‘খাদ্যপণ্যের দাম অতিরিক্ত বাড়ছে, সব জায়গায় রিকশা নিয়ে যেতে পারি না, পুলিশ ধরে’

চায়ের আড্ডায় বিভিন্ন বিষয়ে কথা হলেও নিজের পরিচয় প্রকাশ করে মানুষ তার অধিকার নিয়ে কথা বলতে ভয় পান। স্বাধীনতার ৫২ বছর পরেও মানুষকে বাকস্বাধীনতা নিয়ে ভাবতে হয়। ছবিটি কারওয়ান বাজার এলাকা থেকে তোলা। ছবি: স্টার

'স্বাধীনতা অনেক লাইনে আছে, যেমন আমি একজন ভোটার। বর্তমান সময়ে আমি তো ভোট দিতে পারতেছি না, আমার স্বাধীনতাটা কেমনে আসল। আপনি একটা মামলায় পড়ছেন যদি এমপি-মন্ত্রী থাকে একটা ফোন দিয়ে দিবে মামলা শেষ, আর যদি না থাকে তাহলে তো নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার লাগে। লোক থাকলে মামলায় জেল খাটতে হবে না, জামিন হয়ে আইসব।'

কথাগুলো বলছিলেন রনি হাওলাদার (ছদ্মনাম)। আজ রোববার হোটেল সোনারগাঁও মোড়ে রনির স্বাধীনতা নিয়ে ভাবনা জানতে চাইলে এসব কথা বলেন।

রনির বাড়ি জামালপুরে। বয়স ৩২ থেকে ৩৫ বছর। তিনি মূলত একজন কৃষক। তবে কৃষি কাজ করে সংসার চলে না তাই ঢাকায় এসে এখন রিকশা চালাচ্ছেন।

রনি হাওলাদার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জিনিসপত্রের দাম এমনভাবে বাড়ছে সাধারণ মানুষের চলা বিশাল সমস্যা। আমি ঢাকা শহরে রিকশা চালাই। বাড়িতে এই ছোট কাজ করতে পারি না। সবাই পরিচিত। লজ্জা লাগে। সংসার চলে না। মানুষ এক প্রকার জিম্মি হয়ে আছে। ৭৫০ টাকা গরুর গোশত। সাধারণ মানুষ কয়জন খাইতে পারে? চাকরিজীবী আর ঘুষখোর ছাড়া কতজন গরুর গোশত খাইতে পারে?'

রনির ভাষ্য, 'একটা মানুষ গ্রামে কাজ করলে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা পায়। সারাদিন কাজ করে তো ১ কেজি গরুর গোশতের দাম আয় করতে পারে না। খাবে কেমনে। বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের দাম অতিরিক্ত বাড়ছে। সব জায়গায় রিকশা নিয়ে যেতে পারি না। পুলিশ ধরে। টাকা নেয়। স্বাধীনতা নাই আমাগো।'

৭০ বছর বয়সী আলী মিয়ার ভাবনা একটু অন্যরকম। তার মতে, ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হয়েছে এটা ভালো। কিন্তু এখন তো আর মানুষ ভালো নেই।

আলী মিয়া রাজধানীতে ভাঙাড়ি কুড়ান। প্রতিদিন তার ২০০ থেকে ৩০০ টাকা আয় হয়।

আলী মিয়ার অভিযোগ, তিনি যেখানে ভাঙাড়ি বিক্রি করেন সেখানে তার সঙ্গে অনিয়ম করা হয়। ওজন ঠিক মতো দেওয়া হয় না। ঠিক মতো দাম পেলে তার আয় ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেশি হতো। তার মতে সবকিছু স্বাধীনভাবে হলে কোনো অনিয়ম হতো না। মানুষ এখন আর ভালো নেই।

মানুষ কেন ভালো নেই জানতে চাইলে আলী মিয়া বলেন, 'করোনার সময় বহুত লোক গরিবের টাকা মারি খাইছে। সরকার দিছে ১০ টাকা। গরিবে পাইছে ২ টাকা। গরিবের জন্য যে সাহায্য আইছে তা ঠিক মতো পাই নাই। ঠিক মতো পাইলে ৬ মাস ঘরে বসে খাইতে পারতো। নাম নিয়ে গেছে কিন্তু টাকা দেয়নি। টাকা দিবে এ জন্য আমাদের কাছে টাকাও নিছে, কিন্তু কিছু দেয়নি।'

আলী মিয়া বলেন, 'সরকার ঠিক আছে, কিন্তু কাউয়া ঠিক নেই। এক কাউয়া খাইতে লইলে আরেক কাউয়া আইয়া ঝাইপ্পা পড়ে। কাউয়াদের কারণে মানুষ ঠিক মতো সরকারি সুবিধা পায় না।'

আলী মিয়ার দাবি, তার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। কিন্তু কোনো কাগজ না থাকায় তারা কোনো সুযোগ সুবিধা পান না।

সারাদিনে কী খান জানতে চাইলে আলী মিয়া বলেন, 'সকালে ডাইল-ভাত খাই। দুপুরে আল্লাহ যা খাওয়ায় ভাজিভুজি দিয়া। রাতেও ডাইল ভাজিভুজি দিয় খাই। মাছ-মাংসের দিকে তাকাতে পারি না। তাকালে আমি যে টাকা কামাই ২ টাকাও থাকবে না।'

মাছ-মাংস সর্বশেষ কবে খেয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, '৩ দিন আগে পাঙাশ মাছের একটা পিস আর দেড় প্লেট ভাত খাইছিলাম। ৬০ টাকা নিছিল। ৬ মাস হলো মাংসের দিকে তাকাইনি।'

ফার্মগেটে কথা হয় মো. হৃদয়ের সঙ্গে। ৪ জন মিলে ফুটপাতে বসে ছিলেন। এই ফুটপাতই তাদের ঠিকানা। হৃদয়ের বয়স আনুমানিক ২০ থেকে ২২ বছর। স্বাধীনতা দিবস কী জানতে চাইলে হৃদয় বলেন, 'স্বাধীনতা দিবস মানে জয় বাংলা। পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ হইছিল।'

হৃদয়ের ছবি তুলতে চাইলে প্রতিবেদকে জিজ্ঞেস করে আপনি কি পুলিশের লোক? কেন পুলিশের লোক মনে হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'কাইলকা জেল থেকে বাহির হইছি। ১ মাস জেলে ছিলাম।'

জেলে গেছিলেন কেন জানতে চাইলে বলেন, 'হুদাহুদি ভাই। রাতে ওভারব্রিজের ওপর উঠে ভাত খাচ্ছিলাম, খামাখা ধরে নিয়ে জেলে দিছে। উকিলকে আড়াই হাজার টাকা দিয়ে মা বাহির করছে।'

সারাদিন কী খান এবং আজকে কী খাবেন জানতে চাইলে হৃদয় বলেন, 'ভাত খাই ডাইল, ভর্তা, ভাজি দিয়া। আজও সেগুলাই খামু। কোনো বেলা খাই কোনো বেলা খাই না। এভাবেই চলি।'

এই সময় পাশে একজনকে মাদক (জুতার আঠা) নিতে দেখা যায়। তার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে হৃদয় বলেন, 'ভাই, ওর লগে কথা বইলেন না। ও খারাপ।'

জুতার আঠা কেন খায় জানতে চাইলে হৃদয় বলে, 'কইতে পারি না ভাই। আমি খাই না।'

Comments

The Daily Star  | English
Kudos for consensus in some vital areas

Kudos for consensus in some vital areas

If our political culture is to change, the functioning of our political parties must change dramatically.

2h ago