জেলে ছদ্মবেশে নাফ নদীতে মাদক চোরাকারবার

স্টার ফাইল ছবি

নাফ নদীতে মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞায় নজরদারির শিথিলতার সুযোগ নিয়ে মিয়ানমার থেকে টেকনাফ ও কক্সবাজার হয়ে ইয়াবা ঢুকছে দেশে। একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও মাদক চোরাকারবারির তথ্য মতে, জেলে পরিচয়ে এসব মাদক চোরাচালান আনা হচ্ছে।

মাদক চোরাচালান বন্ধে ২০১৭ সালের আগস্টে নাফ নদীতে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা দেয় সরকার। নিষেধাজ্ঞা এখনো বলবৎ থাকলেও মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের একাংশ ও নৌকা মালিক সমিতির নেতাদের মদদপুষ্ট স্থানীয় মাদক চোরাকারবারিরা মাছ ধরার নামে নৌকা নিয়ে চলাচল করছে নদীতে।

সূত্র জানায়, জেলে বেশে চোরাকারবারিরা আগে থেকে ধরে রাখা মাছের নিচে মিয়ানমার থেকে আসা মাদক লুকিয়ে নিয়ে আসেন।

টেকনাফে মাছ ধরার যেসব নৌকা দেখা যায়, তার থেকে একটু ছোট আকারের নৌকা বানাতে চোরাকারবাবিরা প্রায় ৬ থেকে ৮ লাখ টাকা খরচ করেন বলেও জানান তারা।

মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম স্বীকার করেন, কিছু মাছ ধরার নৌকা নদীতে যাচ্ছে।

গত ২৮ সেপ্টেম্বর দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'যখনই আমরা তথ্য পাই, তখনই ব্যবস্থা নিই।'

তিনি আরও বলেন, 'আমরা বিজিবি কমান্ডারদের সঙ্গে বৈঠকের সময় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করি। মূলত তারাই সীমান্তের দায়িত্বে।'

গত ৫ অক্টোবর যোগাযোগ করা হলে টেকনাফের সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন  জানান, নদীতে মাছ ধরতে যাওয়া নৌকাগুলো আকারে ছোট।

তিনি বলেন, 'ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনার জন্য আমাদের পর্যাপ্ত জনবল ও সংস্থান না থাকায় প্রায়সই এসব নৌকার বিষয় উপেক্ষা করতে হয়৷'

চোরাকারবারি কারা

টেকনাফের ডাঙ্গুয়ারপাড়া এলাকার জেলে শাহ আলমকে মাদক চোরাকারবারি হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে পুলিশ। সূত্র জানায়, সম্প্রতি তিনি মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আনার ডিলার হিসেবে কাজ শুরু করেছেন।

তার নম্বরে কল করা হলে তা বন্ধ দেখানোয় দ্য ডেইলি স্টার তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি।

এই চোরাকারবারিরা মূলত রোহিঙ্গা পুরুষদের তাদের নৌকায় নিয়োগ দেন। কারণ তারা মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আনার পথ জানে।

একসময় এই ধরনের নৌকায় কাজ করা এক রোহিঙ্গা জানান, চোরাকারবারিরা প্রতিবার সফলভাবে ইয়াবা আনতে পারলে ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা পান।

দ্য ডেইলি স্টার এমন একজনের সঙ্গে কথা বলেছে, যিনি মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আনতেন। তবে, এখন এই অপরাধের পথ ছেড়ে দিয়েছেন।

তিনি বলেন, 'বাহকরা সীমান্তে ঝুঁকি নিয়ে ইয়াবা আনলেও মূল লাভ করে নেয় ডিলাররা। তাহলে বাহকরা কেন ডিলার হবে না?'

সূত্র জানায়, টেকনাফের কায়াক খালি খাল, জালিয়াপাড়া, স্লুইস গেট এলাকার নৌকা মালিক ও জেলেরা মূলত এই অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

কায়াক খালি খাল এলাকায় চোরাকারবারিরা সম্প্রতি অন্তত ৮০টি নৌকা তৈরি করেছে। এই নৌকাগুলো নিবন্ধন ছাড়াই ব্যবহার করা হচ্ছে বলে তারা জানিয়েছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জেলে বলেন, কায়াক খালি খাল নৌকা মালিক সমিতি কর্তৃপক্ষকে 'ম্যানেজ' করতে প্রতি মাসে জেলেদের কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা করে আদায় করা হয়।

সমিতির সভাপতি আব্দুল জলিল জানান, ৭৩টি নৌকার নিবন্ধনের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জমা পড়েছে।

তিনি বলেন, 'আমরা শিগগির অন্যান্য মাছ ধরার নৌকার নিবন্ধনের জন্য আবেদন করব।'

জেলেদের কাছ থেকে সমিতির টাকা আদায়ের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, 'সমিতি নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের জন্য নৌকার আকারের ওপর নির্ভর করে জেলেদের কাছ থেকে মাত্র ১২ হাজার থেকে ১৪ হাজার টাকা আদায় করে।'

তিনি আরও বলেন, 'আমরা কোনো বেআইনি কাজের সঙ্গে জড়িত না।'

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী সমিতির টেকনাফ শাখার সভাপতি আবদুস সালাম বলেন, 'আমরা ৪ বছর ধরে উপজেলায় মৎস্য অধিদপ্তরকে বলে আসছি মালিকের ব্যাকগ্রাউন্ড যাচাই না করে নতুন কোনো নৌকার অনুমতি না দিতে। কিন্তু কেউ আমাদের কথা শোনে না।'

এ কারণেই চোরাকারবারিরা জেলে হিসেবে নদীতে নামতে পারছে বলে জানান তিনি।

মাদক চোরাকারবারে মাছ ধরার নৌকা ব্যবহার প্রসঙ্গে মৎস্য কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন বলেন, 'বিষয়টি খতিয়ে দেখা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ।'

সূত্র জানায়, অবৈধ নৌকাগুলো মাছ ধরতে যাওয়ার অনুমোদনের জন্য ১ হাজার থেকে ২ হাজার টাকার বিনিময়ে মৎস্য বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তার কাছ থেকে টোকেন নেয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে দেলোয়ার কোনো কথা বলতে রাজি হননি।

যোগাযোগ করা হলে বিজিবি-২-এর কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল শেখ খালিদ মোহাম্মদ ইফতেখার জানান, তিনি নাফ নদীতে মাছ ধরার কথা শোনেননি।

দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'মাছ ধরার ট্রলারগুলো নদী দিয়ে সমুদ্রে যায়।'

মাছ ধরার নৌকাগুলো মাদক চোরাকারবারে ব্যবহার করা হয়, এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, 'যারা এই তথ্য দিয়েছেন, তাদেরকে বলুন এসব তথ্য আমাদের দিতে। যাতে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি।'

কক্সবাজারে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের লেফটেন্যান্ট কাজী আল-আমিন জানান, নদী দিয়ে চোরাকারবারের কথা তিনি শোনেননি।

'নদী ও সাগরে অবৈধ কর্মকাণ্ড রোধে আমাদের কঠোর নজরদারি রয়েছে', যোগ করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Tk 2,956 crore earmarked for Election Commission

Of this amount, Tk 2,727 crore has been allocated as revenue budget, while Tk 229 crore was allocated as development budget

48m ago