ঈদে সিনেমা হলের সুদিন কি আর ফিরবে চট্টগ্রামে
পরিবার-বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা দেখা এক সময় বন্দর নগরী চট্টগ্রামের অনেক বাসিন্দার জন্য ঈদের দিনের একটি আবশ্যকীয় কাজের মতো ছিল। ঈদুল আজহায় কোরবানির পশুর কাজ নিয়ে ক্লান্তিকর দিন পার করার পর মানুষ সন্ধ্যায় খুঁজত বিনোদন। ইন্টারনেট ও বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল না থাকায় মানুষের ভরসা ছিল সিনেমা হল।
এই প্রবণতাটি ১৯৯০ এর দশক পর্যন্ত বেশ দেখা গেছে। সেই সময় ৩০টিওর বেশি সিনেমা হলে প্রাণবন্ত ছিল এই শহর। সিনেমাপ্রেমীরা ঈদের দিনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন। কারণ ঈদ উপলক্ষে আসত নতুন সিনেমা।
সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমার সংখ্যার চেয়ে সিনেমা হলের সংখ্যা বেশি হওয়ায় ঈদে নতুন সিনেমার বুকিং নিশ্চিত করা নিয়ে হলগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা লেগে থাকত। দর্শক টানতে হলগুলো সাজানো হতো রং-আলোয়, সংস্কার করা হতো নড়বড়ে আসনগুলো। সিনেমা হলের মালিক ও কর্মচারীরা থাকতেন উৎসবের মেজাজে।
বন্দর নগরীর পাঁচলাইশ এলাকার বাসিন্দা সত্তরোর্ধ্ব আবদুল হামিদ বলেন, 'যেহেতু সেই সময় এখনকার মতো ইন্টারনেট এবং এত বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ছিল না, তাই হলে সিনেমা দেখা ছিল শহর ও গ্রামীণ উভয় শ্রেণির মানুষের শখের কাজ। ঈদে বড় বাজেটের সিনেমাগুলো মুক্তি পেত বলে সিনেমাপ্রেমীরা পরিবার ও বন্ধুদের নিয়ে সিনেমা হলে ভিড় করতেন।'
তিনি বলেন, ঈদের দিন সন্ধ্যায় বা পরের দিন আমরা সিনেমা হলে যেতাম। এটা সেসময় একটা সাধারণ অভ্যাস ছিল। আজিম-সুজাতা, রহমান-শবনম এবং রাজ্জাক-কবরী জুটি আমাদের যুগের চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় ছিল।'
নগরীর বিবিরহাট এলাকার বাসিন্দা আসাদ হায়দার বলেন, 'ঈদের সময় সামাজিক ও পারিবারিক ঘরানার সিনেমাগুলোই বেশির মুক্তি পেত। ফলে পরিবারের সবাই মিলে সেগুলো উপভোগ করতে পারত। অবশ্য কিছু রোমান্টিক সিনেমাও মুক্তি পেত, যা তরুণদের বেশি আকৃষ্ট করত।'
তিনি বলেন, 'আশির দশকে যখন আমাদের তরুণ বয়স, তখন জাফর ইকবাল-ববিতা, ফারুক-ববিতা এবং আলমগীর-শাবানা ছিলেন রোমান্টিক সিনেমার সবচেয়ে প্রিয় জুটি। এ ছাড়া ওয়াসিম-অঞ্জু ঘোষ জুটি ফোক ঘরানার সিনেমা জনপ্রিয় করেছিল। আর সোহেল রানা ও জসিম ছিলেন অ্যাকশন সিনেমার অতুলনীয় তারকা।
ঈদের ৩ থেকে ৪ দিন আগে আমাদের টিকিট কিনে রাখতে হতো। তা না হলে সারা সপ্তাহে কোনো টিকিট পাওয়া যেত না। আগাম টিকিট বিক্রি ঈদের ১ সপ্তাহ আগে থেকে শুরু হতো।'
ঈদের দিন সিনেমা উপভোগ করার স্মৃতি মনে করতে গিয়ে কাতালগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা আব্দুল আজিজ বলেন, 'নব্বইয়ের দশকে আমার ছোটবেলায় ঈদের ছুটিতে আমরা বিভিন্ন হলে ২ থেকে ৩টি সিনেমা দেখতাম। তখন আমাদের প্রিয় জুটি ছিলেন ইলিয়াস কাঞ্চন-চম্পা, ইলিয়াস কাঞ্চন-দিতি, নাঈম-শাবনাজ, সালমান শাহ-মৌসুমী, সালমান শাহ-শাবনূর। এছাড়া ওমর সানী-মৌসুমী, শাকিল খান-পপি এবং রিয়াজ-পূর্ণিমা জুটিও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল সেই সময়। তখন রুবেল ছিলেন অ্যাকশন সিনেমায় অতুলনীয় নায়ক।'
সিনেমা দেখতে যাওয়ার অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করে আজিজ বলেন, 'এক ঈদুল আজহা উপলক্ষে সালমান শাহ ও মৌসুমী অভিনীত দেনমোহর নামের একটি সিনেমা মুক্তি পেয়েছিল। আমি ৩ বন্ধুসহ চকবাজার এলাকার গুলজার সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম। কিন্তু অনেক চেষ্টা করে অনেকক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়েও টিকিট পেলাম না।'
তিনি জানান, গুলজার সিনেমা হল আর নেই। এটি ভেঙে শপিং মল করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম সিনেমা হল মালিক সমিতির সভাপতি আবুল হোসেন বলেন, 'নগরীতে এক সময় ৩০টির মতো সিনেমা হল থাকলেও একে একে প্রায় সবগুলোই ভেঙে ফেলে বহুতল বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ১৯৯০ এর দশকের শেষের দিকে এই ভাঙার প্রবণতা শুরু হয়, যখন চলচ্চিত্র শিল্পে অশ্লীলতা আসে এবং দর্শকরা সিনেমা হল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।'
'তাছাড়া, বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের আগমন এবং ইন্টারনেটে সিনেমার সহজলভ্যতাও দর্শকদের সিনেমা হল বিমুখ হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল', যোগ করেন তিনি।
আবুল হোসেন আরও বলেন, 'চট্টগ্রামে আমিই একমাত্র মালিক যে এখনও শহরে ২টি সিনেমা হল পরিচালনা করছি। সিনেমা প্যালেস এবং সুগন্ধা (যা আগে ঝুমুর সিনেমা হল নামে পরিচিত ছিল)। এই ২টি ছাড়া শহরে বর্তমানে আর কোনো সিনেমা হল অবশিষ্ট নেই।'
১৯৭০ থেকে ১৯৯০ এর দশকের ঈদের দিনগুলোর কথা মনে করে আবুল হোসেন বলেন, 'নগরীর সব সিনেমা হলই ঈদ উপলক্ষে উৎসবমুখর হয়ে উঠত। হল মালিকরা ভালো ব্যবসার আশায় খোশ মেজাজে থাকতেন। কর্মচারীরাও খোশ মেজাজে থাকতেন। কারণ সেই সময় আকর্ষণীয় বোনাস পেতেন তারা।'
তিনি বলেন, 'একটি সিনেমা হলে ৩০ জনেরও বেশি লোক কাজ করত। আত্মীয়-স্বজনদের কাছে ঈদের সময় তাদের সে কী কদর! "একটা টিকিট ম্যানেজ করে দাও না, তুমি তো হলের স্টাফ, তুমি না পারলে কে পারবে?" এভাবে স্বজনরা তাদের অনুরোধ করতেন সিনেমার কিছু টিকিট ম্যানেজ করে দিতে।'
'হলে দর্শকের সংখ্যা বেশি ছিল। তাই আমাদের প্রায় প্রতিটি শোতে অতিরিক্ত আসনের ব্যবস্থা করতে হতো। অতিরিক্ত আসনও যখন পূর্ণ হয়ে যেত, তখন কিছু লোক দাঁড়িয়ে সিনেমা দেখার জন্য অনুরোধ করত। টানা আড়াই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে তারা সিনেমা দেখত, ভাবা যায়!', যোগ করেন তিনি।
এখন আর সেই দিন নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'শহরের সিনেমা হলগুলো—বনানী কমপ্লেক্স, জলসা, নুপুর, মেলোডি, উজালা, লায়ন, খুরশিদ মহল, রঙ্গম, গুলজার, আলমাস, দিনার, সানাই, উপহার, রিদম, সাগরিকা, অলঙ্কার, আকাশ, চাঁদনী, কর্ণফুলী, রূপালী, পূরবী, গ্যারিসন- একের পর এক ভেঙে ফেলে সিনেমা হলের বদলে বহুতল শপিং মল তৈরি করা হয়েছে।'
সমাধান কি মাল্টি-স্ক্রিন?
চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ী নেতাদের মতে, এখন দিনে দর্শকদের রুচির পরিবর্তন হয়েছে। তারা আর পুরনো দিনের সিনেমা হলগুলোতে গিয়ে সিনেমা দেখতে আগ্রহী নন। তারা চান সিনেমা হলে আরামদায়ক পরিবেশ, উন্নত সাউন্ড সিস্টেম এবং স্ক্রিন, যা তাদের চোখ ও কানকে আরাম দেবে।
বাংলাদেশ মোশন পিকচার এক্সিবিটরস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন উজ্জ্বল বলেন, 'গত ২০ বছরে দেশে মোট ১ হাজার ২০০ সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেছে। মাত্র ২০০টি হল অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য সংগ্রাম করছে।'
'সিনেমা হলের ধারণাটি ৭০ বছরের পুরনো এবং অন্যান্য প্রবণতার মতো হলে সিনেমা দেখার প্রবণতাও সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে। মানুষ এখনও বড় পর্দায় সিনেমা উপভোগ করতে চায়। কিন্তু সেটা তাদের কাছে আরামদায়ক হতে হবে', যোগ করেন তিনি।
দর্শকদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে ঢাকায় একের পর এক মাল্টিপ্লেক্স গড়ে তোলা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ও বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। ইতোমধ্যে শহরে কয়েকটি মাল্টিপ্লেক্স চালু হয়েছে এবং দর্শকদের কাছ থেকে ভালো সাড়া পাচ্ছে।'
চট্টগ্রামের প্রথম সিনেপ্লেক্স সিলভার স্ক্রিন ২০১৮ সালের জুলাই মাসে চট্টগ্রামে যাত্রা শুরু করে। শহরের ষোলশহর ২ নম্বর গেট এলাকায় ফিনলে স্কয়ারে অবস্থিত মাল্টিপ্লেক্সটি বেশ ভালো সংখ্যক দর্শকদের আকর্ষণ করছে বলে জানান দর্শকরা।
গত বছরের ২ ডিসেম্বর বন্দর নগরীতে চালু হয় আরেকটি মাল্টিপ্লেক্স 'স্টার সিনেপ্লেক্স'। এটি শহরের চক বাজার এলাকায় বালি আর্কেড শপিং কমপ্লেক্সে অবস্থিত।
উদ্বোধনকালে স্টার সিনেপ্লেক্সের চেয়ারম্যান মাহবুব রহমান রুহেল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, চট্টগ্রামে বিপুল সংখ্যক চলচ্চিত্রপ্রেমী আছেন যারা স্টার সিনেপ্লেক্সের মতো মাল্টিপ্লেক্স আশা করছেন।
তিনি বলেন, 'আমি নিজে চট্টগ্রামের সন্তান। অনেকেই আমাকে তাদের ইচ্ছার কথা বলেছেন। বলা যায়, এটা চট্টগ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি। এই চাওয়াটা আগে পূরণ করতে চেয়েছিলাম। নানা কারণে তা হয়নি। এখন কাজটি করতে পেরে আমি আনন্দিত।'
তিনি বলেন, একের পর এক সিনেমা হল বন্ধ হওয়ার খবর যখন দেশে হতাশা তৈরি করছে, তখন সিনেপ্লেক্সের নতুন মাল্টিপ্লেক্স নির্মাণের খবর সিনেমাপ্রেমীদের মধ্যে আশার সঞ্চার করছে। দেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির সম্প্রসারণে আমাদের এই উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে। আমরা বিশ্বাস করি বাংলা সিনেমার সেই উত্তাল দিন আবার ফিরে আসবে। পরিবার নিয়ে সিনেমা হলে যাওয়ার সংস্কৃতি আবার চালু হবে। আমরা এর জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা করছি।'
Comments