সংস্কারের অপেক্ষায় ঐতিহাসিক ক্বীন ব্রিজ

৭০০ বছরের বেশি সময় পূর্বে সুরমা নদীর উত্তর পাড়ে টিলাঘেরা সবুজের পাদদেশে বর্তমান সিলেট নগরীর গোড়াপত্তন। সেসময় থেকেই ভারতবর্ষের এ জনপদে আসার একমাত্র উপায় ছিল নৌপথ।
ক্কীন ব্রিজ। ছবি: শেখ নাসির/স্টার

৭০০ বছরের বেশি সময় পূর্বে সুরমা নদীর উত্তর পাড়ে টিলাঘেরা সবুজের পাদদেশে বর্তমান সিলেট নগরীর গোড়াপত্তন। সেসময় থেকেই ভারতবর্ষের এ জনপদে আসার একমাত্র উপায় ছিল নৌপথ।

কথিত আছে, ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে হযরত শাহজালাল (রা.) যখন গৌড়ের রাজা গোবিন্দকে পরাজিত করে সিলেট জয় করতে আসেন, তখন জায়নামাজ বিছিয়ে সুরমা নদী অতিক্রম করেই শহরে প্রবেশ করেছিলেন তিনি ও তার অনুসারীরা।

তারও ৬ শতক পরে, ১৯৩৬ সালে এই নদীর ওপর নির্মিত হয় দৃষ্টিনন্দন একটি স্টিলের ব্রিজ। আর এর মধ্য দিয়ে সিলেট শহরের সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ সৃষ্টি হয় অখণ্ড ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের।

তখন সিলেট শহর আসাম প্রদেশের অধীনে, আর সে প্রদেশের গভর্নর ছিলেন স্যার মাইকেল ক্বীন। তৎকালীন রেলওয়ে বিভাগের নির্মাণ করা এই ১ হাজার ১৫০ ফুট দীর্ঘ ও ১৮ ফুট প্রশস্ত এই ব্রিজটি তার নামেই নামকরণ করা হয়— ক্বীন ব্রিজ।

সময়ের সঙ্গে প্রায় শতবর্ষী ব্রিজের এখন ভগ্নদশা। ব্রিজটি প্রথম ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে। ব্রিজের ভেঙে ফেলা একাংশ বিজয়ের পর সাময়িক সংস্কার করা হয় এবং পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালে সংস্কার করা হয়।

তবে ৯০ দশকে ব্রিজের অবস্থা খারাপ হতে থাকলে এবং সুরমা নদীর ওপর বিকল্প হিসেবে শাহজালাল সেতু নির্মাণ করা হলে ক্বীন ব্রিজে ভারী যান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

সর্বশেষ ২০১৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর সড়ক ও জনপথ বিভাগের সঙ্গে পরামর্শ করে ব্রিজটি কেবলমাত্র পদচারী সেতু হিসেবে ব্যবহারের জন্য ঘোষণা দিয়ে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করে সিলেট সিটি করপোরেশন। তবে মাত্র ৫২ দিন পরেই নগরবাসীর চাপের মুখে ব্রিজটি আবারও হালকা যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়।

২০২০ সালে ব্রিজটির বড় ধরনের সংস্কারের বিষয়টি আলোচনা হয় সিলেট জেলা উন্নয়ন প্রকল্পের সমন্বয় বৈঠকে। সেই বৈঠকের আলোকে পরিকল্পনা প্রণয়ন করে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্রিজটির সংস্কারে ২ কোটি ১৫ লাখ টাকা অনুমোদন দেয় সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়।

সড়ক ও জনপথ বিভাগ সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'ব্রিজটির নির্মাণ ও পূর্ববর্তী সংস্কারকাজ রেলওয়ে বিভাগ করেছিল। তা ছাড়া, এ ধরনের স্টিল স্ট্রাকচারে তাদের দক্ষতা বেশি। তাই ব্রিজটির সংস্কারে সড়ক ও জনপথ বিভাগ প্রকল্প গ্রহণ করলেও প্রকৃত কাজটি করবে বাংলাদেশ রেলওয়ে।'

বাংলাদেশ রেলওয়ের ‍ব্রিজ প্রকৌশলী (পূর্বাঞ্চল) মোহাম্মদ আবরার হোসেন বলেন, 'ব্রিজটির সংস্কারে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গতমাসে চুক্তি সই হয়েছে এবং তারা এ কাজের জন্য ১ বছর সময় পেয়েছেন।'

তিনি বলে, 'ব্রিজের যেসব স্টিল অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা নতুন করে নির্মাণ করে পুনস্থাপন করা হবে এবং বাকি অংশের সক্ষমতা বাড়ানো হবে। ইতোমধ্যে স্টিলের অংশগুলোর নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। সেগুলোর নির্মাণ শেষ হলে সরাসরি ব্রিজে প্রতিস্থাপন ও অন্যান্য সংস্কার কাজ শুরু হবে।'

সেভ দ্য হেরিটেজ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের নির্বাহী পরিচালক আব্দুল হাই আল-হাদী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জাতিগতভাবে আমরা আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যমণ্ডিত স্থানকে অবহেলা করে আসছি। কিন্তু, ঐতিহাসিক ক্বীন ব্রিজ সংস্কারে এ উদ্যোগ দেরিতে নেওয়া হলেও তা প্রশংসার দাবিদার। এ ধরনের উদ্যোগে সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও ঐতিহাসিক স্থাপনার গুরুত্ব দিতে উদ্বুদ্ধ হবে।'

Comments