কাউন্সিলর পদে আ. লীগ প্রার্থীরাই পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী
খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বেশিরভাগ কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই পরস্পরের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছেন।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সূত্র দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেওয়ায় এবং কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের দলীয় সমর্থন না থাকায় প্রায় সব ওয়ার্ডে ক্ষমতাসীন দলটির নেতাকর্মীরা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছেন।
মেয়র পদে দলীয় প্রার্থীকে কেন্দ্র থেকে মনোনয়ন দেওয়া হলেও কাউন্সিলর পদে স্থানীয় নেতারা প্রার্থীদের মৌখিকভাবে সমর্থন দেন।
খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সংরক্ষিত আসনে ৩৯ নারী প্রার্থীসহ সাধারণ ওয়ার্ডে ১৭৫ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তাদের মধ্যে বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত ৯ ও জামায়াতে ইসলামীর ৫ প্রার্থী ছাড়া ১৬১ প্রার্থী আওয়ামী লীগের।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, বেশিরভাগ ওয়ার্ডে বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থী না থাকায় এসব ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ নেতারাই হয়ে উঠেছেন একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী। নগরীর ৩১টি সাধারণ ওয়ার্ডের ২৬টিতেই আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা কাউন্সিলর প্রার্থী হয়েছেন।
এ ছাড়াও, সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডের ১০টির সবগুলোতেই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছেন দলের একাধিক নেতা।
২০১৮ সালে নির্বাচনে কেসিসির ৩১টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১২টিতে আওয়ামী লীগ ও ৯টিতে বিএনপি সমর্থিতরা কাউন্সিলর পদে জয়ী হন।
সংরক্ষিত ১০টি ওয়ার্ডের ৭টিতে আওয়ামী লীগ, একটিতে বিএনপি ও ২টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বিজয়ী হন। তবে সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ী ১২ কাউন্সিলরের মধ্যে ৪ জন ছিলেন 'বিদ্রোহী'।
এ বছর কেসিসির ৩১ সাধারণ ওয়ার্ডের ৫টিতে আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী আছে।
ইতোমধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৩ ও ২৪ নং ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন। ২৭ নং ওয়ার্ডের এক প্রার্থী গতরাতে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেওয়ায় অন্য প্রার্থী জয়ী হবেন বিনা ভোটে।
প্রার্থীদের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৩ নং ওয়ার্ডে ৫ প্রার্থীর ৪ জনই আওয়ামী লীগের। এখানে বর্তমান কাউন্সিলর আবদুস সালামের পাশাপাশি প্রার্থী হয়েছেন দলের ওয়ার্ড সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ হাসান পিকু, শ্রমিক লীগ নেতা আবজাল জমাদ্দার ও মহানগর যুবলীগের সদস্য কাজী ইব্রাহিম মার্শাল।
১০ নং ওয়ার্ডেও ৬ প্রার্থীর ৪ জন আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের। বর্তমান কাউন্সিলর ও যুবলীগ নেতা কাজী তালাত হোসেন কাউট, থানা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. এ এস এম সায়েম মিয়া, খালিশপুর থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহ্বায়ক শরিফুল ইসলাম প্রিন্স ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা ইমাম উদ্দিন আহম্মেদ প্রার্থী হয়েছেন।
১২ নং ওয়ার্ডে ৭ প্রার্থীর ৫ জনই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত। তারা হলেন–বর্তমান কাউন্সিলর মনিরুজ্জামান মনির, দলের থানা শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক তাহিদুল ইসলাম ঝন্টু, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা জুবায়ের হোসেন, মিরাজুর রহমান ও শরিফুল ইসলাম বাবু।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, এসব প্রার্থীরা একে অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনছেন। তাদের সমর্থকরা বিবাদে জড়িয়ে পড়ছেন। এমনকি, অন্য প্রার্থীর সমর্থকদের হাতে বিরোধী কয়েকজন আহতও হয়েছেন।
খুলনার ১৬ নং ওয়ার্ডের মোট কাউন্সিলর প্রার্থী ৫ জন। তাদের মধ্যে মোহাম্মদ আনিসুর রহমান বিশ্বাস বর্তমান কাউন্সিলর। তিনি গতবার নির্বাচনের আগে বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি মহানগর আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সদস্য। ওই ওয়ার্ডে প্রার্থী হয়েছেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ হাসান ইফতেখার চালু।
গতকাল প্রচারের শেষ দিনে ২ কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে কয়েকজন আহত হন। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
এর আগে গত ৪ জুন রাতে ওই ওয়ার্ডে আনিসুর রহমান ও হাসান ইফতেখারে চালুর ২ কর্মীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সে বিষয়ে হাসান ইফতেখার চালু রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। পরে নির্বাচন কমিশন অফিস আনিসুর রহমান বিশ্বাসকে তলব করেন।
হাসান ইফতেখার চালু দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আনিসুর রহমানের কর্মীরা পরিকল্পিতভাবে আমার কর্মীকে মারধর করেছেন।'
অন্যদিকে আনিসুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ব্যবসায়িক কারণে ২ ব্যক্তির দ্বন্দ্ব হয়েছে। এতে রাজনৈতিক রঙ চড়ানো হচ্ছে।'
১৪ নং ওয়ার্ডে এবার প্রার্থী হয়েছেন ১০ জন। তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের ৫ জন। সেই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী মাহফুজুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যেহেতু সরাসরি দলের সমর্থন নেই, তাই ব্যক্তি ইমেজ আমাদের মূল শক্তি। সেভাবেই নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি।'
২২ নং ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য কাজী আবুল কালাম আজাদ ও সদর থানা যুবলীগের যুগ্ম আহবায়ক তাজুল ইসলাম প্রার্থী হয়েছেন। গত ২৬ তারিখ থেকে তারা একে অপরের নির্বাচনী কার্যালয় ভাঙচুরের অভিযোগ করে আসছেন।
খুলনা সিটি করপোরেশনের ১৪ দল প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহবায়ক খালিদ হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যেহেতু মহানগরের দায়িত্বশীল নেতারা মেয়র প্রার্থী নিয়েই বেশি ব্যস্ত তাই ছোটখাটো দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ঘটনা ঘটছে। তবে তা খুবই কম।'
খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতা নাম না প্রকাশ করার শর্তে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রতিদিন মারামারি, হামলা-পালটা হামলা নিয়ে অভিযোগ এসেছে। সবাই আমাদের লোক। সবাই কাউন্সিলর হতে চান।'
'প্রভাবশালী বেশ কয়েকজন অন্য প্রার্থীদের উপর হামলা করেছেন। তাদেরকে চাপে রেখেছেন। কয়েকজন আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে,' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'এসব প্রভাবশালী কাউন্সিলর প্রার্থী ও তাদের সহযোগীদের কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।'
১৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম সেলিম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রথম থেকেই এই ওয়ার্ডে ঝামেলা চলছে। ২ শক্তিশালী প্রার্থী বিবাদে জড়াচ্ছেন। এতে আমি আতঙ্কবোধ করছি।'
'শান্তিপূর্ণ উপায়ে সবকিছু চললে আমার মতো অনেকেই ভোট দিতে যাবেন। মারামারি হলে আমি ভোট দিতে যাব না। সব প্রার্থীর উচিত শান্তিপূর্ণ উপায়ে ভোটের মাঠে থাকা,' যোগ করেন তিনি।
খুলনা সোনাডাঙ্গা থানার ওসি মমতাজুল হক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কোনো দলের প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটছে বলে শুনেছি। কেউ অভিযোগ বা মামলা দিলে ব্যবস্থা নেব।'
Comments