ভাসমান মানতা সম্প্রদায় ‘সংখ্যাহীন জীবন তাদের’

মানতা
বরিশাল সদর উপজেলার লাহারহাট এলাকায় নদীর পাড়ে অবস্থানকারী মানতা সম্প্রদায়ের নারীরা রান্না করছেন। ছবি: টিটু দাস/স্টার

তাদের জীবন সংখ্যা জ্ঞানহীন, অধিকাংশই হিসাব কষতে পারেন না, এমনকি টাকাও গুণতে পারেন না। শিশু-কিশোর-নারীরা তাদের প্রকৃত বয়স বলতে পারেন না। কেউ কেউ মোবাইলে ফোনে কল করলে পারলেও, সংখ্যা না চেনায় নম্বর শুনে মোবাইলে কল দিতে পারেন না। 

অক্ষর ও সংখ্যা জ্ঞানহীন হওয়ায় এ রকম এক ভীষণ সংকটে আছেন নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করা মানতা সম্প্রদায়। স্থানীয় ভাষায় তাদর বেদে বা বাইদ্যা বলা হয়। ভাসমান এই সম্প্রদায় যুগ যুগ ধরে নদীরে পাড়ে অবস্থান করে মাছ ধরে জীবিকা অর্জন করে।

সম্প্রতি সরেজমিনে বরিশাল সদর উপজেলার বুখাইনগর ও লাহারহাট এলাকায় গিয়ে নদীতে অবস্থানকারী মানতা সম্প্রদায়ের দুটি দলের প্রায় ২ শতাধিক নৌ-বহরের  অন্তত শতাধিক সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।

দেখা গেছে নারীদের সবাই অক্ষর ও সংখ্যা জ্ঞানহীন। মাঝবয়সী নারীদের গড়ে প্রত্যেকের ৪-৫টি সন্তান আছে। কিন্তু নিজেদের বয়স, বিয়ের বয়স ও সন্তানদের বয়স কেউ বলতে পারছেন না। সবাই বাংলা ভাষায় কথা বললেও, লিখতে বা পড়তে পারে না। শিশু-কিশোররা কেউ স্কুলে পড়ে না।

মানতা
বরিশাল সদর উপজেলার বুখাইনগর এলাকায় অবস্থানকারী মানতা সম্প্রদায়ের এক সদস্য মাছ ধরার জন্য জাল প্রস্তুত করছেন। ছবি: টিটু দাস/স্টার

তাদের অধিকাংশের জাতীয় পরিচয়পত্র থাকলেও, নেই জেলে কার্ড। এতে নদীতে জাল ও বড়শি দিয়ে মাছ ধরলেও, জেলেদের জন্য সরকারি সহায়তা থেকে তারা বঞ্চিত।

শুধু তাই নয়, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতাসহ সরকারি সব ধরনের ভাতা থেকে বঞ্চিত এই মানতা সম্প্রদায়।

নগরীর সদর উপজেলার চরমোনাই ইউনিয়নের বুখাইনগরে আড়িয়াল খাঁ নদীর শাখা খালে প্রায় ৪০ বছর ধরে অবস্থান করছে মানতা সম্প্রদায়ের একটি দল।

দলের সরদার দুলাল সরদার তার বয়স বলতে পারলেও, মোবাইল নম্বর জানেন না। তিনি শুধু কল এলে রিসিভ করতে পারেন।

দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি জানান, এই দলে ৭০টি নৌকা আছে। গড়ে প্রতি নৌকায় ৫-৬ জন সদস্য আছেন, যাদের অর্ধেক শিশু-কিশোর। প্রায় ২০০ শিশু-কিশোরের কেউ স্কুলে পড়ে না।

দুলাল বলেন, 'এই দলের আমি ও আইয়ুব আলী সরদার নাম লিখতে পারি, সই করতে পারি ও টাকা গুণতে পারি। মহিলাদের কেউ টাকা গুণতে পারে না। পুরুষদের মধ্যে যারা মাছ বিক্রি করতে ব্যবসায়ীদের কাছে যায় সেই কয়েকজন মাত্র টাকা গুণতে পারে।'

আইয়ুব আলী সরদার বলেন, 'আমরা যখন থাকি না, তখন মহিলারা মাছ নিয়ে বাজারে মহাজনের কাছে দিয়ে আসে। মহাজন হিসাব করে টাকা দিয়ে দেয়।'

'আমাদের মধ্যে কেউ কেউ ১০০০, ৫০০, ১০০ টাকার নোট গুণতে পারে। তবে তারা আবার ১০, ২০, ৫ টাকা গুণে বলতে পারে না,' বলেন তিনি।

ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে সেখানে গিয়ে হাত উঠিয়ে ইচ্ছামতো ২ হাতের কয়েকটি আঙুল দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলে, নারী ও শিশু-কিশোররা আঙুলের সংখ্যা বলতে পারেনি।

দলের এক কিশোরীকে নাম জিজ্ঞেস করায় সে তার নাম 'নদী' বলে জানায়। সে তার বয়স বলতে পারেনি। সংখ্যাও গুণতে পারে না সে। তবে ১ হাজার, ৫০০ ও ১০০ টাকার নোট চেনে।

তবে অবাক হওয়ার মতো বিষয় এই যে মোবাইল ফোন নম্বর লিখে দিলে সে তা  মোবাইলে উঠাতে পারে, কিন্তু কেউ বললে আর পারে না।

একই অবস্থা হাফিজা, রঙ্গিলসহ সব শিশু, কিশোর-কিশোরী ও নারীদের।

বৃদ্ধ আলফাৎ জান তার বয়স কত হতে পারে বলতে পারেন। বললেন, '৭০-৮০ কিংবা তার বেশিও হতে পারে।'

জেলে রহমান জানান, তিনি শহরে মাছ বিক্রি করতে যান। তাই তিনি টাকা গুণতে পারেন। তবে মোবাইল নম্বরের বিষয়ে জানতে চাইলে বললেন, যাদের কল দিতে হবে এমন নম্বর সেভ করে রেখেছেন এবং সেগুলো বের করতে পারেন এবং ও কল রিসিভ করতে পারেন।

মানতা
বরিশালে মানতা সম্প্রদায়ের নারী ও কিশোর-কিশোরীরা। ছবি: টিটু দাস/স্টার

আরেকটি বহরের জেলে স্বপন সরদার ডেইলি স্টারকে জানান, বহরে ৭০ জন নারী, ৮০ জন পুরুষ ছাড়াও অন্তত ২০০ শিশু আছে। তাদের মধ্যে শুধু ৩ জন পুরুষ টাকা গুণতে পারেন ও ছোট ছোট হিসাব করতে পারেন।

প্রায় প্রতিটি নৌকায় সোলার লাইট আছে। টিভি আছে অর্ধেক নৌকায়। ১০ জনের মোবাইল ফোন আছে।

দুলাল সরদার জানান, ছোটবেলা থেকেই শিশুরা মায়ের কাছ থেকে মাছ ধরতে শেখে। সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর সামর্থ্য তাদের নেই। বেশ আগে তাদের জন্য ভাসমান স্কুল ছিল। কিন্তু কিছুদিন পর তা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

জেলে বহরের এই দলটি ছাড়াও, আড়িয়াল খাঁ নদীর মূল ধারায় চাদপুরা ইউনিয়ন সংলগ্ন স্থানে গড়ে উঠেছে ১৫০টি জেলে নৌকার বহর।

স্থানীয়ভাবে লাহারহাট নামে পরিচিত এই বহরে গিয়ে দেখা যায়, সারি সারি নৌকায় বসে কেউ জাল মেরামত করছে। জেলে নৌকায় বিয়ে উপলক্ষে মুরগীর মাংস রান্নার কাজ চলছে।

এই বহরের সদস্যদের মধ্যে শুধু নেতৃস্থানীয় হাফেজ সরদার টাকা গুণতে পারেন। তবে তিনি মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারেন না।

হাফেজ সরদার ডেইলি স্টারকে জানান, প্রতিটি নৌকা তৈরির খরচ ৩০ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা। ১৪-১৬ ফুট দীর্ঘ এসব নৌকা তৈরি হয় সাধারণত কড়াই, মেহগনি ও রেইনট্রি গাছের কাঠ দিয়ে।

তিনি জানান, তারা ভূমিহীন হলেও, তাদের ঘর বা জমি দেওয়া হয় না। স্থানীয়ভাবে চেয়ারম্যানদের বললেও কাজ হয় না।

লাহার হাটের জেলে বহরের আলেয়া বেগম অনেক কষ্টে এবং অন্যদের সহযোগিতায় নিজের ৫ সন্তানের নাম জানাতে পারলেও, তাদের বয়স জানাতে পারেননি। দুই হাতের আঙুল কয়টি জিজ্ঞেস করলে, সেখানে উপস্থিত অন্তত ২৫-৩০ জন নারী ও কিশোরী কেউ সঠিকভাবে বলতে পারেনি।

প্রায় অর্ধশত নারী ও কিশোরীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা সংখ্যার হিসাব ঠিকভাবে করতে পারেন না।

মানতা
নৌকায় বসে নাতিকে খাওয়াচ্ছেন নানী। ছবি: টিটু দাস/স্টার

প্রায় সব কিশোরীদের বিয়ে হয়েছে কোনো বহরের পরিচিত কারও সঙ্গে। অনেকের কোলে সন্তানও দেখা গেছে। এই কিশোরী ও তরুণীরা মোবাইল নম্বর লিখে দিলে তা তুলতে পারলেও, সংখ্যায় গুণতে পারেনি।

তাদের মধ্যে কেউই স্কুলে পড়েনি। এই বহরেও অন্তত ১০ ভাগের মোবাইল আছে। অর্ধেকের বেশি নৌকায় সোলার লাইট আছে। সেসব নৌকায় ছোট ছোট টিভিও আছে।

বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার আড়িয়াল নদীর মীরগঞ্জ এলাকায় আরও অন্তত ১০০ নৌ-বহরে মানতা সম্প্রদায়ের আরেকটি দল আছে।

এই জেলেদের প্রধান জসিম সরদার ডেইলি স্টারকে জানান, তাদের প্রধান পেশা মাছ ধরা। জাল ও বড়শি দিয়ে তারা মাছ ধরেন। মাছে মাঝে অভিযানের সময়ে তাদের জেল-জরিমানা করা হয় ও জাল আটক করা হয়।

তিনি বলেন, 'মাছ না ধরলে আমরা কীভাবে বেঁচে থাকব? অভিযান চলাকালে আমরা কিছু পাই না।'

বরিশাল বিভাগীয় মৎস্য কার্যালয় সূত্র জানায়, বরিশাল জেলায় ১ হাজার, ভোলায় ৫৭০ জন, পটুয়াখালীতে ৩০০ জন ও ঝালকাঠিতে ৩৫ জন মানতা জেলে আছে। তবে তারা সবাই জেলে কার্ডের আওতায় আসেনি। এর প্রধান কারণ জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকা।

বরিশাল বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক আনিসুর রহমান তালুকদার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জেলে সহায়তার তালিকা ইউপি চেয়ারম্যান-সদস্যরা করেন বলে মৎস্য কার্যালয়ের কিছু করার থাকে না।'

অভিযান চলাকালেও মানতা সম্প্রদায়ের লোকেরা মাছ ধরে বলে তাদের ওপর সবাই অসন্তুষ্ট থাকে বলে জানান তিনি।

জানতে চাইলে সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক আল মামুন তালুকদার ডেইলি স্টারকে বলেন, মানতা সম্প্রদায়ের সদস্যদের মধ্যে ৫০ জনকে তারা সেলাই প্রশিক্ষণ এবং ১০ হাজার করে টাকা দেওয়া হয় মাসখানেক আগে।

তিনি বলেন, 'আমি মনে করি তাদের নিয়ে ব্যাপক কাজ করা প্রয়োজন। বিশেষ করে তাদের শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসতে হবে।'

মহিলা পরিষদ বরিশাল জেলা সভাপতি রাবেয়া খাতুন বলেন, 'মানতাদের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে শিক্ষার আওতায় আনতে হবে।'

Comments

The Daily Star  | English

Inflation pushes people to compromise on priorities: commerce adviser

Sk Bashir Uddin says he will work hard together with everyone to control commodity prices

1h ago