টাকা আছে টাকা নেই ডলার আছে ডলার নেই, আছে সংকট

টাকা আছে, টাকা নেই। ডলার আছে, ডলার নেই। টাকা-ডলার থাকলেও আলোচনায় আছে, না থাকলেও আলোচনায় আছে। সরকারের ভাষ্য, টাকার কোনো সংকট নেই। ব্যাংকগুলোতে পর্যাপ্ত টাকা আছে। ডলারের কোনো সংকট তো নেই-ই।
জনভোগান্তি

টাকা আছে, টাকা নেই। ডলার আছে, ডলার নেই। টাকা-ডলার থাকলেও আলোচনায় আছে, না থাকলেও আলোচনায় আছে। সরকারের ভাষ্য, টাকার কোনো সংকট নেই। ব্যাংকগুলোতে পর্যাপ্ত টাকা আছে। ডলারের কোনো সংকট তো নেই-ই।

গণমাধ্যমের সংবাদের সঙ্গে যা ব্যাপক গড়মিল। রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন শুরুর ২৭ দিনের মাথায় বন্ধ হয়ে গেছে। কয়লা সংকটে, মানে আমদানি করে আনা কয়লা ফুরিয়ে গেছে। ডলারের অভাবে ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা আমদানির এলসি খোলা যায়নি। ডলার সংকট কাটলে এলসি খোলা হবে, কয়লা আসলে শুরু হবে উৎপাদন। বন্ধ থাকার সময়কালে তারা পাবে 'ক্যাপাসিটি চার্জ'।

প্রশ্ন হলো, যদি ডলারের সংকট না থাকে, তাহলে কয়লা আমদানি করা গেল না কেন? কেন রেন্টাল, কুইক রেন্টালের মতো বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রেও 'ক্যাপাসিটি চার্জ'র ফাঁদে পড়তে হলো?

ব্যাংকে পর্যাপ্ত পরিমাণ টাকা থাকলে ইসলামি ব্যাংকগুলোকেও কেন ৯ শতাংশ সুদে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হলো?

সরকার আইএমএফের থেকে ঋণ নিচ্ছে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার, যা প্রায় ৪৮ হাজার কোটি টাকা। এই ঋণ পাওয়ার জন্য সরকারকে অনেকগুলো শর্ত মানতে হচ্ছে। রিজার্ভ বেশি দেখানোর যে নীতিতে সরকার অটল ছিল, সেই নীতি পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছে। রিজার্ভ থেকে অন্যত্র ব্যয় করা ৮ বিলিয়ন ডলার হিসেবে দেখানো যাবে না। দেশীয় বিশেষজ্ঞদের এই যুক্তি সরকার এতদিন ধর্তব্যের মধ্যে নেয়নি। আইএমএফের শর্ত বা চাপে যা মেনে নিয়েছে।

আইএমএফের যে শর্তে জনমানুষ আরও ভোগান্তিতে পড়বে, সেই শর্তও সরকার মেনে নিয়েছে ঋণ পাওয়ার স্বার্থে। সেই শর্তের নাম 'ভর্তুকি' কমাতে হবে। তার অংশ হিসেবে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো। জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, এখন থেকে প্রতি মাসে দাম 'সমন্বয়' করা হবে।

বলে রাখা দরকার যে, সরকার দাম সমন্বয় বলতে শুধু দাম বাড়ানোই বোঝায়। সাধারণ অর্থে সমন্বয় বলতে বোঝানো হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়া-কমার সঙ্গে মিল রেখে দেশের বাজারেও বাড়বে-কমবে। যেমন: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে জ্বালানি তেলের মূল্য ব্যারেল প্রতি বেড়ে ৯০ ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এখন আবার তা ৭৯-৮৫ ডলারের মধ্যে নেমে এসেছে। দেশে তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল, কিন্তু কমানো হচ্ছে না।

দেশে প্রায় ৪-৫ কোটি মানুষ গরিব। তারা সংকটে আছেন, কষ্টে আছেন, সরকারের মন্ত্রী-নেতারাও তা স্বীকার করছেন। কিন্তু জনজীবনে কষ্ট-দুর্ভোগ বাড়ানোর কাজ থেকে বিরত থাকছেন না। আইএমএফের শর্তের কারণে থাকতে পারছেনও না। বিদ্যুতের পর এখন গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে। এরপর পর্যায়ক্রমে বাড়বে জ্বালানি তেল, পানি ও সারের দাম। তারপর আবার বাড়বে বিদ্যুতের দাম। ফলশ্রুতিতে আগামী দিনগুলোতে বাড়বে চাল-ডাল, শাক-সবজি, মাছ-মাংসসহ প্রতিটি জিনিসের দাম। গৃহস্থালির জ্বালানি খরচ তো বাড়বেই, বাড়বে বাড়ি ভাড়া, বাড়বে পরিবহন খরচ, বাড়বে কৃষকের উৎপাদন খরচ, বাড়বে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার পেছনে খরচ।

মেগা প্রকল্পসহ প্রায় সব প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বেড়েছে, দুর্নীতি হয়েছে। টাকা পাচার হয়েছে। সরকার ব্যবস্থাও নেয়নি, স্বীকারও করতে চায়নি। এখন এসে দুবাই-লন্ডন-নিউইয়র্ক-বেগম পাড়ায় টাকা পাচারকারীদের বাড়ি-সম্পদের সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। প্রকাশিত সংবাদ বিষয়েও সরকারের নীরবতা লক্ষণীয়।

৪-৫ কোটি গরিব মানুষের আয় বাড়বে না। আয় বাড়বে না নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তের। ফলে তাদের নিম্নমুখী শ্রেণিচ্যুতি ঘটবে। জীবন হয়ে পড়বে আরও দুর্বিষহ। ফলে গরিব আরও গরিব হবে, ধনী হবে আরও ধনী। অক্সফামের সমীক্ষায় উঠে এসেছে, বিশ্বের ৪২ ট্রিলিয়ন সম্পদের ৬৭ শতাংশ ১ শতাংশ ধনীর হাতে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সঠিক কোনো সমীক্ষা নেই। তবে সেই সত্য হয়ত বিশ্ব পরিপ্রেক্ষিতের চেয়েও অনেক বেশি মর্মান্তিক।

সরকারের অবস্থান থেকে একটি বিষয় বারবার বলা হচ্ছে, সবই ঠিক ছিল, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণেই সংকট তৈরি হলো। বিষয়টি কী আসলেই তাই? কোনো সন্দেহ নেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক সংকট তৈরি করেছে। যার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট তৈরির একমাত্র বা অন্যতম কারণও নয়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকটের অন্যতম কারণ অব্যবস্থাপনা ও ভুল নীতি। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ না হলেও যা অনিবার্য ছিল। যেমন: সরকার ২০০৯ সালে যাত্রা শুরু করেছিল সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ নিয়ে। এখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। এর সঙ্গে মামলা ও অবলোপন যোগ করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ ৩-৪ লাখ কোটি টাকা। এর সঙ্গে কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের তেমন কোনো সম্পর্ক নেই, সম্পর্ক আছে ঋণ খেলাপিদের প্রতি নমনীয় নীতির।

মেগা প্রকল্পসহ প্রায় সব প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বেড়েছে, দুর্নীতি হয়েছে। টাকা পাচার হয়েছে। সরকার ব্যবস্থাও নেয়নি, স্বীকারও করতে চায়নি। এখন এসে দুবাই-লন্ডন-নিউইয়র্ক-বেগম পাড়ায় টাকা পাচারকারীদের বাড়ি-সম্পদের সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। প্রকাশিত সংবাদ বিষয়েও সরকারের নীরবতা লক্ষণীয়।

বিদ্যুৎখাতের অনিয়ম-দুর্নীতি, ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে গিয়েও অর্থনীতি ধাক্কা খেয়েছে। এখন বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসতে থাকবে, পাশাপাশি আসবে আমদানি করা উচ্চমূল্যের বিদ্যুৎ। এখানেও ক্যাপাসিটি চার্জের ফাঁদ থেকেই যাচ্ছে। ডিজেলভিত্তিক ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ থাকলেও, চাহিদার তুলনায় কাগজের সক্ষমতা বেশি থাকবে। থাকবে ক্যাপাসিটি চার্জ।

আগামী দিনে বৈশ্বিক মন্দার ঝুঁকি বাড়ছে। যা থেকে মুক্ত থাকবে না বাংলাদেশও। আইএমএফের ঋণে সরকার হয়ত সাময়িক স্বস্তিতে থাকবে, কিন্তু দেশের মানুষের অস্বস্তি কয়েকগুণ বাড়বে। নির্বাচনকে সামনে রেখে অস্থিরতা বাড়বে রাজনীতিতে। দেশি-বিদেশিরা তা নিয়ে তৎপর থাকবে।

জনগণের বেঁচে থাকার, জীবনের অস্থিরতা দূর করবে কে?

[email protected]

Comments