে সাত বাংলাদেশিকে মালয়েশিয়া সীমান্তে নিয়ে যাওয়ার সময় আটক করা হয়। তারা মিয়ানমার থেকে থাইল্যান্ডে ঢুকেছিলেন।

এছাড়া কম্বোডিয়ার অভিবাসন বিভাগ, এই বছরের ১১ জানুয়ারি নমপেনের দুটি হোটেলে ৫১ জন বাংলাদেশিকে আটক করার পর সাজ্জাদ আল ফয়সালসহ বাংলাদেশি দুই পাচারকারী চক্রের সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। ভুক্তভোগীরা এখন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আশ্রয়ে রয়েছেন।

রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) পরিচালক (কর্মসূচি) মেরিনা সুলতানা বলেন, বহু বছর ধরে চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে মালয়েশিয়ায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

এক সময় সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট কক্সবাজার থেকে সমুদ্রপথ ব্যবহার করত এবং মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে অনেকে মারা গিয়েছিল। সিন্ডিকেটগুলো প্রায়ই তাদের রুট ও কৌশল পরিবর্তন করে।

মেরিনা বলেন, থাইল্যান্ডে গ্রেপ্তারকৃতদের যদি ট্যুরিস্ট ভিসায় ভ্রমণ করতে দেখা যায়, তাহলে সংশ্লিষ্ট ট্রাভেল এজেন্সিগুলো অবশ্যই পাচারের সঙ্গে জড়িত।

তিনি বলেন, এজন্য ট্রাভেল এজেন্সি ও বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনের অনিয়ম রোধে আমাদের শক্তিশালী মনিটরিং ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকতে হবে। শ্রমিকরা কোথায় যাচ্ছেন, কেন যাচ্ছেন, তা খতিয়ে দেখতে হবে কর্তৃপক্ষকে।

এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য দ্য ডেইলি স্টার পুলিশের বিশেষ পুলিশ সুপার (ঢাকা বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন) শাহরিয়ার আলমকে ফোন ও টেক্সট করলেও তিনি সাড়া দেননি।

এ বিষয়ে দালাল রফিক খাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি চাকরিপ্রার্থীদের অবৈধভাবে মালয়েশিয়া নেয়ার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেন। তিনি দাবি করেন, রাসেলকে কীভাবে থাইল্যান্ডে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তা সেলিম নামে একজন জানতেন।

ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে সেলিম বৃহস্পতিবার জানান, মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত মামুন নামে এক ব্যক্তির অনুরোধে তিনি তার আল আইম ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের এয়ার টিকিটের ব্যবস্থা করেছেন।

Comments

The Daily Star  | English

Central bank at odds with BPO over Nagad’s future

The discord became apparent after Faiz Ahmed Taiyeb, special assistant to the chief adviser with authority over the Ministry of Posts, Telecommunications and IT, sent a letter to the BB governor on May 12 and posted the letter to his Facebook account recently

1h ago