এসএসসি দিচ্ছেন হাজেরার আরেক সন্তান

জীবন তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে অনেক। তবে মুঠোভরে ফিরিয়ে দিতেও দ্বিধা করেনি। পরিস্থিতির শিকার হয়ে শৈশবে যৌন পেশায় জড়িয়ে যাওয়া হাজেরা বেগম কখনো বিয়ে না করলেও যাদের কেউ থেকেও নেই তেমন ৪০ সন্তানের মা তিনি। যারা সবাই তাকে ‘আম্মু’ বলে ডাকে।
হাজেরা বেগম
হাজেরা বেগম। ছবি কৃতজ্ঞতা: শিশুদের জন্য আমরা

জীবন তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে অনেক। তবে মুঠোভরে ফিরিয়ে দিতেও দ্বিধা করেনি। পরিস্থিতির শিকার হয়ে শৈশবে যৌন পেশায় জড়িয়ে যাওয়া হাজেরা বেগম কখনো বিয়ে না করলেও যাদের কেউ থেকেও নেই তেমন ৪০ সন্তানের মা তিনি। যারা সবাই তাকে 'আম্মু' বলে ডাকে।

হাজেরা বেগমের ভাষায়, নিজে কখনো সন্তান পেটে না ধরলেও, যৌনকর্মীদের ছেলেমেয়েদের নিরাপদ আশ্রয় দেওয়ার উদ্দেশ্যে শুরু করা শেল্টার তাকে মাতৃত্বের স্বাদ দিয়েছে। আর এই সন্তানেরা বিদ্যায় বুদ্ধিতে একেকজন তাকে রীতিমতো চমকে দিচ্ছে। এরা কেউই এখন আর তাদের মায়ের পেশা নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগে না।

কথাগুলো বলতে গিয়ে চোখ চিকচিক করলেও সন্তানদের সাফল্যে গর্বের এক দ্যুতি ফুটে ওঠে।

হাজেরার শেল্টার "শিশুদের জন্য আমরা" থেকে এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে শিমুল (ছদ্মনাম)। শিমুলকে আদাবরের একটি প্রাইভেট স্কুলে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে পড়িয়েছেন হাজেরা। স্কুলের পাশাপাশি প্রাইভেট টিউশনেরও ব্যবস্থা করেছেন, যাতে পড়াশোনায় কোনো ব্যাঘাত না ঘটে। বড় হয়ে ব্যাংকার হতে চায় ছেলেটি।

শিমুল ছাড়াও, এ বছর স্নাতকে ভর্তি হয়েছে হাজেরার বড় মেয়ে ফাল্গুনী (ছদ্মনাম)। এ বছর জিপিএ ৪ দশমিক ০৮ পেয়ে মানবিক বিভাগ থেকে এইচএসসি পাশ করেছে। জন্ম নিবন্ধন সার্টিফিকেটেও মায়ের নাম - হাজেরা বেগম। গত বছর এসএসসি পাশ করে এখন ইন্টারমিডিয়েটে পড়ছে আরও দুজন। আরও কয়েকজন পড়ছে বিভিন্ন স্কুলে।

শেল্টারটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হাজেরা বেগম জানান, এর শুরু মূলত ২০১০ সালে। তখন তার সন্তানের সংখ্যা ছিল ২৫।

২৩ বছর বয়স পর্যন্ত যৌনকর্মী হিসেবে থাকলেও ২০০০ সালের দিকে যৌনকর্মীদের শিশুদের নিয়ে কাজ শুরু করেন। তখন মূলত কেয়ার বাংলাদেশ পরিচালিত শেল্টার "দুর্জয় শিশু নিবাস"-এ কাজ করতেন। ২০০৮ সালে বিদেশি সহায়তা বন্ধ হয়ে গেলে অনেককেই তাদের মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে হয় বলে জানান হাজেরা।

কিন্তু হাজেরা বেগম চাইতেন মেয়েগুলো তাদের মায়েদের মতো যৌন পেশায় না জড়াক। আর সে উদ্দেশ্যেই ২০১০ সালে নিজের জমানো টাকা আর আগের পৃষ্ঠপোষকদের সহায়তায় গড়ে তোলেন তার নিজস্ব শেল্টার- 'শিশুদের জন্য আমরা'। প্রথমে সাভারে থাকলেও বছরখানেক পরে চলে আসেন রাজধানীর আদাবরে।

হাজেরা বেগমের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শিমুলের বয়স যখন দেড় বছর, তখন তার মা তাকে দুর্জয় শিশু নিবাসে নিয়ে আসেন।

'কেমন শুকনো আর হাড় জিরজিরে শরীর ছিল ওর। খুবই অসুস্থ থাকতো জন্মের পর থেকেই। শুনেছি জন্মের পরপরই পেটের অপারেশন করতে হয়েছিল। ওর মার তখন খুবই অসহায় অবস্থা। এরমধ্যে ওর বাবা ওদের ছেড়ে চলে যান। ওর মা খাওয়ার জন্য ভাতের মাড় ছাড়া আর কিছুই দিতে পারছিলেন না। জীবন বাঁচাতে না পেরে শেল্টারে নিয়ে এসেছিল ওকে,' বলেন হাজেরা।

'তখন দুর্জয়ে মাসে একবার ডাক্তার দেখানো যেত। অথচ ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হতো প্রতি সপ্তাহে। আমরা শাড়ির আঁচলে পেঁচিয়ে শিশু হাসপাতালে নিয়ে যেতাম।'

পরবর্তীতে দুর্জয় বন্ধ হয়ে গেলে কিছুদিন মায়ের কাছে ছিল শিমুল। এরপর ২০১০ সালে চলে আসে শিশুদের জন্য আমরা-তে।

'এখন শিমুলের বয়স ১৬। এখন কিন্তু আর সে রোগাটে নেই,' হেসে বলেন হাজেরা।

চোখ ভর্তি জল নিয়ে বলেন, 'আমি সবার মতো ওর জন্যও সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। আমার চেষ্টা আর ওর অধ্যবসায়ের জন্যে ও এবার এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে, বলে বোঝাতে পারব না।' 

'ওর মা বছরে এক-দুবার আসেন। পেশা ছেড়েছেন অনেক আগেই। তবে শিমুলের ওসব নিয়ে একদম মাথাব্যথা নেই,' বলেন হাজেরা।

কথা হয় শিমুলের সঙ্গে। বলে, পরীক্ষা ভালোই হচ্ছে।

'সবই সম্ভব হয়েছে "আম্মু"র জন্য'। সবার কাছে দোয়া চায় সে।

হাজেরা নিজে লেখাপড়া না করলেও চেয়েছেন তার এই সন্তানেরা পড়াশোনা করুক। মাথা উঁচু করে সমাজে দাঁড়াক। যৌনকর্মীর সন্তান পরিচয় দিতে যাতে তাদের কুণ্ঠাবোধ না হয়।

হাজেরার যে সন্তানেরা বড় হয়েছে, কিন্তু পড়াশোনা করা হয়নি, হাজেরা তাদের কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করছেন। যাতে করে তারা কোনো না কোনো কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে।

হাজেরার জন্য এখন সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ নিজস্ব একটি ভবন।

হাজেরা বলেন, 'ছেলে-মেয়েরা বড় হচ্ছে। চাইলেও এখন এতজনকে একই সাথে এক ফ্লোরে রাখা যায় না। বড় ছেলেদের ইতোমধ্যেই আমি বিভিন্ন জায়গায় রাখছি। আমার বোনের কাছে রেখেছি একজনকে। কয়েকজনকে তাদের মায়ের কাছেও পাঠিয়ে দিতে হয়েছে। কিন্তু আমার ছেলে-মেয়েরা সবাই এক সাথে থাকতে চায়। এমন যদি হতো ছেলে-মেয়েদের আলাদা ফ্লোরে রাখতে পারতাম, তাহলে খুবই ভালো হতো।'

৪০ সন্তানের এই জননী সবসময়ই চেয়েছেন সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের আশ্রয় দিতে। আর সেজন্য হলেও এই শেল্টারকে এখন বড় রূপ দিতে চান তিনি।

সমাজের বিত্তবান মানুষদের সহায়তায় চলছে ওদের পড়াশোনা, থাকা-খাওয়ার খরচ। হাজেরা জানান, কোনো প্রতিদানের আশায় তিনি এই সন্তানদের মানুষ করছেন না।

'একটাই আশা, ওরা নিজ যোগ্যতায় বড় হোক, তাদের মায়েদের পাশে দাঁড়াক। সমাজ আর দেশের মুখ উজ্জ্বল করুক।'

Comments

The Daily Star  | English
Dengue deaths in Bangladesh 2024

4 more die of dengue

660 patients were also hospitalised during this time

1h ago