বর্জ্য যখন মহাসড়কে

ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের গেন্ডা এলাকায় সাভার পৌরসভার ভবন। দেশের ‘ক’ সারির এই পৌরসভাটি গঠনের প্রায় ৩০ বছর পার হলেও এখনও পৌর বর্জ্য অপসারণে কোনো নির্ধারিত স্থান নির্বাচন করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।
বর্জ্যের দুর্গন্ধে গেন্ডা এলাকা পার হতে ভোগান্তিতে পরেন মানুষ। ছবি: স্টার

ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের গেন্ডা এলাকায় সাভার পৌরসভার ভবন। দেশের 'ক' সারির এই পৌরসভাটি গঠনের প্রায় ৩০ বছর পার হলেও এখনও পৌর বর্জ্য অপসারণে কোনো নির্ধারিত স্থান নির্বাচন করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।

বর্তমানে পৌর কর্তৃপক্ষ বর্জ্য অপসারণের জন্য পৌর ভবনের পাশে পৌরমার্কেটের জন্য নির্ধারিত স্থানটি অস্থায়ী ডাম্পিং স্টেশন হিসেবে ব্যবহার করছে। বর্জ্য এনে রাখা হচ্ছে মহাসড়কের ওপরেই।

ডাম্পিং স্টেশনটি থেকে বর্জ্য যায় সাভারের কমলাপুর এলাকায়। অস্থায়ী এই ডাম্পিং স্টেশনের কারণে চরম ভোগান্তির কথা জানিয়েছেন পৌরসভায় সেবা নিতে আসা মানুষ, পৌর কর্মকর্তা-কর্মচারী, মহাসড়ক দিয়ে চলাচলকারী মানুষ, পাশের কাঁচাবাজারের ক্রেতা-বিক্রেতা, এমনকি খোদ সাভার পৌরসভার মেয়র হাজী আব্দুল গনি।

স্থানীয়রা বলছেন, পৌরসভার বিরুদ্ধে নদীপাড়, মহাসড়কের পাশসহ যত্রতত্র বর্জ্য ফেলার অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। সম্প্রতি জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান পৌর মেয়রকে নদী ও খালে বর্জ্য না ফেলতে কঠোর নির্দেশনা দেন। নির্দেশনার পর নদীপাড়ে বর্জ্য ফেলা বন্ধ করলেও পৌরভবনের পাশের খোলা যায়গাটি অস্থায়ী ডাম্পিং স্টেশন হিসেবে ব্যবহার করায় ভোগান্তি বেড়েছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, পৌর পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা পৌরসভার বর্জ্যগুলো প্রথমে মহাসড়কের ওপরে ফেলছেন। সেখান থেকে এক্সকেভেটরের মাধ্যমে স্তূপ করা বর্জ্য ওই খোলা মাঠে ঠেলে নেওয়া হচ্ছে।

দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পরিচ্ছন্নতা কর্মী বলেন, 'প্রথমে আমরা ময়লা সরাসরি ভ্যান ও পিকআপে করে মাঠের ভেতরে নিতে পারতাম। মাঠে বৃষ্টির পানি জমার কারণে এখন ভ্যান মাঠে নামানো যায় না। এজন্য প্রথমে সড়কের একপাশে ময়লা ফেলা হয়। এরপর সেগুলো এক্সকেভেটরের মাধ্যমে ঠেলে মাঠের ভেতর নিয়ে যাওয়া হয়।'

সাভার পৌরসভায় সেবা নিতে আসা আব্দুর রউফ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পৌরসভার পাশে ময়লার ভাড়ার। দুর্গন্ধে পৌরভবনে থাকাই দায়।'

মহাসড়ক দিয়ে নিয়মিত চলাচলরত যাত্রী পোশাক শ্রমিক আব্দুল আলী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বর্জ্যের দুর্গন্ধে গেন্ডা এলাকা পার হতে দম বেড়িয়ে যাওয়ার অবস্থা হয়। এগুলো ভোগান্তি ছাড়া আর কিছু না।'

গেন্ডা কাঁচাবাজারের ব্যবসায়ী ও সাবেক পৌর কাউন্সিলর আয়নাল হক গেদু দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পৌর ভবনের পাশে বর্জ্য ফেলায় ভোগান্তির শেষ নেই। আসলে আমরা দুর্গন্ধ পোহাচ্ছি। পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও একই অবস্থা। মেয়র নিজেও বিষয়টি নিয়ে ঝামেলায় আছেন।'

সাভার নদী ও পরিবেশ উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ড. রফিকুল ইসলাম মোল্লা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পৌর কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব বর্জ্য অপসারণে স্থায়ী ডাম্পিং স্টেশন নির্মাণ করা। যত্রতত্র বর্জ্য ফেলা মানেই পৌরবাসীর ভোগান্তি।'

সাভার পৌরসভার কনজারভেনসি পরিদর্শক মো. রিয়াজুদ্দিন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সাভার পৌর এলাকার আওতাধীন ৩০ হাজারের বেশি বাসা-বাড়ি ও শতাধিক মিল কারখানা থেকে প্রতিদিন গড়ে ৪০০ টন বর্জ্য উৎপাদিত হয়। এই বর্জ্যগুলোর কিছু সরাসরি গাড়িতে করে কমলাপুর ডাম্পিং স্টেশনে নেওয়া হয় এবং কিছু পৌরসভা ভবনের পাশে এনে জড়ো করে তারপর কমলাপুর নেওয়া হয়।'

পৌরসভা কার্যালয়ের সামনেই মহাসড়ককে অস্থায়ী ডাম্পিং স্টেশন হিসেবে ব্যবহার করছে পৌর কর্তৃপক্ষ। ছবি: স্টার

তিনি আরও বলেন, 'দীর্ঘদিনেও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও অপসারণের জন্য জমি নির্ধারণ করতে না পারায় এই বিপুল পরিমাণ বর্জ্য নিয়ে আমাদেরও বেশ ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। কয়েক দফায় জেলা ও উপজেলা প্রশাসন বরাবর খাস জমি বরাদ্দ চেয়ে চিঠি দিলেও এখন পর্যন্ত কোনো ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি।'

সাভার পৌরসভার মেয়র হাজী আব্দুল গণি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দীর্ঘদিন চেষ্টা করেও আমরা আজ পর্যন্তও বর্জ্য অপসারণের জন্য কোনো জমি নির্ধারণ করতে পারিনি। পৌর এলাকার কোথাও অস্থায়ী ডাম্পিংয়ের জায়গা না পেয়ে নিরুপায় হয়েই পৌরভবনের পাশে অস্থায়ী ডাম্পিং স্টেশন করতে হয়েছে। ময়লার দুর্গন্ধে আমরাও পৌর ভবনে টিকতে পারি না। কি করতে পারি বলেন?'

তিনি আরও বলেন, 'খাস জমি বন্দোবস্ত চেয়ে বেশ কয়েক দফায় উপজেলা ও জেলা প্রশাসনকে চিঠি দিয়েও কোনো সাড়া পাইনি। সর্বশেষ আমরা ফিনল্যান্ডের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছি। তারা এখানে একটি বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য একটি প্লান্ট করতে চায়। যেখানে তারা বর্জ্য রিসাইকেল করে এনার্জি উৎপাদন করবে। কিন্তু এর জন্যে প্রয়োজন অন্তত ১৫ একর জমি। এই জমি পেলে প্রতিষ্ঠানটি তাদের কার্যক্রম শুরু করতে পারবে।'

বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় পৌরসভার বাৎসরিক ব্যয়

সাভার পৌরসভা থেকে তথ্য অধিকার আইনে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বর্জ্য সংগ্রহ, পরিবহণ ও অপসারণের কাজে মাস্টার রোলে দৈনিক মজুরিভিত্তিক মোট ২৬৮ জন কর্মচারী নিয়োজিত আছে। দৈনিক হারে প্রত্যেকের মজুরি ২৭৫ টাকা। তবে যারা রাত্রিকালীন বর্জ্য পরিবহণের কাজে নিয়োজিত থাকে তাদের মজুরি দেওয়া হয় ৩১০ টাকা হারে।

এসব বর্জ্য সংগ্রহ ও পরিবহণে বর্তমানে পৌরসভার মোট ৪টি হাইড্রোলিক ট্রাক, ২টি কন্টেইনার ট্রাক, ২টি মাহেন্দ্র ট্রলি, ২টি ট্রাক্টর, একটি টাটা ট্রাক ও মোট ৬৮টি ভ্যান রয়েছে।

তবে, এই পরিমাণ পরিবহন বিপুল বর্জ্য সংগ্রহ ও পরিবহণের জন্য যথেষ্ট নয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা।

সাভার পৌরসভার হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. সামসুদ্দিন বলেন, 'পৌর এলাকার বর্জ্য অপসারণে প্রতি বছর পৌর কর্তৃপক্ষের ব্যয় হয় গড়ে প্রায় ৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে প্রায় ২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয় হয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজে নিয়োজিত দৈনিক মজুরিভিত্তিক শ্রমিকদের মজুরি বাবদ। বাকি ৫০ লাখ টাকা ব্যয় হয় বর্জ্য পরিবহণের কাজে ব্যবহৃত গাড়ির জ্বালানি, রক্ষণাবেক্ষণসহ আনুষঙ্গিক কারণে।'

১৯৯১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করা সাভার পৌরসভা ৯টি ওয়ার্ডে বিভক্ত। ১৪ দশমিক শূন্য ৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে গঠিত এই পৌরসভার বর্তমান জনসংখ্যা বেসরকারি হিসাবে ৮ লাখের বেশি।

Comments