‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রাণ কেড়ে নেওয়ার মতো ভয়ংকর’

আজ শনিবার দুপুরে ‘কেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল চাই’ শিরোনামের এক ওয়েবিনারে এ কথা বলেন বক্তারা।
স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি জানিয়ে একটি ওয়েবিনারে বক্তারা বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকার হরণসহ ক্ষেত্রবিশেষে প্রাণ কেড়ে নেওয়ার মতো ভয়ংকর আইনে পরিণত হয়েছে। এই আইন যে কেবল নাগরিকের কন্ঠরোধ করছে তা নয়, এটি অপরাপর সব অধিকার হরণ করছে।

আজ শনিবার দুপুরে 'কেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল চাই' শিরোনামের এই ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত হয়। এটি আয়োজন করে মানবাধিকার ও আইনের শাসন বিষয়ক প্ল্যাটফর্ম নাগরিক।

ওয়েবিনারে অংশ নেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ, গবেষক ও মানবাধিকার কর্মী রোজিনা বেগম এবং ডিজটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলায় ভুক্তভোগী কয়েকজন। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক ও অধিকার কর্মী সি আর আবরার, সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন নাগরিক'র সদস্য ও অধিকারকর্মী রেজাউর রহমান লেনিন।

শুরুতে সঞ্চালক জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, 'সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম একটি নতুন ধারণা এবং একে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য আইনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আমাদের এটি স্বীকার করে নিতে দ্বিধা নেই যে নাগরিকের ডিজিটাল সুরক্ষার প্রয়োজন আছে। কিন্তু ২০১৮ সালে প্রণীত আইনে সেই সুরক্ষার লেশমাত্র নেই। এই আইনের মূল উদ্দেশ্য যেখানে নাগরিকের উপর সর্বৈব নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা, সেখানে সুরক্ষা খুঁজতে যাওয়া বাতুলতা মাত্র।'

এই আইনজীবীর অভিমত হলো, 'এই আইনের প্রায় সবগুলো ধারা ও উপধারা নাগরিকের মতপ্রকাশের সুরক্ষা ও স্বাধীনতা, ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার ও অন্যান্য নাগরিক অধিকারকে সীমিত ও ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষুণ্ণ এবং নাগরিকের জনবান্ধব কর্মকাণ্ডকে অপরাধীকরণ করেছে। আইন প্রণয়নের সময় নাগরিক সমাজের যথাযথ অংশগ্রহণ এবং মতামত প্রদানের পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকার কারণে আইনটি সুরক্ষা প্রদানের পরিবর্তে কেবল নিয়ন্ত্রণমুখী নিপীড়নমূলক চেহারা ধারণ করেছে এবং এই আইনের মাধ্যমে মামলা করার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে যেমন দমন করা হচ্ছে তেমনি যেকোনো প্রকারের বিরুদ্ধমতকে দমন করতে ভূমিকা পালন করছে।'

ওয়েবিনারে আলোচনার ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন রেজাউর রহমান লেনিন। সেখানে তিনি বলেন, 'ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকার হরণসহ ক্ষেত্রবিশেষে প্রাণ কেড়ে নেওয়ার মতো ভয়ংকর আইনে পরিণত হয়েছে।'

রেজাউর রহমানের ভাষ্য,  'এই আইন কেবল যা নাগরিকের কণ্ঠরোধ করছে তা নয়, এটি অপরাপর সকল অধিকার হরণ করছে, যা নাগরিকদের জন্য চরম নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছে।'

গবেষক ও মানবাধিকারকর্মী রোজিনা বেগম বলেন, 'অফলাইন ও অনলাইনে ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় বাংলাদেশ সরকারের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যদি কোনো সীমাবদ্ধতা অনলাইনের ওপর আরোপ করা হয়, তবে সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে, যেন সেটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন এবং আইন প্রণয়নের মানদণ্ডের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের সময় এসব আইনি বিধানকে বিবেচনা করা হয়নি; বরং নিবর্তনমূলক বিধি-বিধান চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।'

রংপুরের সাংবাদিক আফরোজা সরকার জানান, তার বিরুদ্ধে মোট ১১টি মামলা হয়েছিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে, যার মধ্যে ৩টি মামলা এখনো চলমান এবং এসব মামলায় তাকে নিয়মিত হাজিরা দিতে হচ্ছে।

চট্টগ্রামের সাংবাদিক আজিম নিহাদ জানান, তার বিরুদ্ধে করা মানহানির মামলা কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটে স্থানান্তর করা হলে ৩ মাসের মধ্যে তাকে ১৫-১৬ বার হাজিরা দিতে হয় এবং বিভিন্ন মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়।

একইভাবে শিক্ষক রুমা সরকার জানান, র‌্যাব তার বাসার দরজা ভেঙে ঢুকে ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনসহ সন্তানদের অনলাইন ক্লাস করার মোবাইল ফোন হস্তগত করে এবং মামলা হওয়ার পরে গত ২ বছর ধরে তিনি শিক্ষকতা পেশায় ফিরতে পারছেন না।'

ওয়েবিনারে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, 'সম্প্রতি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা কোনো কোনো মামলায় দেখা যাচ্ছে, অভিযুক্ত ব্যক্তিকে প্রথমে সাময়িক সময়ের জন্য "জোরপূর্বক গুম" এবং পরবর্তীতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে। আবার কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর এবং হেফাজতে নির্যাতনে মৃত্যুর ঠিক আগ মুহূর্তে তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দেওয়া হয়েছে, যা সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদ এবং নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনের পরিপন্থী।'

এমন কয়েকটি উদাহরণ হাজির করে এই অধ্যাপক বলেন, 'ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন মূলত সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে এবং ক্ষমতাশালী অপরাধীদের দায়মুক্তি দেওয়ার আইন।'

তার ভাষ্য, 'সরকারের অনুমতি ছাড়া এই মামলাগুলো হতেই পারে না। সম্প্রতি সরকার এতটাই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে যে, সম্প্রতি একটি কমিটি গঠন করেছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনলাইন কাজকর্ম মনিটরিং করার জন্য। এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই।'

ওয়েবিনারে সভাপতিত্বকারী অধ্যাপক সি আর আবরার বলেন, 'ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কার্যত আইনের শাসন নয়, আইন দ্বারা শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কোনোভাবেই ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের রক্ষা করে না; বরং নাগরিকদের মধ্যে আতঙ্ক ও ভীতি তৈরি করছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে, সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা এবং মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার হরণের বাস্তবতা বিদ্যমান। তাই আমরা নাগরিকদের পক্ষ থেকে অবিলম্বে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের জোর দাবি জানাচ্ছি।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ওয়েবিনারটি শেষ হয়।

Comments