পুরনো অবকাঠামোয় নতুন সেবা দিতে ব্যর্থ নাজিরগঞ্জ-ধাওয়াপাড়া ফেরি সার্ভিস

দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে নদীপথে যোগাযোগ সহজতর করতে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্পোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) চলতি বছরের প্রথম দিন থেকে ঘটা করে নাজিরগঞ্জ-ধাওয়াপাড়া ফেরি সার্ভিস চালু করলেও শুরুর পর থেকেই তা মুখ থুবড়ে পড়েছে।
সেবা দিতে ব্যর্থ নাজিরগঞ্জ ধাওয়াপাড়া ফেরি সার্ভিস
নাজিরগঞ্জে ঝুঁকি নিয়ে ফেরিতে উঠছে পণ্যবাহী ট্রাক। ছবি: আহমেদ হুমায়ুন কবির তপু/স্টার

দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে নদীপথে যোগাযোগ সহজতর করতে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্পোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) চলতি বছরের প্রথম দিন থেকে ঘটা করে নাজিরগঞ্জ-ধাওয়াপাড়া ফেরি সার্ভিস চালু করলেও শুরুর পর থেকেই তা মুখ থুবড়ে পড়েছে।

বহুল আলোচিত এ ফেরি সার্ভিস শুরু হলেও যাত্রীদের দ্বিগুণ ভাড়া দিয়ে নৌকায় নদী পারাপারে বাধ্য করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

২টি কে–টাইপ ফেরি দিয়ে ২৪ ঘণ্টা ফেরি চলাচলের লক্ষ্যে ২৫ জনকে নিয়ে বিআইডব্লিউটিসি আয়োজন করে ফেরি সার্ভিস চালু করলেও পর্যাপ্ত গাড়ির অভাবে দিনে ৩ ট্রিপ চালাতে হিমশিম খাচ্ছে ফেরি চলাচল কর্তৃপক্ষ।

ট্রাকচালকদের অভিযোগ পণ্যবোঝাই গাড়ি নিয়ে ফেরিঘাটে এসে ফেরির দেখা পেলেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাদের ফেরিঘাটেই বসে থাকতে হচ্ছে। ফেরি চলাচলের সময়সীমা নির্ধারিত না থাকায় দূরত্ব কমলেও যাতায়াতে অতিরিক্ত সময় লাগছে।

সিরাজগঞ্জ থেকে ফিড নিয়ে বরিশালে যেতে নাজিরগঞ্জ ফেরিঘাটে এসেছিলেন ট্রাকচালক আশরাফুল ইসলাম। সড়ক পথে প্রায় ১২০ কিলোমিটার রাস্তা কম হওয়ায় তিনি এ ঘাটে এসেছিলেন। নাজিরগঞ্জ ফেরিঘাটে তাকে প্রায় ৫ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়।

আশরাফুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সময় বাঁচাতে এ পথে যেতে দিনের বেশিরভাগ সময় ঘাটেই থাকতে হয়। সময়মত পণ্য পরিবহন করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।'

সেবা দিতে ব্যর্থ নাজিরগঞ্জ ধাওয়াপাড়া ফেরি সার্ভিস
ফেরিঘাটে পণ্যবোঝাই গাড়ি নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। ছবি: আহমেদ হুমায়ুন কবির তপু/স্টার

তিনি আরও বলেন, 'সকাল ১০টার দিকে ঘাটে আসার কিছুক্ষণ পর ঘাটে ফেরি চলে আসলেও সে সময় বেশি যানবাহন না থাকায় ফেরি ছাড়েনি। প্রায় ৫ ঘণ্টা অপেক্ষার পর ফেরিতে উঠতে পেরেছি। প্রতিদিনই এভাবে নাজিরগঞ্জ ও ধাওয়াপাড়া ঘাটে পণ্যবোঝাই গাড়ি নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়।'

নাজিরগঞ্জ ফেরিঘাটে বিআইডব্লিউটিসির কর্মী মো. জাহিদুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'একটি ফেরি লোড করতে কমপক্ষে ১০ গাড়ির প্রয়োজন হয়। বেশিরভাগ সময়ই ঘাটে পর্যাপ্ত সংখ্যক গাড়ি না থাকায় সময় মতো ফেরি ছাড়া সম্ভব হয় না।'

ট্রাকচালক আব্দুল কাদের বলেন, 'নাজিরগঞ্জ-ধাওয়াপাড়া ফেরিঘাটের মাধ্যমে পাবনা ও রাজবাড়ী হয়ে দক্ষিণাঞ্চলের দূরবর্তী জেলায় যাতায়াতে কমপক্ষে ১২০ থেকে ১৫০ কিলোমিটার রাস্তার দূরত্ব কম হওয়ায় পণ্যবাহী গাড়ির চালকদের এ রুটের প্রতি আগ্রহ আছে। এ ঘাটে পণ্যবাহী ভারি যানবাহন চলাচলের রাস্তা ও গাড়ি পার্কিংয়ের সুব্যবস্থা না থাকায় অধিকাংশ চালকই এ রাস্তা দিয়ে চলাচলে আগ্রহ হারাচ্ছেন।'

তিনি জানান, ফেরিতে উঠানামা করার মতো প্রশস্ত রাস্তা নেই। ভারি যানবাহনগুলো ঝুঁকি নিয়ে ফেরিতে উঠানামা করছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেরির জন্য অপেক্ষা করার জন্য গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা নেই। ফেরিঘাটের রাস্তা সরু হওয়ায় সেখানে যানজট হচ্ছে।

১৯৯৬-৯৭ সালে সড়ক ও জনপথ বিভাগ উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগের জন্য দূরত্ব কমাতে পদ্মা নদীর এক পাড়ে পাবনার নাজিরগঞ্জ ও অন্য পাড়ে রাজবাড়ীর ধাওয়াপাড়ার মধ্যে ফেরি সার্ভিস চালু করে। সড়ক বিভাগ ছোট ফেরি দিয়ে সার্ভিস চালু রাখার চেষ্টা করলেও পর্যাপ্ত সক্ষমতা না থাকায় তারা ফেরি সার্ভিস ঠিকমত চালু রাখতে পারেনি।

সেবা দিতে ব্যর্থ নাজিরগঞ্জ ধাওয়াপাড়া ফেরি সার্ভিস
নাজিরগঞ্জে দ্বিগুণ ভাড়ায় নৌকায় নদী পারাপারের অভিযোগ উঠেছে। আহমেদ হুমায়ুন কবির তপু

অবশেষে, আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুসারে ১ জানুয়ারি থেকে এ ফেরিঘাটের দায়িত্ব বিআইডব্লিউটিসির কাছে হস্তান্তর করা হয়। সেদিন থেকেই বড় ফেরি দিয়ে নাজিরগঞ্জ-ধাওয়াপাড়া ফেরি সার্ভিস সচল করে সংস্থাটি।

অভিযোগ উঠেছে, ফেরিঘাটের সক্ষমতা না বাড়িয়ে তড়িঘড়ি করে ফেরি চলাচল চালু করলেও কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে না পারায় শুরুর পর থেকেই মুখ থুবড়ে পড়েছে ফেরি সার্ভিস।

বিআইডব্লিউটিসি কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপক শাফায়েত আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এ পথে সড়ক ও জনপথ বিভাগ দীর্ঘদিন ধরে ছোট ইউটিলিটি ফেরি দিয়ে মিড ওয়াটার ঘাট পরিচালনা করে আসছিল। বিআইডব্লিউটিসি দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার পর বড় ফেরি দিয়ে এ ফেরিঘাট চালু করলেও সেই পুরনো ঘাট দিয়েই ফেরি চালাতে হচ্ছে।'

নাজিরগঞ্জ-ধাওয়াপাড়া রুটে দীর্ঘদিন বড় ফেরি পারাপারের সুব্যবস্থা গড়ে না উঠায় পুরনো ছোট ফেরির ব্যবস্থাপনা দিয়েই বড় ফেরি চলাচল করায় কাঙ্ক্ষিত সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান তিনি।

বড় ফেরি চলাচলের জন্য হাই-ওয়াটার ও লো-ওয়াটার ঘাট নির্মাণ করা জরুরি হলেও এখনো তা নির্মাণ করতে পারেনি বিআইডব্লিউটিএ।

'বিআইডব্লিউটিএকে বিষয়টি জানানো হয়েছে,' উল্লেখ করে শাফায়েত আহমেদ আরও বলেন, 'ফেরিঘাট ও প্রশস্ত রাস্তা করা হলে সঠিকভাবে ফেরি চলাচল করতে পারবে। তখন যানবাহনও বেশি পাওয়া যাবে বলে আশা করছি।'

যাত্রীদের অভিযোগ, ফেরি চলাচল শুরু হলেও ফেরি দিয়ে নদী পারাপারে বাধা দেওয়া হচ্ছে। দ্বিগুণ ভাড়া দিয়ে তাদের নৌকায় চড়তে হচ্ছে। প্রভাবশালী ইজারাদারদের লোকজন যাত্রীদের নৌকায় চড়তে বাধ্য করছে বলেও অভিযোগ করেন তারা।

সুজানগর উপজেলার শ্রীপুর গ্রামের বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কাজের জন্য নিয়মিত রাজবাড়ীতে যেতে হয়। ফেরিতে নদী পার হতে ৩০ টাকা ভাড়া লাগে। কিন্তু টিকিট কেটেও ফেরিতে উঠতে পারছি না।'

'ইজারাদারদের লোকজন নৌকায় নদী পার হতে বাধ্য করছে। নৌকায় ৭০ টাকা ভাড়া দিতে হচ্ছে,' যোগ করেন তিনি।

রাজবাড়ীতে কর্মরত পাবনার মাসুদ রানা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মোটরসাইকেল নিয়ে নদী পার হতে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ১০০ টাকা দিয়ে ফেরিতে মোটরসাইকেল পারাপার করা গেলেও ১৭০ টাকা দিয়ে নৌকায় পার হতে হচ্ছে।'

স্থানীয় ইজারাদারের প্রতিনিধি কাজী শাজাহান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এটি নৌ-পারাপার ঘাট হিসেবে ইজারা নেওয়া আছে। নির্ধারিত সময় পর্যন্ত যাত্রী পারাপার করা হয়। কেউ ফেরিতে যেতে চাইলে তাদের বাধা নেই। সেক্ষেত্রে যাত্রী পারাপারের জন্য ঘাটের নির্ধারিত ভাড়া দিতে হবে।'

নাজিরগঞ্জ ফেরিঘাটের ব্যবস্থাপক শাফায়েত আহমেদ বলেন, 'নৌকার ঘাট স্থানীয় ইজারাদাররা নিয়ন্ত্রণ করছে। আমাদের কিছুই করার নেই।'

Comments