শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে নরসিংদী কারাগারে হামলা করল কারা

এই ঘটনায় সরকারি কাজে বাধা, পুলিশ সদস্যদের হত্যাচেষ্টা, কারাগারে হামলা ও অস্ত্র লুটের অভিযোগে পৃথক চারটি মামলা করা হয়েছে।
ছবি: সংগৃহীত

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ১৮ জুলাই নরসিংদীর ভেলানগর এলাকায় পুলিশের গুলিতে দুই শিক্ষার্থী নিহত হয়।

পরদিন ১৯ জুলাই শুক্রবার বিকেল সাড়ে ৩টা। নরসিংদী জেলা কারাগার থেকে কয়েক গজ দূরে ভেলানগর মোড়ে জড়ো হয় অন্তত তিন হাজার ছাত্র-জনতা।

কারাগারের প্রধান ফটক থেকে হাজারো মানুষের ওই সমাবেশ লক্ষ্য করে টিয়ারশেল ছোড়ে পুলিশ। আন্দোলনকারীরা প্রথমে কিছুটা পিছু হটে। পরে তাদের পাল্টা প্রতিরোধের মুখে পুলিশ পিছু হটে।

ঠিক এমন সময় একদল লোক জেলা কারাগারের প্রধান ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে। কারাগারে হামলা চালিয়ে অস্ত্র, গুলি লুটপাট করা হয় এবং জেলখানার সেলের তালা বাইরে থেকে খুলে দিয়ে কয়েদিদের পালানোর সুযোগ করে দেওয়া হয়।

বিকেল সোয়া ৪টার দিকে জেলখানায় প্রবেশ করা লোকজন পুলিশকে ধাওয়া দিয়ে কারাগারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। তারা ভেতরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে এবং কারাগার থেকে ৮৩৬ বন্দি পালিয়ে যায়।

সেদিন ঠিক কী ঘটেছিল, তা জানতে জেল থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর আদালতে আত্মসমর্পণ করা পাঁচ বন্দি, আন্দোলনকারীদের নয়জন ও চার কারারক্ষীর সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ২৬ বছর বয়সী এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, 'দুপুর ২টার দিকে একদল লোক প্রথমে ওই এলাকায় স্থাপিত ৭-৮টি সিসিটিভি ক্যামেরা ভাঙচুর করে। সময় যত গড়িয়েছে, আন্দোলনকারীর সংখ্যা ততই বাড়তে থাকে। বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে বিভিন্ন এলাকা থেকে সেখানে দুই হাজারের বেশি লোক উপস্থিত হয়।'

'ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে অবস্থিত জেলা কারাগারের উত্তর গেট বা প্রধান প্রবেশদ্বার থেকে কিছু পুলিশ তাদের দিকে কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। পরে পুলিশ কিছুটা পিছু হটলে বিকেল সোয়া ৪টার দিকে তারা পুলিশকে ধাওয়া করে। এ সুযোগে তাদের একটি অংশ জেলা কারাগারে প্রবেশ করে জেল সুপার, জেলারের কাযার্লয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। কারারক্ষীদের বাসভবনের পাশে থাকা ১৪-১৫টি মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে পড়ে,' দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন তিনি।

সেদিন কারাগার থেকে পালিয়েছিলেন আলোকবালী ইউনিয়নের ২৫ বছর বয়সী কারাবন্দি জীবন মিয়া। ইতোমধ্যে তিনি আত্মসমর্পণও করেছেন। জীবন মিয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিকেল ৫টা থেকে ৬টার মধ্যে আমরা গোলাগুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পাই। পাশাপাশি কাঁদানে গ্যাসের প্রচণ্ড গন্ধ আসছিল এবং তখন আমরা আমাদের সেলে তালাবদ্ধ ছিলাম। এরপর যখন শত শত লোক আমাদের সেলের কাছে এসে জিনিসপত্রে আগুন ধরিয়ে দিতে শুরু করে, তখন একজন জেলরক্ষী আমাদের দরজা খুলে দেয়। এরপর আমরা পালিয়ে যাই।'

আরও কয়েকজন বন্দি জানান, শত শত বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। বন্দিদের কেউ বের হতে অনিচ্ছুক থাকলেও জনতা তাদের জোর করে বের করে দিয়েছে। আবার বাইরে থেকে কিছু লোকজন এসে কিছু সেলের তারা ভেঙে কয়েদিদের বের করে দিয়েছে।

নরসিংদী সদর উপজেলার করিমপুর এলাকার আরেক বন্দি আবদুল আহাদ বলেন, 'হামলাকারীরা আমাদের সেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। আমাদের অনেকে বের হতে না চাইলেও কেউ কেউ তালা ভেঙে মারধর করে আমাদের বের করে দেয়।'

নরসিংদী গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খোকন চন্দ্র সরকার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কারাগার ভবনের কাছে চিনিশপুর এলাকায় ছয়টি মাইক্রোবাস অপেক্ষা করছিল। পালিয়ে যাওয়া বন্দিদের নিয়ে যাওয়ার জন্য তারা সেখানে অবস্থান করছিল বলে আমরা সন্দেহ করছি। আমাদের মনে হয়, আন্দোলনকারীদের ভেতর থেকে কিছু দুর্বৃত্ত সুযোগমতো কারাগারে হামলা চালিয়েছে। শিক্ষার্থীরা কারাগারে হামলা করবে বলে মনে আমি বিশ্বাস করি না। আমরা প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করছি।'

নরসিংদীর পুলিশ সুপার ও কারা কর্তৃপক্ষের মতে, সেদিন কারাগারে থাকা ৮২৬ বন্দির সবাই হয় পালিয়ে যায় অথবা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। সেদিন কারাগার থেকে ৮৫টি অস্ত্র, নয় হাজার গুলি ও সরকারি নথিপত্র লুট করা হয়। এ ছাড়া কারা প্রাঙ্গণের ১৫টি স্থানে অগ্নিসংযোগ করা হয়।

কারাগারের প্রধান ফটকের পাহারাদার নাজিমুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রধান ফটকে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করার সময় আমরা বস্তা-টেবিল দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। আমরা সময়মতো অস্ত্র প্রস্তুত করতে পারিনি। প্রতিটি সেল তালাবদ্ধ থাকলেও দুর্বৃত্তরা ভাঙচুর করে তাদের নিয়ে যায়।'

ঘটনার পর সাময়িক বরখাস্ত হন জেলসুপার আবুল কালাম আজাদ। জানতে চাইলে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের কারাগারে তিন শিফটে কাজ করেন মাত্র ১০৪ জন। আমরা বারবার তাই বিভিন্ন জায়গায় সহায়তা চেয়েছি। কিন্তু কেউ আমাদের সহায়তা করেনি। দুবৃর্ত্তদের সংখ্যা ৮-১০ হাজার হওয়ায় আমাদের অপ্রতুল জনশক্তি দিয়ে আটকানো সম্ভব ছিল না।'

জানতে চাইলে নরসিংদীর জেলা প্রশাসক বদিউল আলম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অবহেলাজনিত কারণে জেলসুপার আবুল কামাল আজাদ ও জেলার কামরুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এমন জঘন্য ঘটনা উপমহাদেশে আগে কখনো ঘটেনি। দায়ীদের আইনের আওতায় আনা হবে।'

কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়া বা বাধ্য হওয়া ৪৬৫ জন ইতোমধ্যে আদালত ও পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে বলে জানান জেলা প্রশাসক। বাকি কয়েদিরাও আত্মসমর্পণ করবেন বলে আশা করছেন তিনি।

ওই ঘটনায় সরকারি কাজে বাধা, পুলিশ সদস্যদের হত্যাচেষ্টা, কারাগারে হামলা ও অস্ত্র লুটের অভিযোগে পৃথক চারটি মামলা করা হয়েছে।

ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, পুলিশের আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নরসিংদী কারাগার পরিদর্শন করেছেন।

কারাগারে হামলার বিষয়ে জানতে চাইলে নরসিংদীর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ওই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ইতোমধ্যে ১০২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। লুট হওয়া ৮৫টি অস্ত্রের মধ্যে ৩৯টি এবং এক হাজার ৮৫ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়েছে।'

Comments