অন্যায় যে করে, তারে আর দহে না কিছুতেই

সভ্যতার ছাপ তখনই স্পষ্ট হয় যখন ব্যক্তি তার কৃতকর্ম এমনকি অপারগতার দায়টুকুও নেয়; আত্মসম্মান বজায় রাখে। একটি দুর্ঘটনা ঘটলে সভ্য সমাজ শিক্ষা নেয়। সচেতন হয়।
স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

দুর্নীতি আর অসঙ্গতিকে স্বাভাবিকভাবে নিতে শেখা মানুষগুলো কিন্তু আমরাই। নারী যখনই সমাজে যৌন হয়রানির নালিশ করে, তখনই তাকে মানসিকভাবে অসুস্থ প্রমাণ করার প্রয়োজন হয়। নালিশ করার আগ পর্যন্ত একই নারী একই সমাজে গ্রহণযোগ্য থাকে।

বুদ্ধিমত্তার চেয়ে সৌন্দর্যের গ্রহণযোগ্যতা বেশি থাকে। নারী যখন বিদ্যা, বুদ্ধি, বিবেক বোধের সঙ্গে আবির্ভূত হয়, সমস্যা তখনই শুরু হয়।

শিক্ষক কিংবা গুরুকে একটা সময়ে পিতামাতা ও রক্ষকের স্থানে রাখা যেত। এই সময়ে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে তারা বিব্রত হন না। আগেও এরকম ঘটনা ঘটত। আমরা জানতাম না, জানা যেত না। এখন সহজে জানা যায়। কারণ মেয়েরা চুপ থাকে না। লজ্জা এখন আর শুধু একটি জেন্ডারের ভূষণ না। আশার কথা হলো সাহসী মেয়ের সংখ্যা বাড়ছে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যও শিক্ষার্থীদের দিকে কুনজর দেন। মাদ্রাসার নাবালক এবং সাবালক শিক্ষার্থীদের মানসিক, শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের ঘটনা অসংখ্য। ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার শিক্ষার্থী প্রয়াত নুসরাত জাহান রাফি আগুনে পুড়ে আমাদের জন্য জ্বলজ্বলে উদাহরণ রেখে গেছেন। ১৮ বছর ধরে অধ্যক্ষের আসনে থাকা শিক্ষকই ভক্ষক হয়ে মেয়েটির শ্লীলতাহানি করেন।

কেন এমন মৃত্যু? এমন প্রশ্ন হাজারো মানুষের মতো আমারও। এর একটাই জবাব—স্থানীয় প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন ব্যক্তি বা দলীয় নেতাদের স্কুল, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-কেন্দ্রিক লাখো টাকার দুর্নীতি চালিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স করার লোকের যখন অভাব হয়, আর অর্থের কাছে যখন প্রশাসন বিক্রি হয়ে যায়, তখন আমরা হেরে যাই।

এ কারণেই মুনিয়ারা ফ্যানে ঝোলেন। অবন্তিকাও একইভাবে ফ্যানে ঝুলে পড়েন। তনুর মরদেহ পড়ে থাকে ঝোপে। অভিনেত্রী শিমুর লাশও ঝোপে মেলে। মডেল তিন্নি হত্যার বিচার ২০ বছর পরও ঝুলে থাকে। শারমীন রীমার লাশ পড়ে মিজমিজি গ্রামে (৯ এপ্রিল ১৯৮৯)। তবে ব্যতিক্রম হলেও বিচার হয়েছিল এই হত্যাকাণ্ডের। আসামিদের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছিল ১৯৯৩ সালের ২৭ জুলাই। কারণ, এ ক্ষেত্রে তথাকথিত সমাজ নারীকে পাগল প্রমাণ করতে পারেনি। হয়তো ধনীর দুলালের কুকীর্তিকে ঢেকে রাখার মতো পয়সাখোর পয়দা হয়নি তখনো। হলেও বিচারব্যবস্থা হয়তো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পেরেছিল।

যুক্তরাষ্ট্রে যৌন নিপীড়কদের আইনের আওতায় এনে শাস্তিসহ নিপীড়ক হিসেবে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। অপরাধীর অপরাধের প্রকৃতি ও ক্ষতির পরিমাণ বিবেচনা করে যৌন অপরাধের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা প্রাপ্তবয়স্ক এবং কিশোর অপরাধীদের বিভিন্ন স্তরে শ্রেণিবিভাগ করে।

যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে যৌন অপরাধীরা কোথায় বাস করবে, এ ব্যাপারে কি রাষ্ট্র সীমাবদ্ধতা তৈরি করে দেয় না? এখানকার সভ্য সমাজে বাস করার যোগ্যতা অর্জন করে, প্রমাণ করে একজন রেজিস্টার্ড অপরাধী সমাজে বাড়ি কিনে বা ভাড়া নিয়ে থাকতে পারে। এটা নির্ভর করে অপরাধী ডিপার্টমেন্ট অব কারেকশনস, জুভেনাইল রিহ্যাবিলিটেশন বা কাউন্টি প্রবেশনের তত্ত্বাবধানে আছে কি না। যদি এসব অপরাধীরা তত্ত্বাবধানে থাকে, তবে তাদের শাস্তি ভোগ করে কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে সংশোধন বিভাগ বা সাজা প্রদানকারী আদালত তাদের ওপর নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতা বা বিধিনিষেধ আরোপ করে। এর মধ্যে থাকতে পারে—বসবাসের বিধিনিষেধ, শিশুদের আশেপাশে না থাকা, অ্যালকোহল পান কিংবা মাদক গ্রহণ না করা ইত্যাদি। যদি তারা তাদের বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করে, তাহলে তাদের জেল বা কারাগারে পুনরায় ফেরত পাঠানো হতে পারে।

যেসব অপরাধী সংশোধন বিভাগ বা আদালতের তত্ত্বাবধানে থেকে তাদের সাজার সময় শেষ করে, তারা কোনো বিধিনিষেধ ছাড়াই তাদের পছন্দের জায়গায় থাকতে পারে। কোনো সেক্স অফেন্ডার কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে আছে কি না, তা জানতে স্থানীয় ডিওসি (ডিপার্টমেন্ট অব কারেকশন) অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়।

কোনো পরিচিত অফেন্ডারের নাম লিপিবদ্ধ তালিকায় না দেখলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানালে তারা কার্যকর ব্যবস্থা নেন। এসব কাজে কেউ গড়িমসি করলে তার চাকরি থাকে না। যৌন অপরাধী নীতি বোর্ড যৌন অপরাধীদের মুক্তি এবং আবাসন সম্পর্কিত নীতিগুলোর ওপর সমীক্ষা চালায়, গবেষণা করে, প্রকৃত সংখ্যাসহ সব বিষয়ে সাধারণ মানুষকে অবগত রাখে।

সদিচ্ছা থাকলেই আমাদের দেশেও উন্নত চিন্তাপ্রসূত এই কাজগুলো করা সম্ভব। দেশ তখনই উন্নত হয়, যখন আমাদের চিন্তাভাবনা উন্নত হয়। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে বা বিদ্যালয়ে শিক্ষকের চাকরি নিশ্চিতের আগে শিক্ষক কিংবা পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের অ্যাকাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড আর টাকার অঙ্ক দেখার সঙ্গে তাদের চারিত্রিক ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করা হয় কি? অপরাধীদের তালিকা তৈরি করা হয় কি? কে জানে!

প্রতি বছর বহুতল ভবনের অগ্নিকাণ্ড থেকে শুরু করে অস্বাস্থ্যকর খাবার বিক্রি, নির্বাচনে অযোগ্য প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়া, যোগ্য শিল্পীর সময়মতো রাষ্ট্রীয় পদক না পাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে চলেছে প্রতিটি ক্ষেত্রে 'চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স' করার মতো যোগ্য লোক নেই বলে। লোক থাকলেও অর্থ ও ক্ষমতার কাছে আত্মসম্মান বিক্রি হয় বলে।

রাষ্ট্র তখনই সফল হয়, যখন চাহিদা অনুসারে সময়মতো বৈধভাবে নাগরিক সেবা পৌঁছে দিতে পারে, নিরাপত্তা দিতে পারে, সম্পদের বণ্টন সুষম হয়, বাক স্বাধীনতার চর্চা থাকে, দুর্নীতি নিম্নমুখী আর অর্থনীতি ঊর্ধ্বমুখী হয়। রাষ্ট্র অসফল অকার্যকর হয় উল্টোটা হলে। বাংলাদেশে বাস্তবে কী ঘটছে তার ব্যাখ্যাটুকু পাঠকদের চিন্তা-চেতনার ওপর ছেড়ে দিলাম।

যুক্তরাষ্ট্রে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষ শিক্ষা নিয়েছে। ধবধবে সাদারাই (সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও ক্ষমতা বেশি যাদের) বেশি বলে এখানে 'ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার'। পুলিশ প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছে। অনিয়মের ঘটনা ঘটলে তারা স্থানীয় থেকে কেন্দ্রীয় পর্যায়গুলোর স্তরে স্তরে উপযুক্ত, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও অভিজ্ঞ লোক নিয়োগ দেয়। নজরদারি বাড়ায়। সময়মতো খবরদারি করে। কাউন্টারব্যালেন্স করে। ভারসাম্য ঠিক রাখে। একটি সংস্থা বা সিস্টেম যেন কোনো রাজনৈতিক ক্ষমতার ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত না হয়, নিয়ন্ত্রিত না হয়, তা নিশ্চিত করে। সমাজকে অবহিত করে। অক্ষম হলে লজ্জা পায়। ক্ষমতা ছেড়ে নতি স্বীকার করে। তবু জবাবদিহিতার জায়গায় নিজেকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করে।

সভ্যতার ছাপ তখনই স্পষ্ট হয় যখন ব্যক্তি তার কৃতকর্ম এমনকি অপারগতার দায়টুকুও নেয়; আত্মসম্মান বজায় রাখে। একটি দুর্ঘটনা ঘটলে সভ্য সমাজ শিক্ষা নেয়। সচেতন হয়।

যেকোনো ঘটনা ঘটলে আমরা তার উল্টোটা করি। চায়ের কাপে ঝড় তুলে আড্ডায় গল্পে চর্চা করে দায় শেষ করি। আত্মসম্মানের সংজ্ঞা পাল্টে যায়। অপরাধ করার পর জবাবদিহি দূরের কথা; অপরাধ ঢাকতে আরও অপরাধ করি। হত্যার দায় এড়াতে সরকারকে কিনে ফেলা, সাংবাদিকদের পকেটে পুরে ফেলা, প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো সহজ এখন। নারীকে নির্যাতন করা দেখলে তাকেসহ তার চৌদ্দগোষ্ঠীকে পাগল প্রমাণ করতে উদ্যত হয় পুরো পুরুষসমাজ (সংখ্যাগরিষ্ঠ ও অপেক্ষাকৃত বেশি ক্ষমতা যাদের)। সবকিছুতে উল্টোস্রোতে সাঁতার কাটতে কাটতে ক্লান্ত হয়ে পরাজয় স্বীকার করে তনু, নুসরাত, অবন্তিকারা।

বহুকাল ধরে দেখে আসছি, অন্যায় যে করে তারে আর দহে না কিছুতেই। তাই বলে অন্যায় যে সহে, তাকেও কি তা দহে না?

শাহনাজ রহমান: এমপিএইচ, মিল্কেন ইনস্টিটিউট স্কুল অব পাবলিক হেলথ, দ্য জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি; এমবিবিএস, বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ

[email protected]

Comments