তিস্তায় আরও ২ খাল খনন করবে পশ্চিমবঙ্গ, উদ্বেগ বাড়বে ঢাকার

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এই উদ্যোগে পানি নিয়ে বাংলাদেশের দুশ্চিন্তা বাড়বে বলে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে
তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প, তিস্তা নদী, পশ্চিমবঙ্গ, জলপাইগুড়ি, আইনুন নিশাত,
লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার দোয়ানীতে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্ট। সংগৃহীত ফাইল ছবি

তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের আওতায় আরও দুটি খাল খননে প্রায় ১ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সেচ বিভাগ। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এই উদ্যোগে পানি নিয়ে বাংলাদেশের দুশ্চিন্তা বাড়বে বলে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

আজ শনিবার টেলিগ্রাফের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের এই উদ্যোগ জলপাইগুড়ি এবং কোচবিহার জেলার আরও কৃষি জমিকে সেচের আওতায় আনতে সহায়তা করবে। কিন্তু, এতে বাংলাদেশের বিপর্যয় বাড়তে পারে। আর পানি সংকট নিরসনে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারতের সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির অপেক্ষায় আছে বাংলাদেশ।

টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, দীর্ঘ ২০ বছর পর তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের আওতায় নতুন খাল খননের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার, তাতে ঢাকার দুশ্চিন্তা আরও বাড়বে। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের আপত্তির কারণে নয়াদিল্লি ও ঢাকা তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিতে পৌঁছাতে পারেনি। একজন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক উল্লেখ করেছেন, তিস্তা প্রকল্পের পরিধি বাড়িয়ে মমতা প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন এই নদী থেকে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরঞ্চলের পানি প্রয়োজন।

জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত বলেন, 'তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে দুদেশের মধ্যে বর্তমানে যে চলমান দ্বন্দ্ব আছে তার মধ্যে ভারতের এই প্রকল্প অনেকটা আগুনে ঘি দেওয়ার মতো অবস্থার সৃষ্টি করবে। এখন কতগুলো প্রশ্ন আছে— প্রথম প্রশ্ন কোন সময় তারা পানি প্রত্যাহার করবে? ইতোমধ্যে শুকনো মৌসুমে তারা পুরো পানি প্রত্যাহার করে। তাহলে সেই পানি নেওয়ার প্রশ্ন আসে না, কারণ পানি তো শুকনো মৌসুমে নেই!'

'দ্বিতীয় প্রশ্ন, তিস্তা অববাহিকায় বাংলাদেশ ও ভারতের যে দুটি ব্যারেজ প্রকল্প আছে, সেখানে পানির চাহিদা সবচেয়ে বেশি সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে। তখন নদীতে কিছুটা পানি আসে, বাংলাদেশও কিছুটা পানি পায়। ভারত তার প্রকল্পের জন্য পুরো পানি প্রত্যাহার করার পরে তলানিটুকু বাংলাদেশ পায়। এখন সেই তলানি থেকে ভারত যদি আরও পানি প্রত্যাহার করে তাহলে বাংলাদেশের আমন মৌসুমে মারাত্মক ক্ষতি হবে। রংপুর, বগুড়া, জয়পুরহাট অর্থাৎ তিস্তা প্রকল্পের এলাকা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মহানন্দা অববাহিকা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে,' বলেন তিনি।

আইনুন নিশাত বলেন, 'তৃতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, দুদেশের প্রধানমন্ত্রী যে দীর্ঘ মেয়াদী সহযোগিতার চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন ২০১১ সালে, তাতে বলা হচ্ছে, অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থা নিতে হবে। এটাকে আমি ব্যাখ্যা করছি এভাবে, তিস্তার সারা বছরের পানি যদি যোগ করি তাহলে প্রচুর পানি আছে। বর্ষার পানি ধরে রেখে শুকনো মৌসুমে ছাড়তে হবে। এটা সম্ভব যদি সিকিমে কিছু প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। ভারত সরকার এই ব্যবস্থাপনা করতে পারে। পশ্চিমবঙ্গ কী করছে সেই দায় কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে মিটমাট হবে। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে দিল্লির সঙ্গে কথা বলবে এবং দিল্লি এই ব্যবস্থাপনা করবে।'

'আমি বলতে চাচ্ছি, সারা বছরের পানির একটা ব্যবস্থাপনা করে; যেটা দুদেশের প্রধানমন্ত্রী সম্মত হয়েছেন, এই সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। বাংলাদেশেও আমরা তিস্তা প্রজেক্টের ফেইজ-১ এ পানি দিচ্ছি। বাকি ফেইজ, আরও অনেক; বর্তমানে যতটুকু এলাকায় পানি দেওয়ার হয় তার চেয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ এলাকায় পানি দেওয়ার প্রস্তাব আমাদের রয়েছে। আমাদের পানির চাহিদা অনেকখানি,' বলেন তিনি।

'চতুর্থ বিষয় হলো, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পানির প্রাপ্যতা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। হয়তো শুকনো মৌসুমে পানি আরও কমে যাবে। এ অবস্থাতে উজানের দেশ যদি গায়ের জোরে পানি প্রত্যাহার করা শুরু করে এটা দুঃখজনক ও লজ্জাজনক হবে। এটা আন্তর্জাতিক নিয়মের পরিপন্থী, ভারতের নিজস্ব আইনও এটাকে সমর্থন করে না। আমি আশা করব, সরকার এ ব্যাপারে জোরাল ভূমিকা নেবেন এবং কিছুটা উদ্যোগ বাংলাদেশ থেকে আসতে হবে যে, সমস্যার সমাধান কী করে করা যায়। ভারতের মাথা ব্যথা নেই বাংলাদেশের কী হলো-না হলো। এটি হলে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে,' বলেন আইনুন নিশাত।

শিলিগুড়ির নর্থ বেঙ্গল ইউনিভার্সিটির ভূগোল বিভাগের একজন ফ্যাকাল্টি মেম্বার টেলিগ্রাফকে বলেন, 'এখন যেহেতু মমতার সরকার সেচ নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করছে, তাই এটা স্পষ্ট- তিস্তার আরও বেশি পানি নতুন খালের মাধ্যমে প্রবাহিত হবে। এর অর্থ হলো, শুষ্ক মৌসুমের কয়েক মাস বাংলাদেশের জন্য কম পানি পাওয়া যাবে।'

সূত্রের বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যমটি জানায়, গ্রীষ্মের মাসগুলোতে তিস্তায় প্রায় ১০০ কিউমেক (কিউবিক মিটার পার সেকেন্ড) পানি পাওয়া যায়। কিন্তু সূত্র জানায়, ভারত ও বাংলাদেশের কৃষিজমিতে সেচের জন্য প্রায় ১ হাজার ৬০০ কিউমেক পানি প্রয়োজন।

শুক্রবার পশ্চিমবঙ্গের সেচমন্ত্রী পার্থ ভৌমিকের উপস্থিতিতে জলপাইগুড়ি জেলা প্রশাসন প্রায় ১ হাজার একর জমি সেচ বিভাগের কাছে হস্তান্তর করে। এই জমি তিস্তার বাম তীরে ২টি খাল খননে প্রশাসনকে সহায়তা করবে। জলপাইগুড়ি জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত আরেক নদী জলঢাকার পানি প্রবাহও খালগুলোর দিকে সরিয়ে দেওয়া হবে।

পশ্চিমবঙ্গ সেচ বিভাগ সূত্রের বরাতে টেলিগ্রাফ জানিয়েছে, পরিকল্পনা অনুযায়ী তিস্তা ও জলঢাকা থেকে পানি সরাতে কোচবিহার জেলার চ্যাংড়াবান্ধা পর্যন্ত ৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ খাল খনন করা হবে। একইসঙ্গে তিস্তার বাম তীরে ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের আরেকটি খাল খনন করা হবে।

প্রশাসনিক সূত্রের বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যমটি বলেছে, খালগুলো খনন হলে প্রায় ১ লাখ কৃষক সেচের সুবিধা পাবেন। এই ব্যারেজটি জলপাইগুড়ি জেলার গজলডোবায় অবস্থিত। এক কর্মকর্তা বলেন, এই উদ্যোগ থেকে মোট কতগুলো এলাকা উপকৃত হবে তা সেচ বিভাগ মূল্যায়ন করবে।

টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলে ৯ লাখ ২২ হাজার হেক্টর কৃষিজমিতে সেচ দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে ১৯৭৫ তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প চালু হয়। পরিকল্পনা ছিল তিস্তার পানি ২ তীরের খালের মাধ্যমে প্রবাহিত করা। তবে, কয়েক দশক ধরে প্রকল্পটি ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে আসছে এবং মাত্র ১ লাখ ০৪ লাখ হেক্টর জমিতে পানি পৌঁছেছে।

শুক্রবার পশ্চিমবঙ্গের সেচমন্ত্রী পার্থ ভৌমিক বলেন, 'জলপাইগুড়ি জেলা প্রশাসন খাল খননের জন্য ১ হাজার একর জমি আমাদের কাছে হস্তান্তর করেছে। ২০০৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকার এটিকে একটি জাতীয় প্রকল্প হিসেবে ঘোষণা করেছিল। কিন্তু, সরকার তহবিল সরবরাহ করছে না। আমরা তহবিল না পেলেও ধাপে ধাপে কাজ শেষ করার চেষ্টা করব।'

পশ্চিমবঙ্গ সেচ বিভাগ জলপাইগুড়ি জেলার ধূপগুড়ি ব্লকের আরও একটি খাল সংস্কার করবে। একটি সূত্র টেলিগ্রাফকে জানিয়েছে, এই খালটি চালু হলে ধূপগুড়ি ব্লকের ৩২ হাজার একর জমিতে সেচ সুবিধা পাওয়া যাবে।

Comments

The Daily Star  | English

S Alam sons: They used fake pay orders even to legalise black money

Ashraful Alam and Asadul Alam Mahir, two sons of controversial businessman Mohammed Saiful Alam, deprived the state of Tk 75 crore in taxes by legalising Tk 500 crore in undisclosed income, documents obtained by The Daily Star have revealed.

3h ago