সুনামগঞ্জ: কর্মীসভার নামে জনসভা করছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা

নির্বাচনের নির্ধারিত দিন, অর্থাৎ ৭ জানুয়ারির তিন সপ্তাহ আগে এ ধরনের সভা ও জনসংযোগ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা ২০০৮ এর লঙ্ঘন।
রনজিত চন্দ্র সরকারের জনসভা
সুনামগঞ্জ-১ আসনের আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী রনজিত চন্দ্র সরকার তাহিরপুর উপজেলায় বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতিতে উন্মুক্ত জনসভায় অংশ নেন। ছবি: সংগৃহীত

সুনামগঞ্জ জেলার পাঁচটি আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা নির্বাচনী আচরণবিধি না মেনে জনসভা করছেন। তবে প্রার্থীদের দাবি তারা জনসভা নয়, বরং আচরণবিধি মেনে কেবলমাত্র কর্মীসভা আয়োজন করছেন।

নির্বাচনের নির্ধারিত দিন, অর্থাৎ ৭ জানুয়ারির তিন সপ্তাহ আগে এ ধরনের সভা ও জনসংযোগ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা ২০০৮ এর লঙ্ঘন।

গতকাল সুনামগঞ্জ-৫ আসনের নির্বাচন অনুসন্ধান কমিটির চেয়ারম্যান ও সিনিয়র সহকারী জজ বেলাল হোসেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মুহিবুর রহমান মানিককে আচরণবিধি লঙ্ঘন করে মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা, জনসভা, উঠান বৈঠকের নামে লোকসমাগম করার অভিযোগে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছেন।

তবে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে আচরণবিধি লঙ্ঘনের কোনো অভিযোগ কেউ দায়ের করেনি এবং কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি বলে জানিয়েছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা ও সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী।

সুনামগঞ্জ-১ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী রনজিত চন্দ্র সরকার মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক লোকের উপস্থিতিতে উন্মুক্ত জনসভায় অংশগ্রহণ করছেন।

গত রোববার রাতে তিনি তাহিরপুর উপজেলার বড়দল ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্সের সামনে এ ধরনের একটি সভায় অংশগ্রহণ করে বক্তব্য রাখেন। নির্বাচনী প্রচারণায় সরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যবহারও আচরণবিধির লঙ্ঘন।

এ ব্যাপারে রনজিত সরকার বলেন, 'আমার নির্বাচনী এলাকা অত্যন্ত প্রত্যন্ত ও অবহেলিত অঞ্চল। এখানে কর্মীসভা আয়োজনের জন্য কোনো হল না থাকায় বাধ্য হয়েই মাঠে বা সড়কের পাশে যেখানে জায়গা পাওয়া যায়, সেখানে উন্মুক্ত সভা আয়োজন করতে হয়। আমি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং কোনো আচরণবিধি লঙ্ঘন করিনি।'

সুনামগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মাহমুদকেও সম্প্রতি বিভিন্ন জনসভায় বক্তব্য দিতে দেখা গেছে। তবে তিনি দাবি করেছেন যে এসব জনসভা নয় বরং নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কর্মীসভা আয়োজন হচ্ছে বলে জানিয়েছেন।

সুনামগঞ্জ-২ আসনের আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মাহমুদ শনিবার শাল্লা উপজেলার মেদাবাজারে গণসংযোগ করেন ও জনসভায় অংশ নেন। ছবি: সংগৃহীত

তিনি বলেন, 'কর্মীসভাকে কেন্দ্র করে কিছু উৎসাহী কর্মীরা সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে দেন যার ফলে এসব সভায় জনসভার আদল চলে আসে। তবে নির্বাচনী আচরণবিধির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আমি কর্মীসভা ছোট পরিসরেই করেছি এবং মাইক্রোফোনও ব্যবহার করিনি।'

পরিকল্পনামন্ত্রী, সুনামগঞ্জ-৩ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী এম এ মান্নান তার সাম্প্রতিক সফরে একইভাবে কর্মীসভার নামে জনসভায় অংশ নেওয়ার অভিযোগ আছে।

এর মধ্যে অন্তত দুটি সভায়-- জগন্নাথপুর উপজেলার শ্রীরামসী এবং আরেকটি শান্তিগঞ্জ উপজেলার রামেশ্বরপুরে—কয়েকশ সাধারণ এলাকাবাসী উপস্থিত ছিলেন এবং মন্ত্রী মঞ্চে থেকে বক্তব্য রাখেন।

পরিকল্পনামন্ত্রী, সুনামগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ প্রার্থী এমএ মান্নান গত শনিবার শান্তিগঞ্জ উপজেলার রামেশ্বরপুরে ‘কর্মীসভা’র ব্যানারে উন্মুক্ত জনসভায় অংশ নেন। ছবি: সংগৃহীত

এ ব্যাপারে পরিকল্পনামন্ত্রীর বক্তব্যের জন্য তার ব্যক্তিগত সচিবের মাধ্যমে যোগাযোগ করে প্রশ্ন পাঠানো হলেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

সুনামগঞ্জ-৪ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক ধারাবাহিকভাবে পথসভা আয়োজন করছেন।

নির্বাচন কমিশনের সাবেক এ সচিবের নির্বাচনী পথসভার ৯ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের সময়সূচির একটি কপি এ প্রতিবেদকের কাছে এসেছে।

সুনামগঞ্জ-৪ আসনের আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ড. মোহাম্মদ সাদিক গত রোববার বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার চিনাকান্দি বাজারে জনসভায় অংশ নেন। ছবি: সংগৃহীত

ড. সাদিক বলেন, 'আমি যেহেতু তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সাথে তেমন পরিচিত নই, তাই এসব সভা কেবলমাত্র আমার পরিচিতি সভা হিসেবে আয়োজন করা হচ্ছে, নির্বাচনী সভা নয়। উৎসাহী নেতাকর্মীদের কারণে অনেক সময় এগুলো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তবে আইনের প্রতি অনুগত থেকে নির্বাচনী কোনো আচরণবিধি লঙ্ঘন না করার চেষ্টা করছি।'

সুনামগঞ্জ-৫ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মুহিবুর রহমান মানিকও বিভিন্ন কর্মীসভায় অংশগ্রহণ করছেন।

গত শুক্রবার তিনি ছাতক উপজেলার ছৈলা গ্রামে একটি স্কুলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এবং এ উপলক্ষে জনসভায় বক্তব্য রাখেন।

এ ব্যাপারে মুহিবুর রহমান মানিক বলেন, 'আমি নেতাকর্মীদের নিয়ে উঠান বৈঠকে অংশ নিয়েছি, জনসভা করিনি। এসব বৈঠকে মঞ্চও ছিল না, মাইক্রোফোনও ছিল না। নিতান্ত ব্যক্তিগত সভা। আর যে স্কুলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে ছিলাম তা সরকারি স্কুল নয়, বরং একটি ব্যক্তিগত স্কুল।'

সুনামগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মুহিবুর রহমান মানিক গত বৃহস্পতিবার ছাতক উপজেলার গোবিন্দগঞ্জে এক জনসভায় অংশ নেন। ছবি: সংগৃহীত

তিনি বলেন, 'আমি এই আসনে পাঁচ বার নির্বাচিত সংসদ সদস্য এবং এখন পর্যন্ত ১০ বার নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। আমি নির্বাচনী আচরণবিধি সম্পর্কে জানি এবং আচরণবিধি মেনেই উঠান বৈঠনে অংশ নিয়েছি, লোকসমাগমও করিনি, জনসভাও করিনি।'

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও সুনামগঞ্জের সব নির্বাচনী আসনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী বলেন, 'প্রতিটি উপজেলায় সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা এবং মাঠে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রয়েছেন। তবে এখন পর্যন্ত কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচনী নিয়ম লঙ্ঘনের কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। পেলে খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

তিনি বলেন, 'প্রতিটি আসনের জন্য স্বাধীন নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়েছে যারা আচরণবিধির লঙ্ঘনের বিষয়ে নজর রাখছেন ও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন।'

Comments