শহীদ ড. শামসুজ্জোহা: একজন আলোকবর্তিকা
শহীদ ড. শামসুজ্জোহার জন্ম ছিল আমাদের দেশের আকাশে এক ধূমকেতুর মতো। আজকের দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকালে তা রীতিমতো মহাদুর্লভই মনে হবে। ড. শামসুজ্জোহার মতো শিক্ষকের জন্ম এদেশে হয়েছিল তা শুনতে অনেকখানি কল্পজগতের মতোও মনে হতে পারে। অবশ্য তার যথেষ্ট কারণও আছে।
বর্তমানে আমাদের দেশে শিক্ষক, উপাচার্যদের মধ্যে কেউ কেউ নিজের পদ বাঁচাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে পুলিশ লেলিয়ে ছাত্র পিটিয়ে মামলা দেন স্বয়ং ছাত্রের নামেই। কোনো এক উপাচার্যের মুখে শোনা যায় 'দলের পদ পেলে উপাচার্যের পদ ছেড়ে দিবো।' তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রাজনীতির মধ্যে যে কতো রং এর দল আছে তা গুণতে গেলেও রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়।
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ হয় অনেকখানি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের আনুকূল্য বিবেচনায়। যার ফলে স্বভাবতই সেই শিক্ষকদের নৈতিক মানদণ্ডও শূন্যের কোঠায়। যে দেশের অধিকাংশ শিক্ষকেরাই ক্লাস, গবেষণার চেয়ে বেশি প্রাধান্য দেন নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের পদকে সে দেশে শামসুজ্জোহার মতো শিক্ষকের জন্ম হয়েছে এটি ভাবতেও রীতিমতো বিস্ময় জাগে। যিনি আলোকবর্তিকা হিসেবে এক সুমহান আদর্শ আর ত্যাগের অনন্য নজির স্থাপন করেছেন।
শহীদ হওয়ার আগের দিন ড. শামসুজ্জোহা শিক্ষক সভায় ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত নিজের শার্ট দেখিয়ে বলেছিলেন, 'আজ আমি ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত। এর পর কোন গুলি হলে তা ছাত্রকে না লেগে যেন আমার গায়ে লাগে।' শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ সভায় বলেছিলেন, 'শুধু ছাত্ররা নয়, আমরা সবাই মিলে এই দানবীয় শক্তিকে রুখে দাঁড়াব, মরতে যদি হয় আমরা সবাই মরব।'
এদেশে বর্তমানে কজন শিক্ষক এভাবে আগলে রেখেছেন আপন ছাত্রকে। কজন শিক্ষক পেরেছেন ছাত্রদের বটবৃক্ষের মতো আগলে রাখতে?
বঙ্গবন্ধু ও ৩৫জন বিশিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে নিঃশর্তে মুক্তি, ৬ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পেশ করেছিল ১১ দফা কর্মসূচি। ১৯৬৯ এর ৭ ও ৮ জানুয়ারি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে গঠিত হয় রাজনৈতিক ঐক্য ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি। ২০ জানুয়ারি ঢাকায় পুলিশের গুলিতে মিছিলরত অবস্থায় ছাত্র ইউনিয়নের নেতা আমানুল্লাহ আসাদুজ্জামান শহীদ হলে উত্তাল হয়ে উঠল ঢাকার রাজপথ।
২৪ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে নিহত হলেন নবকুমার ইন্সটিটিউটের কিশোর ছাত্র মতিয়ুর। উত্তাল রাজপথে বিক্ষুব্ধ মানুষের তখন একটাই দাবি। জনমানুষের মিছিলে স্লোগান 'আইয়ুব শাহী, জুলুম শাহী নিপাত চাই, নিপাত চাই'। 'আইয়ুব মোনেম ভাই ভাই এক দড়িতে ফাঁসি চাই।' ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে হত্যা করা হলো আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযুক্ত সার্জেন্ট জহুরুল হককে। আর তাতে যেন আগুনে চূড়ান্ত ঘি পড়ল।
পরিস্থিতি পুরোপুরি প্রাদেশিক সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। সার্জেন্ট জহুরুল হক হত্যাকাণ্ডের পরদিনই দেশব্যাপী হরতাল ডেকেছিল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। সেই বিক্ষোভের হাওয়া এসে লেগেছিল রাজশাহীর বুকেও। ১৬ ফেব্রুয়ারির হরতালেও গুলি চালিয়েছিল পুলিশ। মিছিলে পুলিশের গুলির প্রতিবাদে জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি হয়ে উঠে সমগ্র দেশ। ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকার মতো রাজশাহীও হয়ে উঠে মিছিলের নগরী।
এদিন রাজশাহীর ছাত্ররা পুলিশের জারিকৃত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল নিয়ে এগুতে থাকলে পুলিশ ছাত্রদের মিছিলে বেপরোয়া লাঠিচার্জ শুরু করে। লাঠিচার্জে আহত ছাত্রদের আটক করে নেয়া হয়েছিল বোয়ালিয়া থানায়। শুনেই ছাত্রদের দেখতে থানায় ছুটে গিয়েছিলেন ছাত্রদের প্রিয়জন জোহা স্যার। আহত ছাত্রদের নিয়ে তিনি গিয়েছিলেন হাসপাতালে। ছাত্রদের প্রাথমিক চিকিৎসা হয়েছিল হাসপাতালে। পরম মমতায় ছাত্রদের মাথায় হাত বুলিয়ে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন পরদিন আবার আসবেন।
সেদিন সন্ধ্যায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে ছিল বাংলা বিভাগের এক অনুষ্ঠান। উপস্থিত ছাত্র ও শিক্ষকদের সামনে দাঁড়িয়ে অধ্যাপক শামসুজ্জোহা এসেছিলেন ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত শার্ট নিয়ে। উপস্থিত শিক্ষক ও ছাত্রদের নিজের শার্ট দেখিয়ে বলেছিলেন 'আহত ছাত্রদের পবিত্র রক্তের স্পর্শে আমি উজ্জীবিত। এরপর আর যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে গুলি হয়, সেই গুলি কোনো ছাত্রের গায়ে লাগার আগে আমার বুকে বিঁধবে।'
পরদিন ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীর প্রশাসন পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ১৪৪ ধারা জারি করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন রাজশাহী-নাটোর সড়কে। রাতেই ছাত্ররা ঠিক করেছিলেন ১৪৪ ধারা ভেঙে মূল গেইট থেকে তারা মিছিল বের করবেন। পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সকাল ৯টায় প্রায় ২ হাজার ছাত্র মূল গেইটে এসে জড়ো হয়। ছাত্রদের দমন করতে প্রস্তুত ছিল পুলিশ ইপিআর এবং সেনারা।
কিন্তু ছাত্ররা ছিল অপ্রতিরোধ্য। যে করেই হোক ১৪৪ ধারা ভাঙবেই। এমন সময় সেনাদের সঙ্গে ব্যাপক বাকবিতণ্ডা শুরু হয় উত্তেজিত ছাত্রদের। এমন সময় অবাঙালি সেনা অফিসার ক্যাপ্টেন হাদি উত্তেজিত গলায় চিৎকার দিতে শুরু করেন। তখন এগিয়ে গিয়ে ড. শামসুজ্জোহা ক্যাপ্টেন হাদিকে পরিস্থিতি বোঝাতে লাগলেন। একই সঙ্গে তিনি উত্তেজিত ছাত্র ও ম্যাজিস্ট্রেটকেও পরিস্থিতি অনুধাবনের অনুরোধ করলেন। একপর্যায়ে বললেন, 'প্লিজ ডোন্ট ফায়ার, প্লিজ ডোন্ট ফায়ার। আমার ছাত্ররা এখনই এখান থেকে চলে যাবে।'
বেলা ১১টার দিকে সেনা সদস্যরা গুলি চালায় শামসুজ্জোহার বুকে। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে শামসুজ্জোহাকে। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও পথে ব্যারিকেড থাকায় হাসপাতালে পৌঁছাতে দেরি হয়। অপারেশন টেবিলেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন শামসুজ্জোহা।
আগের দিন সন্ধ্যায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে বলা শামসুজ্জোহার শেষ কথাটিই যেন ফলে গেল। শামসুজ্জোহা বলেছিলেন, 'আর যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে গুলি হয়, সেই গুলি কোনো ছাত্রের গায়ে লাগার আগে আমার বুকে বিঁধবে।' সেই শেষ গুলিটিরও তাই ঠাঁই হয়েছিল ছাত্রদের অতিপ্রিয় জোহা স্যারের বুকেই। ছাত্রদের আগলে রেখে নিজের বুক পেতে দিয়ে ড. শামসুজ্জোহা যেন প্রমাণ করলেন একজন শিক্ষক কতোখানি ত্যাগ স্বীকার করতে পারেন।
জন্মেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ার নিম্ন বেতনভোগী চাকরিজীবি বাবার ঘরে। মেধা তালিকায় ছিলেন বরাবরই শীর্ষে। বাঁকুড়া জেলা স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশনে করেছিলেন স্ট্যান্ড। ইন্টারমিডিয়েটেও ছিলেন মেধা তালিকার প্রথম সারিতে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য এরপরই সপরিবারে চলে এসেছিলেন ঢাকায়।
ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে। শামসুজ্জোহা যুক্ত ছিলেন ভাষা আন্দোলনেও।
স্নাতকোত্তরে গবেষণা করেছিলেন প্রখ্যাত রসায়নবিদ ড. মোকাররম হোসেন খন্দকারের অধীনে। সেই গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল বিলেতের নামজাদা গবেষণা পত্রিকায়। এরপর বিলেতে পড়ার সুযোগও পেয়েছিলেন তিনি। লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজ ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি করে ফিরে এসেছিলেন স্বদেশে।
শামসুজ্জোহার কর্মজীবন শুরু হয়েছিল পাকিস্তানে পাকিস্তান অর্ডন্যান্স কারখানায় সহযোগী কারখানা পরিচালক হিসেবে। পরবর্তীতে ওয়াহ ক্যান্টনমেন্টের ছিলেন সহকারী পরিচালক। প্রশিক্ষণ নিয়ে যোগ দিয়েছিলেন বিলেতের রয়্যাল অর্ডিনেন্স কারখানায়। কিন্তু শামসুজ্জোহাকে দেশের মায়া টানছিল বারবার। যেখানেই গেছেন শামসুজ্জোহা আপন শেকড় ভুলতে পারেননি।
যার প্রমাণ রয়্যাল অর্ডিনেন্স কারখানার নিরাপদ চাকরি ছেড়ে বেছে নিয়েছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেভেলপমেন্ট অফিসারের চাকরি। একই বছর হয়েছিলেন রসায়ন বিভাগের লেকচারার। শামসুজ্জোহার জীবনে এমন উদাহরণ অসংখ্য। পিএইচডি করার জন্য তিনি যখন বৃত্তি নিয়ে পুনরায় লন্ডন ইম্পেরিয়াল কলেজে পড়তে গিয়েছিলেন তখনো তার সামনে সুযোগ ছিল লন্ডনে থেকে যাওয়ার। পিএইচডির সময়কালে বেরেট স্ট্রিট ওয়েস্ট লন্ডন কমার্স কলেজে অধ্যাপনাও করতেন তিনি। পরিপূর্ণ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও শামসুজ্জোহা থাকেননি সেখানে। ফিরে এসেছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে।
পরবর্তীতে ১৯৬৮ সালে নরওয়ের অসলো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক বছর মেয়াদি বৃত্তি পেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় যেমন অভিজ্ঞ শিক্ষকের অভাবে শামসুজ্জোহাকে ছাড়েনি। তিনিও আর যাননি।
এত কেবল গবেষণা ও শিক্ষকতা। খেলাধুলাতেও ড. শামসুজ্জোহা ছিলেন অনন্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর থাকা অবস্থায় ছাত্রদের সঙ্গে নিয়মিতই ফুটবল খেলতেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয় হকি দলের নিয়মিত খেলোয়াড় হিসেবে রেখেছিলেন কৃতিত্বের স্বাক্ষর। আজকের দিনে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দিকে তাকালে বোঝা যায় কতোটা দুর্লভতম উদাহরণ ছিলেন তিনি।
ছাত্ররা তার ক্লাসে নির্ভয়ে নিঃসঙ্কোচে মতামত পেশ করত। শামসুজ্জোহা নিজেও ছাত্রদের মতামতকে ভীষণ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতেন। শহীদ হওয়ার আগের দিন ১৭ ফেব্রুয়ারি রাতে তাইতো শহীদ মিনারে প্রতিবাদ সভায় ড. জোহা বলেছিলেন, 'শুধু ছাত্ররা নয়, আমরা সবাই মিলে এই দানবীয় শক্তিকে রুখে দাঁড়াব, মরতে যদি হয় আমরা সবাই মরব।'
আজকের দিনে ড. মোহাম্মদ শামসুজ্জোকে আমাদের অবিশ্বাস্যই লাগবে। ড. শামসুজ্জোহাদের মতো আদর্শিক শিক্ষক আজ কেবল বিরলই নয় বিলুপ্তও বটে। শহীদ ড. মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা, ছাত্রদের প্রিয় জোহা স্যার বেঁচে থাকবেন এক মহাসমুদ্রের মতো প্রেরণা ও চেতনায় চিরভাস্বর হয়ে। শহীদ হওয়ার দিনে তার প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
সূত্র-
ড. জোহা এবং আমি: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ বুদ্ধিজীবী ও বধ্যভূমি/ প্রফেসর আবদুল খালেক
Comments