ভুয়া ভোটারদের ছবি তুলে অবরুদ্ধ ডেইলি স্টারের সাংবাদিক, পুলিশ পাহারায় উদ্ধার
তখন দুপুর ১টা বেজে ৫০ মিনিট। অন্যান্য কেন্দ্রের মতোই জাতীয় নির্বাচনের ভোটগ্রহণ চলছে ঢাকা-৮ আসনের অন্তর্গত সেগুনবাগিচা হাইস্কুলে অবস্থিত চারটি কেন্দ্রে।
স্কুল ভবনের তৃতীয় তলায় একটি কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, বুথের সামনে পাঁচ-সাত জন যুবক ভোট দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন।
এর মধ্যে মাস্ক পরা এক যুবক ভোট দিতে ঘরে ঢুকলে, উপস্থিত কর্মকর্তা ভোটার স্লিপের সঙ্গে তার কাছে থাকা তথ্য মিলিয়ে দেখেন।
ওই কর্মকর্তা তাকে বলেন, 'আপনার ভোট তো দেওয়া হয়ে গেছে। আর তা ছাড়া আপনার চেহারার সঙ্গে তো আমাদের কাছে থাকা ছবিরও মিল নেই।'
কর্মকর্তার আর কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই ওই যুবক বুথ ছেড়ে দ্রুত বের হয়ে যেতে উদ্যত হয়। এ ঘটনার ভিডিও রেকর্ড দ্য ডেইলি স্টারের হাতে রয়েছে।
পরবর্তীতে ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে ওই যুবককে প্রশ্ন করা হলে, তিনি দৌড়ে কেন্দ্র থেকে বের হয়ে যান।
এরপর ডেইলি স্টারের দুইজন সাংবাদিক ওই যুবককে অনুসরণ করতে থাকেন। এক পর্যায়ে দেখা যায়, তিনি একাই নন, তার সঙ্গে ১৫-৩৫ বছর বয়সী, প্রায় ২৫ থেকে ৩০ জনের একটি দল ভোটকেন্দ্রের সামনে অবস্থান করছে।
এই দলটিকে আরও কিছুক্ষণ অনুসরণ করে ডেইলি স্টার। দুপুর ২টার দিকে এদের মধ্যে থেকে পাঁচ-ছয় জন যুবক, আগের কেন্দ্রের বিপরীত পাশে অবস্থিত আরেকটি কেন্দ্রে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে দেখা যায়।
ডেইলি স্টার টিম তাদেরকে অনুসরণ করে ওই কেন্দ্রে গিয়ে দেখতে পায়, কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মো. রাইহুল করিম কয়েকজন যুবককে বুথের সামনে দাঁড় করিয়ে প্রশ্ন করছেন। দেখা যায়, এক যুবক ওই কর্মকর্তার সব প্রশ্নের উত্তর ঠিকঠাক দিতে পারছেন না।
ডেইলি স্টারের কাছে এ ঘটনার ছবি ও ভিডিও রেকর্ড রয়েছে।
'রাহুল' বলে পরিচয় দেওয়া ওই যুবককে পরবর্তীতে পুলিশের হাতে তুলে দেন প্রিসাইডিং অফিসার। পরিস্থিতি বুঝে, তার সঙ্গে থাকা বাকি যুবকেরা দ্রুত ভোটকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে গিয়ে কেন্দ্রের ফটকের সামনে অবস্থান নেয়।
এর পরই ঘটনা অন্যদিকে মোড় নেয়। আটকের ঘটনার ভিডিও ধারণ করায় কেন্দ্রের সামনে উপস্থিত যুবকরা ডেইলি স্টারের দুই সাংবাদিকের ওপর চড়াও হতে শুরু করে।
বিষয়টি বুঝতে পেরে দুপুর সোয়া ২টার দিকে কেন্দ্র ত্যাগ করতে উদ্যত হয় এই দুই সাংবাদিক। তবে কেন্দ্রের গেটে পৌঁছালে সেখানে থাকা যুবকেরা নানাভাবে হুমকি দিতে শুরু করে।
সম্ভাব্য বিপত্তি এড়াতে আবারও কেন্দ্রে ফেরত এসে ভবনের দোতলায় প্রিসাইডিং অফিসারের কক্ষের সামনে অবস্থান নিতে বাধ্য হয় ডেইলি স্টারের দুই সাংবাদিক। কেন্দ্রে উপস্থিত কর্মকর্তাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের এ বিষয়ে মৌখিক অভিযোগ দেওয়া হয়।
এরই মধ্যে, ২টা ২০ মিনিটে নৌকার ব্যাজ পরিহিত আরও দুই যুবক দোতলায় এসে সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, 'তোরা নিচে নামছিস না কেন? দ্রুত নাম, আমরা অপেক্ষা করছি। তোদের চেনাব আমরা কারা।'
প্রিসাইডিং অফিসারকে বিষয়টি জানালে তিনি 'অসহায়ত্ব' প্রকাশ করেন।
একপর্যায়ে ডেইলি স্টারের আরেক সাংবাদিকের সহযোগিতায় ২টা ৪০ মিনিটের দিকে ভোটকেন্দ্র থেকে বের হতে চেষ্টা করে আটকে থাকা দুই সাংবাদিক।
কেন্দ্রের বাইরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, প্রায় ২০-২৫ যুবক চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে। তারা মোবাইল থেকে সব ছবি, ভিডিও ডিলিট করে দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। এক পর্যায়ে সাংবাদিকের হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে গ্যালারিতে গিয়ে ভিডিও ডিলিট করে দেয় এক যুবক।
এ ছাড়া তারা ফোনের ফেসবুক মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপসহ অন্যান্য অ্যাপগুলো চেক করে দেখে যে, কোনো মাধ্যমে ভিডিওটা শেয়ার করা হয়েছে কি না।
এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পর, তারা দাবি করে বলে, 'আপনাদের কারণে আমাদের একজনকে আটক করেছে পুলিশ। আপনারা ওকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করেন, নইলে আপনাদেরকেও আমরা কেন্দ্র থেকে বের হতে দেবো না।'
এ ব্যাপারে অপারগতা প্রকাশ করলে কয়েকজন উত্তেজিত হয়ে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে। গায়ে ধাক্কা মারতে শুরু করে।
সেই সময় আশেপাশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সদস্য উপস্থিত থাকলে তাদেরকে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।
পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে বিবেচনায় আবারও কেন্দ্রে প্রবেশ করে প্রিসাইডিং অফিসারের কক্ষে অবস্থান নিতে বাধ্য হন ডেইলি স্টারের তিন সাংবাদিক।
সেখানে অফিসার থাকা অবস্থাতেই নৌকা ব্যাজ পরিহিত আরেকজন উপস্থিত হন। তিনি বলেন, 'আপনারা যদি উনাকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করেন, তাহলে আপনাদেরকেও কেন্দ্র থেকে বের হতে আমরা সহযোগিতা করব।'
পরে প্রিসাইডিং অফিসার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শরণাপন্ন হন এবং অতিরিক্ত পুলিশ দিয়ে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন। অবশেষে বিকেল ৩টা ৫ মিনিটে প্রায় একঘণ্টা পর, পুলিশি নিরাপত্তায় কেন্দ্র থেকে বের হতে সমর্থ হন ডেইলি স্টারের তিন সাংবাদিক।
উল্লেখ্য, ঢাকা-৮ আসনে এবার নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম।
Comments