তীব্র গরমেও কাটছে না শীতল পাটির দুর্দিন

শীতল পাটির জন্য বিখ্যাত টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলা।
তীব্র গরমেও কাটছে না শীতল পাটির দুর্দিন
টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলায় হিংগানগর গ্রামে পাটি বুনছেন এক নারী। ছবি: মির্জা শাকিল/স্টার

আবহমান বাংলায় যুগ যুগ ধরে ছিল শীতল পাটির চাহিদা। প্রচণ্ড গরমে ক্লান্ত-শ্রান্ত মানুষকে প্রশান্তি এনে দেয় বলেই এর নাম শীতল পাটি। এক সময়ে ঘরে ঘরে শীতল পাটির ব্যবহার ছিল। সময়ের পরিবর্তনে চাহিদার ধরন বদলে যাওয়ায় শীতল পাটির জৌলুস হারিয়ে গেছে। এই পেশায় জড়িতদের এখন চরম দুর্দিন।

শীতল পাটির জন্য বিখ্যাত টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলা। এখানকার হিংগানগরসহ কয়েকটি গ্রাম 'শীতল পাটির গ্রাম' হিসেবে পরিচিত।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে কম দামে প্লাস্টিক ম্যাট পাওয়া যায় বলে কমে গেছে শীতল পাটির চাহিদা। পাশাপাশি বেড়ে গেছে বেতসহ শীতল পাটি তৈরির উপকরণগুলোর দাম। ফলে হুমকিতে পড়েছে পাটিকরদের ঐতিহ্যবাহী পেশা।

এ ছাড়া, প্রয়োজনীয় পুঁজির অভাব ও বাজারজাতকরণের সমস্যা তো আছেই।

পাটিবেত দিয়ে হাতে তৈরি করা হয় শীতল পাটি। বুনন কৌশল ও কাজের দক্ষতায় পাটিতে ফুটিয়ে তোলা হয় জ্যামিতিক নকশা। এ ছাড়া, জীবজন্তু, ব্যবহার্য দ্রব্যাদি, মসজিদ, ফুল, লতাপাতা, নৌকা, পালকি ইত্যাদি ফুটিয়ে তোলা হয় শীতল পাটির বুননে।

দেলদুয়ার উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার কয়েকটি গ্রামে প্রায় এক হাজার পরিবার বংশ পরম্পরায় শীতল পাটি তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে। তবে এই কাজে তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে না।

সম্প্রতি উপজেলার হিংগানগর, মুশুরিয়া, গজিয়াবাড়ি, আটিয়া ও এলাসিনসহ কয়েকটি শীতলপাটির খ্যাতিসমৃদ্ধ গ্রাম ঘুরে এই চিত্র দেখা গেছে।

সেখানে দেখা যায়, পাটিকরদের কেউ পাটি বুনছেন, কেউ বেত কাটছেন, আবার কেউ তৈরি পাটি বাজারে নেওয়ার ব্যবস্থা করছেন। সবমিলিয়ে বেশ কর্মব্যস্ত দিন কাটালেও তাদের দুর্দিন কাটছে না বলে জানান তারা।

পাটিকররা জানান, গরমের মৌসুম ছাড়া অনেকটা হাত গুটিয়েই বসে থাকতে হয়। গরমে পাটি বুননের কাজ বেড়ে যায়। গরমের তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাটি বিক্রিও বাড়তে থাকে।

তবে বাজারে প্লাস্টিকের ম্যাটের কারণে শীতল পাটি বিক্রি কমে গেছে উল্লেখ করে তারা আরও জানান, এই এলাকার শীতল পাটি ৫০০ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়ে থাকে। অথচ বাজারে ১০০ টাকা থেকে ১৫০ টাকাতেও প্লাস্টিক ম্যাট পাওয়া যায়।

সারা দেশে চাহিদা থাকলেও বেতের অপ্রতুলতা ও মূলধনের অভাবে পাটি শিল্পের প্রসার ঘটানো যাচ্ছে না বলেও জানান স্থানীয় পাটিকররা।

পাটিকররা টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলায় হিংগানগর গ্রামে পাটি বুনছেন। ছবি: মির্জা শাকিল/স্টার

হিংগানগর গ্রামের জীবন কুমার দে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পাটি তৈরির প্রধান উপকরণ বেতের চাষ ক্রমাগত কমে যাওয়ায় এই শিল্প সংকটে পড়েছে। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের অনেকেই পেশা বদলে ফেলছেন।'

পাটি বাজারজাতকরণের সুষ্ঠু ব্যবস্থা না থাকায় বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা থেকে ঋণ পাওয়া খুবই কঠিন বলে জানান তিনি।

একই গ্রামের পাটিকর সুমন কুমার দে বলেন, 'একটি পাটি বুনতে অন্তত ২ দিন সময় লাগে। নারীরা সংসারের অন্যান্য কাজের পাশাপাশি পাটি বোনেন।'

'একটি এক হাজার টাকা দামের পাটি তৈরির জন্য মজুরি দেওয়া হয় ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। তবে তা বিক্রি করে পাটিকররা তেমন লাভবান হন না,' যোগ করেন তিনি।

জামালপুর থেকে আসা পাইকার দীলিপ কুমার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এখান থেকে প্রতিটি ছোট শীতল পাটি ৭০০ থেকে ১ হাজার টাকা ও বড় পাটি ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকায় কিনে প্রতি পাটি ৫০ থেকে ১০০ টাকা লাভে বিক্রি করি।'

সপ্তাহে শুক্র ও শনিবার হিংগানগর গ্রামে পাটির হাট বসে। নানা স্থান থেকে পাইকাররা এসে এখান থেকে পাটি কিনেন।

স্থানীয়রা আরও জানান, এখানে শীতল পাটি, শীতল নকশি পাটি ও বুটকা পাটিসহ বেশ কয়েক রকমের পাটি তৈরি হয়।

টাঙ্গাইল মেইন রোডের পাটি ব্যবসায়ী দেলদুয়ার উপজেলার হিংগানগর গ্রামের দুলাল চন্দ্র দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাহারি পাটি সাজিয়ে রেখেছি, কিন্তু ক্রেতা নেই বললেই চলে। এই বেচাবিক্রি দিয়ে চলা কঠিন।'

'আগে দোকানে শুধু বেতের পাটিই রাখতাম। এখন প্লাস্টিকের ম্যাটও রাখি,' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'আসলে শীতল পাটির দামের তুলনায় প্লাস্টিকের ম্যাটের দাম অনেক কম। ক্রেতারা সেগুলোই বেশি চায়।'

'এরপরও কিছু মানুষ আছে যারা শীতল পাটিই ব্যবহার করেন। তবে তারা সংখ্যায় খুবই কম,' যোগ করেন তিনি।

আটিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সিরাজুল হক মল্লিক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শত বছরের ঐতিহ্য শীতল পাটি শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারি সহায়তা প্রয়োজন। সারা বিশ্বে প্রাকৃতিক আঁশ দিয়ে তৈরি সামগ্রীর কদর বাড়ছে। আমি মনে করি, উন্নত প্রশিক্ষণ ও ঋণ সুবিধাসহ প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেলে স্থানীয়ভাবে তৈরি শীতল পাটি বিদেশে রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব।'

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের টাঙ্গাইল অফিসের সহকারী মহাব্যবস্থাপক শাহনাজ বেগম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'একটি প্রকল্পের আওতায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ১ থেকে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ সুবিধা দেওয়া হয়। দেলদুয়ারে ৩০ থেকে ৪০ জনকে ঋণ দেওয়া হয়েছে। আদায়ের হারও ভালো। আবেদন করলে আরও পাটিকরকে এই ঋণ দেওয়া হবে।'

Comments