কবুতরগুলো আগুন থেকে বেঁচেছিল, মানুষের থেকে বাঁচল না

'রাতে আমি ছোট কবুতরগুলো নিয়ে চিন্তা করছিলাম। তারা মাত্র উড়তে শিখেছে। কোনো বিপদ হলে বাঁচবে কিনা এ নিয়ে দুশ্চিন্তিত ছিলাম। তারা ঠিকই নিজের প্রাণ বাঁচিয়েছিল। অথচ দেখেন এই ছোট কবুতরগুলো মানুষ চুরি করে নিয়ে গেল।'  
যখন আগুন লাগে, তখন সবকটি কবুতরই বিপদ টের পেয়ে ঘর ছেড়ে আশেপাশে উড়ছিল। পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হওয়ার পর তারা আবার ফিরে এসেছে। ছবি: শাহীন মোল্লা/স্টার

আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে সব। যা কিছু অক্ষত ছিল তাও চুরি হয়ে গেছে। বিভীষিকাময় রাতের শেষে, ভোরের আধফোটা আলোয় আংশিক পোড়া ঘরটিতে ফিরে এসেছিল প্রিয় কবুতরগুলো। তবে সকাল হতে না হতেই ছোট কবুতরগুলো কারা যেন চুরি করে নিয়ে গেছে।

রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকার কুনিপাড়ায় রোলিং মিল বস্তির একটি মেসে থাকতেন মোরশেদুল হক শাকিল। চাকরি করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। চার বছর আগে ১০টি কবুতর কিনে এনেছিলেন পঞ্চাশোর্ধ শাকিল।

একদিন আগেও তার ২৮টি কবুতর ডানা মেলে উড়ে বেড়াত। ছোট কবুতরগুলোও মাত্রই উড়তে শিখেছে।    

গত সোমবার রাত ৮টার দিকে বস্তিতে আগুন লাগে। শাকিল বলেন, 'আগুন লাগার পর চিৎকার শুনে আমি সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলটা হাতে নিয়ে ওপরে যাই। কবুতরের খাঁচাগুলো খুলে দিয়ে সেখান থেকে দ্রুত সরে পড়ি। শুধু মোবাইলটিই সঙ্গে নিতে পেরেছিলাম। একটাই আশা ছিল কবুতরগুলোর প্রাণ যেন বাঁচে।'

আংশিক পোড়া ঘরটিতে ফিরে এসেছে মোরশেদুল হক শাকিলের প্রিয় কবুতর। ছবিটি ১৪ মার্চ ২০২৩, কুনিপাড়া থেকে তোলা। ছবি: শাহীন মোল্লা/স্টার

ফায়ার সার্ভিসের ১১টি ইউনিট ও স্থানীয় মানুষের সহায়তায় প্রায় দুই ঘণ্টা পর, রাত ১০টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। রাত ১টার দিকে আগুনের ধোয়া, মানুষের হাহাকার ও ছোটাছুটির মধ্যে হঠাৎ কবুতরের ওড়াউড়ি চোখে পড়ে শাকিলের।

তিনি বলেন, 'টিনশেড চার তলা বাড়িটির নিচতলায় আমি থাকতাম। আগের ৬টা বাড়ি পুরোপুরি পুড়ে গেছে। আমার বাড়িটিও আংশিক পুড়েছে। আরেকটু হলেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। মাঝরাতে দেখি মানুষের হট্টগোল, ভিড়ের মাঝে ঘরে থাকা টাকা পয়সা সব চুরি হয়ে গেছে। ভোরের দিকে আমি কবুতরগুলোর খোঁজ করতে যাই। দেখি আমরা ২৮টি কবুতরই তাদের আধপোড়া বাড়িতে ফিরে এসেছে।'

'যখন আগুন লাগে, তখন সবকটি কবুতরই বিপদ টের পেয়ে ঘর ছেড়ে আশেপাশে উড়ছিল। পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হওয়ার পর তারা আবার ফিরে এসেছে। সকালের দিকে আমি আবার কবুতর দেখতে যাই। দেখি ছোট ৭টি কবুতর নেই। সেগুলোও কেউ চুরি করে নিয়ে গেছে,' বলেন শাকিল।

আর্থিক সংকটের কারণে পরিবারসহ ঢাকায় থাকা সম্ভব হয়নি শাকিলের। তার স্ত্রী, সন্তান সবাই জামালপুরে থাকেন। কবুতর ভালোবাসেন। প্রতিদিন কবুতরের খাওয়ার পেছনে ৮০ টাকার মতো খরচ হয় তার।

'আমার ভালোবাসার প্রতিদান কবুতরগুলো দিয়েছে। আশেপাশে দেখেন, সব মানুষের যা কিছু ছিল সব হয় পুড়ে গেছে না হয় চুরি হয়ে গেছে। কিছু বাকি নেই। ঘরে সোনাদানা ছিল, টিভি-ফ্রিজ ছিল… চুরি হয়ে গেছে। কবুতরগুলো চাইলে একটু দূরের ছাদে যেখানে অন্য কবুতরের বাসা আছে সেখানে চলে যেতে পারতো। কিন্তু তারা সারারাত মাথার ওপরে ছিল। তারা পরিস্থিতি দেখেছে। তারপর সুবিধামতো আধপোড়া ঘরটিতেই ফিরে এসেছে,' বলেন তিনি।

আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে ঘরবাড়ি। ছবিটি ১৪ মার্চ ২০২৩, কুনিপাড়া থেকে তোলা। ছবি: শাহীন মোল্লা/স্টার

'রাতে আমি ছোট কবুতরগুলো নিয়ে চিন্তা করছিলাম। তারা মাত্র উড়তে শিখেছে। কোনো বিপদ হলে বাঁচবে কিনা এ নিয়ে দুশ্চিন্তিত ছিলাম। তারা ঠিকই নিজের প্রাণ বাঁচিয়েছিল। অথচ দেখেন এই ছোট কবুতরগুলো মানুষ চুরি করে নিয়ে গেল।'   

কবুতরের বুদ্ধিমত্তার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে 'বিহঙ্গকথন' বইয়ের লেখক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষক সাবর্ণি সরকার বলেন, 'ঐতিহাসিকভাবেই কবুতর বুদ্ধিমত্তার জন্য সুপরিচিত। প্রাচীনকালে কবুতরের মাধ্যমে চিঠি আদান-প্রদান হতো। তারা নিজেদের বাড়িঘর খুব ভালো চিনতে পারে। ঘরবাড়ির প্রতি তাদের তীব্র অনুভূতি আছে।'

আংশিক পোড়া ঘরটিতে ফিরে এসেছে মোরশেদুল হক শাকিলের প্রিয় কবুতর। ছবিটি ১৪ মার্চ ২০২৩, কুনিপাড়া থেকে তোলা। ছবি: শাহীন মোল্লা/স্টার

পাখিপ্রেমী এই শিক্ষক আরও বলেন, 'প্রখর বুদ্ধিমত্তার কারণে আগুন টের পেরে তারা নিরাপদ দুরত্বে চলে গিয়েছিল। আগুনে পুরো জায়গার চেহারা পাল্টে গেলেও তাদের ঘর অক্ষত ছিল, তারা ঘর চিনতে পেরেছে তাই ফিরে এসেছে। নিজের ঘর, খাবার, যে মানুষ তাদেরকে খাবার দেয় এসব বিষয়ে ওদের অনুভূতি প্রবল।'

Comments

The Daily Star  | English
social safety net budget

Safety Net Programmes: Slice for the poor only gets thinner

Although budgetary allocation for social safety net programmes has increased over the past 13 years, the share of compatible programmes has declined significantly.

1h ago