ভয়ংকর ড্রাগ ‘শয়তানের নিঃশ্বাস’

এই ড্রাগ বাংলাদেশের অপরাধীদের হাতে এসে পৌঁছেছে
ধুতরা ফুল, যা থেকে তৈরি হয় স্কোপোলামিন। ছবি: সংগৃহীত

ভাবুন একটা নির্জন রাস্তা দিয়ে আপনি আপনার মতো হেঁটে যাচ্ছেন। এমন সময় অপরিচিত কেউ একজন আপনার কাছে এসে একটি বিজনেস কার্ড আপনাকে দিলেন। আপনি হয়তো খুব স্বাভাবিকভাবেই সেটি নিলেন। আপনি হয়তো জানেনই না সেই কাগজটি ড্রাগে ভিজিয়ে আনা হয়েছে, যা কয়েক মিনিটের মধ্যে আপনার নিঃশ্বাসের মধ্য দিয়ে শরীরে প্রবেশ করতে পারে।

কিংবা কেউ হয়তো এই ড্রাগের গুড়ো সরাসরি আপনার মুখে ছিটিয়ে দিলো এবং সেটি শ্বাসের মধ্য দিয়ে নেওয়ার পরপরই আপনি নিজেকে আবিস্কার করলেন এক 'অপ্রকৃতস্থ' অবস্থায়- যেখানে আপনার নিজের নিয়ন্ত্রণ আপনার হাতে নেই এবং তারা যা বলছে আপনি তাই করছেন।

এই ড্রাগ যার ওপর প্রয়োগ করা হয় তার নিজের কোনো নিয়ন্ত্রণ তার থাকে না। বলা হয়ে থাকে, মাদকের শিকার ওই ব্যক্তি তার নিয়ন্ত্রণকারীর কথা মতো সবকিছুই করতে পারেন। তার সব জিনিসপত্র দিয়ে দিতে পারেন এমনকি দুর্বৃত্তদের কথা মতো কাউকে খুন পর্যন্ত করতে পারেন।

এই ড্রাগের নাম স্কোপোলামিন। এক ধরনের নাইটশেড উদ্ভিদ থেকে তৈরি হয়। স্কোপোলামিন হায়োসিন নামেও পরিচিত। এটি প্রাকৃতিক বা কৃত্রিমভাবে উৎপাদিত ট্রপেন অ্যালকালয়েড এবং অ্যান্টিকোলিনার্জিক ড্রাগ যা কয়েক ধরনের রোগ ও অসুস্থতা যেমন-মোশন সিকনেস, অপারেশন পরবর্তী বমি বমি ভাব এবং পার্কিনসন রোগের কাঁপুনির চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।

স্কোপোলামিনকে ধরা হয় প্রথম 'ট্রুথ সেরাম' বা সত্য বলানোর ওষুধগুলোর একটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রতিপক্ষের কাছ থেকে তথ্য বের করতে এর ব্যবহারের নজির পাওয়া যায়। এর অন্ধকার দিকগুলোর কারণেই এটি পরিচিত।

পোশাকি নাম স্কোপোলামিন হলেও সাধারণের কাছে এটি পরিচিত 'শয়তানের নিঃশ্বাস' নামে। আর পুরো বিশ্বে এটি 'সবচেয়ে বিপজ্জনক ড্রাগ' হিসেবে স্বীকৃত।

অপরাধীরা, বিশেষ করে কলম্বিয়া এবং ইকুয়েডরে লুট, ধর্ষণ কিংবা হত্যা করার মতো জঘন্য সব অপরাধ ঘটনাতে এর ব্যবহার করেছে।

আর আমাদের জন্য ভয়ংকর বিষয় হলো, এই ড্রাগ বাংলাদেশের অপরাধীদের হাতে এসে পৌঁছেছে।

গত ২২ মে চট্টগ্রামের ফাতেমা বেগম এ ধরনের ঘটনার শিকার হন।

বাজার থেকে ফেরার পথে সাহায্য চাইতে তার কাছে আসেন দুই জন। তিনি তাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য ঘুরে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তার মুখে একজন পাউডারের মতো কিছু ছিটিয়ে দিলে তিনি এক অদ্ভুত ও ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হন।

মাদকের প্রভাবে ফাতেমা নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন এবং নিজের অজান্তেই অপরাধীদের দাবি মানতে থাকেন। এসময় অপরাধীরা তার কাছে থাকা গহনা যার আনুমানিক মূল্য ৮০ হাজার টাকা, নগদ টাকা, তার ফোন ও একটি শপিং ব্যাগসহ মূল্যবান জিনিসপত্র চুরি করে নিয়ে যায়।

পুরো ঘটনাটি সিসিটিভি ক্যামেরায় ধরা পড়ে। পথচারীরাও এ ঘটনাটি স্বাভাবিক ভেবে ভুল করেছিলেন।

ডবলমুরিং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফজলুল কাদের পাটোয়ারী বলেন, স্কোপোলামাইনের প্রভাবে ফাতেমা অপরাধীরা যা করতে বলেছে তাই করেছেন। কয়েক ঘণ্টা পর ফাতেমা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেন এবং বুঝতে পারেন তিনি ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েছিলেন।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ডা. দুলাল কৃষ্ণ সাহা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, স্কোপোলামাইন ধুতরার গাছ থেকে তৈরি হয়। এই ড্রাগ পাউডারের মতো অবস্থায় ডেভিল'স ব্রিদ বা শয়তানের নিঃশ্বাস নামে পরিচিত। এটি কারো ওপর প্রয়োগ করা হলে ভিকটিম তার নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারায় এবং অপরাধীদের কথা মতো তার সবকিছু দিয়ে দেয়।

ভিজিটিং কার্ড, কাগজ, কাপড় কিংবা মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে এই ড্রাগ রেখে যার ওপর ওপর প্রয়োগ করা হবে তার নাকের চার থেকে ছয় ইঞ্চি দূরত্বে নিয়ে আসা হয়।

দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলেন, এটি নিঃশ্বাস নেওয়ার ১০ মিনিটের মধ্যে কার্যকর হয় এবং ভুক্তভোগীর মস্তিষ্ক স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারে না। কারও কারও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে এক ঘণ্টা সময় লাগে, আবার অনেকে তিন থেকে চার ঘণ্টার মধ্যে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরেন।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঢাকা, যশোর, খুলনা, রাজবাড়ী ও বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে স্কোপোলামিন ব্যবহার করে ডাকাতির ঘটনার খবর পাওয়া গেছে।

নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক হত্যা মামলার তদন্ত করতে গিয়ে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে একটি চক্রের কাছ থেকে প্রথম ১০ গ্রাম স্কোপোলামিন উদ্ধার করে নারায়ণগঞ্জ থানা পুলিশ।

চক্রটি অনলাইন গ্রুপের মাধ্যমে স্কোপোলামাইন, পটাশিয়াম সায়ানাইড ও ক্লোরোফর্ম বিক্রি করত।

পুলিশের কাছে স্কোপোলামাইন সম্পর্কিত অপরাধের সঠিক পরিসংখ্যান নেই, তবে তারা স্থানীয় অপরাধীদের সাথে কিছু ইরানি নাগরিকের জড়িত থাকার খোঁজ পেয়েছে।

২০২৩ সালের ২১ জানুয়ারি রাজধানীর পল্লবীতে একটি ট্রাভেল এজেন্সির কর্মচারী জিসান এমন অপরাধের শিকার হন, যখন দুই ইরানি ব্যক্তি এজেন্সিতে এসে জিসানের ক্যাশ বাক্স থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা নিয়ে যায়।

তাদের দেখে এবং তাদের হাসিমুখে কথা বলার পরও জিসান বুঝতে পারেনি যে তাকে ছিনতাই করা হচ্ছে, যতক্ষণ না তারা টাকা নিয়ে চলে যায়। ওই মাসেই এক অপরাধীকে আটক করে পুলিশ।

গত বছরের এপ্রিলে, অভয়নগরে একটি দোকানে ৬ লাখ টাকা ডাকাতির ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঢাকা ও যশোরে তিন ইরানিসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে।

পরবর্তীতে আগস্টে একই ধরনের ঘটনার পর বগুড়ার শিবগঞ্জ থেকে আরও দুই ইরানিকে আটক করা হয়।

যোগাযোগ করা হলে পুলিশ সদরদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) এনামুল হক সাগর বলেন, 'এটি সাধারণ অপরাধের চেয়ে ভিন্ন ধরনের। আমরা ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছি। যখনই এই ধরনের অস্বাভাবিক ধরনের অপরাধ সামনে আসে, আমরা ব্যবস্থা নিই।'

Comments