রিকশা যখন ঝালমুড়ি দোকান

রিকশা যখন ঝালমুড়ি দোকান
পাবনা শহর ও আশেপাশের এলাকায় প্রায়ই চোখে পড়ে চলমান এই ঝালমুড়ির দোকানটি। ছবি: আহমেদ হুমায়ুন কবির তপু/স্টার

পাবনা শহর ও আশেপাশের এলাকায় প্রায়ই চলার পথে চোখে পড়ে চলমান একটি ঝাল মুড়ির দোকান। কখনও দোকানটি শহরের ভিড়ের মধ্যে কোথাও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়, যেখানে ঝালমুড়ি, চিরা ভাজাসহ নানারকম মুখরোচক খাবারের পসরা দেখে ভিড় জমায় ভোজনরসিকরা। 

কিছুক্ষণ পরেই দোকানটি আবার যাত্রী নিয়ে আপন গতিতে চলতে শুরু করে, বিষয়টি আগ্রহের সৃষ্টি করায় কাছে এগিয়ে যেতে দেখা গেল এটি কোনো দোকান নয়, এটি একটি রিকশা। রিকশাচালক তার উদ্ভাবনী চিন্তা থেকে যাত্রীবাহী রিকশাকে দোকানে পরিণত করেছে, ফলে যাত্রী পরিবহনের পাশাপাশি বেচাবিক্রিও করছে সে তবে সেটা শখের বশে নয়, প্রয়োজনের তাগিদে।

পাবনা শহরের বাবলাতলা এলাকার দরিদ্র রিকশাচালক মাসেম খান অনেক কষ্টে ধার দেনা করে প্রায় লাখ টাকা খরচ করে বছর খানেক আগে একটি ব্যাটারিচালিত রিকশা কিনেছেন। তবে শুধু রিকশা চালিয়ে পাঁচ সদস্যের দরিদ্র পরিবারের খরচ যোগানোর পাশাপাশি ঘরে অসুস্থ স্ত্রীর পেছনে ওষুধের খরচ যোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে।

তবে হতাশ না হয়ে রিকশা চালনোর পাশাপাশি আরও কিছু করার চিন্তা থেকেই নিজের উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে নিজের রিকশাকেই দোকান বানিয়েছেন তিনি।

কয়েক মাস ধরে চিন্তা করে রিকশার সামনে লোহার খাঁচা করে সেখানে থরে থরে, মুড়ি, চিড়া, চানাচুর, ছোলা, পেঁয়াজ, রসুন, তেল, মসলাসহ ডজন খানেক বয়ামের পসরা সাজিয়ে পুরো রিকশাকে দোকানের রূপ দিয়েছেন তিনি। রিকশার সামনে দোকানের সাইনবোর্ড দেওয়া হয়েছে। দূর থেকে রিকশার সামনের অংশ দেখলে এটিকে একটি দোকান ছাড়া কিছু ভাবার অবকাশ নেই।

রিকশা চালক মাসেম খান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, রিকশা চালিয়ে দিনে ৫ থেকে ৭শ টাকার বেশি আয় হয় না। এ টাকা দিয়ে বাড়ি ভাড়া, কিস্তির টাকা, সংসার খরচ যোগানোর পাশাপাশি স্ত্রীর ওষুধের টাকা যোগার করা সম্ভব হয় না তার।

এখন রিকশা চালানোর পাশাপাশি ঝালমুড়ির দোকানটিতে চলার পথে আরও প্রায় ৪/৫শ টাকার বেচাকেনা হয়। সব মিলিয়ে দিনে এখন হাজার খানেক টাকা আয় হচ্ছে। ফলে সংসার খরচ, ওষুধের খরচের যোগান দিতে এখন আর তার সমস্যা হচ্ছেনা ।

মাসেম বলেন, যাত্রী নিয়ে ভাড়া নিয়ে যেখানে যাই সেখানেই আমার ঝালমুড়ি খেতে লোকজন এগিয়ে আসে। চলার পথে বিভিন্ন এলাকায় যাই, অনেক সময় ভাড়ার জন্য অপেক্ষা করি সেখানেও বসে না থেকে ঝালমুড়ি বেচাকেনা করি, আবার যাত্রী পেলে তাদের নিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হই। প্রতিদিন দুপুর ১টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত রিকশা চালানোর পাশাপাশি দোকানটি চালান বলে জানান তিনি।

এছাড়া রিকশার সামনে তার মোবাইল নম্বর সেঁটে দেয়া রয়েছে, ফলে প্রয়োজনে কোনো যাত্রী বা গ্রাহক তাকে কল দিলেই মাসেম সেখানে ছুটে যায়। এভাবেই পাবনার একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে মাসেমের রিকশা-ঝালমুড়ির দোকানটি প্রতিদিন ছুটে বেড়ায়।

ব্যতিক্রমী এরকম চলমান রিকশা-দোকান যাত্রীদের মধ্যেও আগ্রহের তৈরি করেছে। অনেকেই বেড়ানোর জন্য তার রিকশা ভাড়া করে ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি মুখরোচক খাবারের স্বাদ উপভোগ করছে। সাধারণ যাত্রীরা মনে করছে, মাসেমের এমন উদ্ভাবনী কাজ দেখে আরও অনেকে এগিয়ে আসবে।

তার রিকশার নিয়মিত যাত্রী পাবনা শহরের কাচারিপারা এলাকার ব্যবসায়ী শামিম রেজা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, প্রথমে শখের বশে তার রিকশায় পরিবার নিয়ে বেড়াতে যাই, চলার পথে সে ঝালমুড়ি, চিড়া ভাজা দিয়ে আপ্যায়ণ করে। মাসেমের রিকশায় ভ্রমণ করতে যেয়ে এমন ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতা পরিবারের সবাই উপভোগ করে। এখন প্রায়ই তার রিকশা ভাড়া করে পরিবার নিয়ে ঘুরতে যান বলে জানান তিনি।

শৌখিন ফটোগ্রাফার জিয়াউল হক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, মাসেমের রিকশার ভেতরের যাত্রী পরিবহনের জায়গা ঠিক রেখে সামনের খোলা অংশ ব্যবহার করে দোকান তৈরি করে নিজের রোজগার বৃদ্ধির এ উদ্যোগ নিঃসন্দেহে একটি অভিনব এবং অনুকরণীয় প্রযুক্তি।

মাসেমের স্ত্রী শিলা খাতুন স্বামীর ঝালমুড়ির দোকানের সব কাজ সে বাড়িতে নিজেই করেন বলে জানান।

রিকশা চালক মাসেম বলেন, আমি খুব দরিদ্র পরিবারের মানুষ, ছোটবেলা থেকেই রিকশা চালিয়ে পেটের ভাত যোগার করছি। এখন সংসার হয়েছে, দুটি সন্তান হয়েছে, তারা লেখাপড়া করছে, সংসার খরচ, বাচ্চাদের লেখাপড়ার খরচ, স্ত্রীর চিকিৎসার খরচ যোগাতে তাকে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে যেতে হচ্ছে। কারো আছে হাত পেতে নয়, পরিবারের প্রয়োজন মেটাতেই তিনি এই পথ বেছে নিয়েছেন।

এখন তাকে দেখে অনেকেই বিভিন্ন রকম উদ্যোগের কথা ভাবছেন বলে জানান তিনি। ইতোমধ্যে অনেকেই তার কাছ থেকে এ বিষয়ে ধারণা নিয়েছেন। তারাও এই উদ্যোগ শুরু করতে চায় বলে জানিয়েছেন।

Comments

The Daily Star  | English

Beyond development paradox & unnayan without democracy

As Bangladesh seeks to recalibrate its path in the aftermath of recent upheavals, the time is ripe to revisit an oft-invoked but under-examined agenda: institutional reform. Institutions are crucial to understand, as they are foundational for governance, transformation, and economic development.

17h ago