‘পেটে ভাত নাই, বাড়িতে অসুস্থ মা, জরিমানার ১২০০ টাকা কইত্তে পামু’

‘আমাদের এত কামাই আছে’
সোনারগাঁও মোড়ে রিকশা আটকে ডাম্পিংয়ের জন্য নেওয়া হয়েছে। ইনসেটে রিকশাচালক আয়নাল হক। ছবি: স্টার

'সকাল থেকে ৩০০ টাকা আয় করছি। এখন কামাই করমু কেমনে। মহাজন আমাদের মারব। বলবে রিকশা নিয়ে আয়। জরিমানার ১ হাজার ২০০ টাকা কই পামু এখন? পেটে ভাত নাই। বাড়িতে অসুস্থ মা আছে। কিসের ভিআইপি। সরকার যদি রোড ভিআইপি করে, আমরা কী করি খামু।'

কথাগুলো বলছিলেন রিকশাচালক আয়নাল হক। আজ মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সোনারগাঁ মোড়ের সামনে তার রিকশা আটকায় পুলিশ।

সোনারগাঁ মোড়ের গোলচত্বরের মধ্যে কোনো রিকশা এলেই সেটি আটকায় পুলিশ। তবে সব সময় রিকশা আটকানো হয় না।

সরেজমিনে দেখা গেছে, আজ মঙ্গলবার সকালের দিকে সোনারগাঁ মোড়ে ২টি পিকআপ ভ্যান রাখা হয়। সকাল ৮ থেকে ১১টার মধ্যে এখানে রিকশা আটকায় পুলিশ। ২টি পিকআপ ভ্যান ভরে গেলে রিকশাগুলো নেওয়া হয় বসিলার ডাম্পিং স্টেশনে।

ডাম্পিং স্টেশন থেকে একটি রিকশা ছাড়িয়ে নিতে রশিদের মাধ্যমে ১ হাজার ২০০ টাকা দিতে হয়ে। সেই রশিদের একটি ছবি দ্য ডেইলি স্টারের হাতে এসেছে।

তবে রিকশাচালকরা জানিয়েছেন, সেখানে একটি স্ট্যাম্পে সই দিতে হয়। সেই স্ট্যাম্প আবার রিকশাচালকদেরই ২৫০ টাকা দিয়ে কিনতে হয়। এভাবে একটি রিকশা ছাড়িয়ে আনতে প্রায় দেড় হাজার থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকার মতো খরচ হয়।

আজ সকাল সাড়ে ১০টার দিকে দেখা যায় ২টি পিকআপ ভ্যানে ৬টি রিকশা তোলা হয়েছে। এই প্রতিবেদকের সামনে চালকসহ রিকশাগুলো ডাম্পিংয়ের জন্য নিয়ে যায় হয়।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে রিকশাচালক আয়নাল হক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি কাইলকা ঢাকায় আইছি। আজ আমার গাড়ি ধরছে। আমি বলছি আমার বাসায় অসুস্থ লোক আছে, আমার গাড়িটা ছাড়ি দেন। পুলিশ ছাড়ি দিচ্ছে না। পাও ধরছি, কাঁদতেছি তাও মানতেছে না। নতুন আসছি, জানি না এই রাস্তা ভিআইপি। আমার রিকশা গাড়িত তুললো।'

রিকশাচালক মো. সাইফুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রাস্তা ভিআইপি হলে আনসার থাকে। আনসার সংকেত দেবে। তারপর আমরা আসি না। এলে তখন ধরে। এখন আনসার নাই, গাড়ি নিয়ে আইসি, এখন ধরতেছে। এখন আমরা মালিককে কী জবাব দেবো? আনসার সংকেত দিলে আমরা ঘুরে যাই। আজ কেউ সংকেত দেয়নি। গাড়িতে যাত্রী ছিল। যাত্রী নামিয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে যাচ্ছে। এখন ১ হাজার ২০০ ট্যাকা জরিমানা দিলে গাড়ি ছাড়ি দিবো না হলে দিবো না।'

জরিমানার টাকা রিকশাচালকদের দিতে হয় জানিয়ে তিনি বলেন, 'সকাল থেকে ২০০ টাকা ভাড়া পাইছি। এখন এই জরিমানার টাকা কই পাব?'

রিকশাচালক মো. সিরাজ বলেন, 'আমি এক অফিসারকে লই আইছি। আমি আইতাম চাই না, কইছিলাম এইটা ভিআইপি রোড। তিনি বলেন, "তুমি যাও কেউ ধরবে না"। আমার সামনে দিয়া ৫টা রিকশা গেছে। তাদের ধরেনি। আমার রিকশাটা ধরছে।'

আরেক রিকশাচালক মো. সুরুজ মিয়া ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জরিমানার ১ হাজার ২০০ টাকা আমাগো বাড়ি থেকে আনি দেওন লাগবে। আমরা কইত্তে দিমু? আমাদের এত কামাই আছে? মহাজনে আমাগো মারব। বলবে, গাড়ি লইয়া আয়।'

সম্প্রতি শেখ ফিরোজের রিকশার আটকায় পুলিশ। সোনারগাঁ মোড়ে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রিকশা ধরে তালা মেরে দেয় পুলিশ। বলে রেকার বিল ৬০০ টাকা দিলে গাড়ি ছেড়ে দেবে। না হলে ডাম্পিংয়ে পাঠিয়ে দেবে। সেখানে ১ হাজার ২০০ টাকা খরচ করে আনতে হয়।'

রিকশার কাগজ ঠিক থাকা সত্ত্বেও ধরা হয় উল্লেখ করে ফিরোজ বলেন, 'আমাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে যে রশিদ দেওয়া হয়, সেই রশিদ সঙ্গে রাখলে যেদিন রিকশা ধরবে সেদিন আর কোথাও ধরবে না। পরের দিন থেকে আবার ধরা শুরু করে। মূলত টাকা খাওয়ার জন্য এই রিকশা ধরা হয়। আমার রিকশা ২ বার ধরছে।'

'আড়াইশ টাকার স্ট্যাম্প কিনতে হয়। সেই টাকা আমাদেরকেই দিতে হয়। আমাদের যদি আগে থেকে সিগন্যাল দেওয়া হয়, তাহলে তো আমরা রোডে যাই না। সিগন্যাল না দিয়েই গাড়ি ধরে,' তিনি যোগ করেন।

সোনারগাঁ মোড়ে দায়িত্বে থাকা ট্রাফিক ইন্সপেক্টর আনোয়ার কবির ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই রাস্তা হলো ভিআইপি। এই রাস্তায় রিকশা চলাচল নিষেধ। রিকশার গ্যারেজে গ্যারেজে গিয়ে আমরা জানিয়ে আসছি।'

অনেক রিকশাচালক ঢাকায় নতুন এবং জানেন না কোন সড়ক ভিআইপি। সেক্ষেত্রে সড়কে ওঠার মুখে কি আপনাদের লোক আছে তাদেরকে এই তথ্য জানানোর জন্য? এমন প্রশ্ন করলে আনোয়ার কবির বলেন, 'আমাদের লোকের সংকট আছে। লোক না থাকলে আমাদের সাইনবোর্ড দেওয়া আছে। তা ছাড়া এটা রিকশা মালিকের দায়িত্ব জানিয়ে দেওয়া যে, কোন সড়ক ভিআইপি।'

এই রিকশাগুলোর এখন কী হবে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'বসিলায় ডাম্পিং করা হবে। আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বাকি সিদ্ধান্ত নেবেন।'

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) মো. সেলিম রেজা এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) মো. মিজানুর রহমানকে ২ বার করে কল করলেও তারা ধরেননি। ক্ষুদেবার্তা পাঠালেও তারা জবাব দেননি।

Comments