‘তল্লাশির নামে মানুষের মোবাইল ফোন চেক করা গণহয়রানি’

ঢাকায় রাজনৈতিক দলগুলোর সমাবেশকে কেন্দ্র করে গাবতলী ও আমিনবাজারসহ কয়েকটি সড়কে চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশির পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মোবাইল ফোন চেক করার অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। এর আগে গত বছরের ডিসেম্বরেও বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে গাবতলী ও আমিনবাজারে পুলিশের বিরুদ্ধে একই ধরনের তল্লাশির অভিযোগ উঠেছিল।

১৯৪৮ সালে ঘোষিত জাতিসংঘ মানবাধিকার ঘোষণার ১২ নম্বর আর্টিকেলে বলা হয়েছে, 'কারো ব্যক্তিগত গোপনীয়তা কিংবা তার গৃহ, পরিবার ও চিঠিপত্রের ব্যাপারে খেয়াল-খুশিমতো হস্তক্ষেপ কিংবা তার সুনাম ও সম্মানের ওপর আঘাত করা চলবে না। এ ধরনের হস্তক্ষেপ বা আঘাতের বিরুদ্ধে আ‌ইনের আশ্রয় লাভের অধিকার প্রত্যেকের‌ই রয়েছে।'

বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদেও বলা হয়েছে, 'রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, জনসাধারণের নৈতিকতা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনতা রক্ষার অধিকার থাকিবে।'

এভাবে চেকপোস্টে সাধারণ মানুষের মোবাইল ফোন চেক করার এখতিয়ার পুলিশের আছে কি না, তা নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না ও ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া এবং পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হকের সঙ্গে।

তল্লাশির নামে এভাবে মোবাইল ফোন চেক করাটা গণহয়রানি বলে মনে করেন জেড আই খান পান্না। তিনি বলেন, 'মোবাইল ফোন ও পকেটের মানিব্যাগ চেক করা যদি পুলিশের কাজ হয়, তাহলে রাষ্ট্রটা পুরোপুরি পুলিশি রাষ্ট্র বানিয়ে দেওয়া হলো। এগুলো তো মানুষের ব্যক্তিগত জিনিস। এমনিতেই রাষ্ট্রের কাছে আমার যে ব্যক্তিগত তথ্য ছিল, সেটাও বের করে দিয়েছে। সেটা রক্ষা করতে পারে নাই। তারপরে ঢাকা শহরে আমি হাঁটব, আমার মোবাইল ফোন চেক করবে, পকেট চেক করবে, এটা তো ঠিক না।'

পুলিশের এভাবে মোবাইল ফোন চেক করাটা আইনসম্মত কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমার তা মনে হয় না। এই কাজটা আইনসম্মত না বলেই আমার ধারণা।'

এক্ষেত্রে নাগরিকের করণীয় বিষয়ে এই আইনজীবীর ভাষ্য, 'এসব ক্ষেত্রে একজন নাগরিক আইনি পদক্ষেপ নিতে পারেন। কারণ আমার মোবাইল চেক করতে নিয়ে যদি রেখে দেয়, তাহলে সেটা দিয়ে তো ম্যাসেজ পাঠাতে পারে কিংবা থ্রেটও করতে পারে। সুতরাং এক্ষেত্রে নাগরিকের আইনি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।'

মোবাইল পুলিশ চেক করতে পারার মতো কোনো আইনি বিধান নেই বলে জানিয়েছেন ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। তিনি বলেন, 'মোবাইল ফোন ব্যক্তিগত বিষয়। অনুমতি ছাড়া কারো মোবাইল ফোনে হাত দিতে পারার এখতিয়ারও নেই। আমার মোবাইলে আমার ব্যক্তিগত অনেক কিছু থাকতে পারে। সেই মোবাইল চেক করলে তো আমার প্রাইভেসি থাকছে না। মোবাইল পুলিশ চেক করতে পারার মতো কোনো আইনি বিধান নেই। এটা গায়ের জোরে করা হয়।'

এই আইনজীবী বলেন, 'পুলিশের যে স্টপ অ্যান্ড সার্চ, একজন মানুষকে বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি করার যে আইনগত এখতিয়ার, সেটা ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় বলা আছে। ৫৪ ধারায় যে অধিকার দেওয়া হয়েছে, সেটি হাইকোর্ট বিভাগ ২০০৩ সালে পরিবর্তন করে পুলিশকে ১৫ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন। এই ১৫ দফা নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তীতে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। এরপরে আপিল বিভাগও কিছুটা পরিবর্তন করে সেই ১৫ দফা বহাল রাখে। সেই নির্দেশনার আলোকেও যদি বলি, পুলিশের এভাবে গণহারে মানুষকে তল্লাশি করারই কোনো অধিকারই নেই।'

'একজন লোক কোনো ধরনের অপরাধজনক কাজে জড়িত হয়েছেন বা জড়িত হতে পারেন, এমন সন্দেহ থাকলে আগে তল্লাশি করা যেত। কিন্তু, ১৫ দফা নির্দেশনায় বলা হয়েছে শুধু সাসপিশন থাকলেই হবে না, এটা ডায়েরিতে লিখতে হবে যে, কী কারণে ওই ব্যক্তিকে দেখে তার মনে হচ্ছে তিনি সন্দেহজনক কিছু বহন করছেন বা পলাতক আসামি কিংবা কোনো ধরনের অপরাধ করতে যাচ্ছেন। ডায়েরিতে সেটা লিখার পর পুলিশ তাকে বলবে যে, তারা কোন থানার পুলিশ এবং কেন তাকে সার্চ করা হচ্ছে। যদি কোনো কারণে তাকে গ্রেপ্তারের প্রয়োজন হয়, তাহলেও তার কাছে জানতে চাইতে হবে যে তিনি পরিবারের কেউ কিংবা আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলবে কি না। তার কাছে ফোন না থাকলে ফোন দিয়ে হলেও তাকে কাজটি করতে দিতে হবে। যদি গ্রেপ্তারের প্রয়োজন না হয়, শুধু সার্চ করার ক্ষেত্রে কেন তাকে সার্চ করা হচ্ছে, সেটা বলতেই হবে। ওই ডায়েরিটা মেইনটেন করতে না পারলে সংশ্লিষ্ট পুলিশের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারসহ ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান আছে', বলেন তিনি।

মোবাইল সার্চ করার কোনো অধিকারই পুলিশের নেই উল্লেখ করে জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, 'এখন গণহারে মানুষকে থামিয়ে মোবাইল চেক করাসহ যে তল্লাশি চালিয়ে ভয় দেখানো হচ্ছে, এতে তো মানুষের চলাচল, মত প্রকাশ ও সভা-সমাবেশ করাসহ সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। কোনো আইনে কোনোভাবেই পুলিশকে এই এখতিয়ার দেওয়া হয়নি।'

'পুলিশ কারো মোবাইল ফোন চেক করতে চাইলে তাদের বলতে হবে যে, কেন আপনি আমার মোবাইল চেক করতে চান। এর যথাযথ কারণ দেখাতে হবে। মোবাইল ফোন তো ব্যক্তিগত জিনিস। আমি যদি মোবাইল ফোন দিয়ে কোনো অপরাধ সংঘটন করে থাকি, তাদের কাছে যদি সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকে যে মোবাইল ফোন অপরাধ সংঘটনের টুল হিসেবে ব্যবহার হয়েছে, তাহলেও আমাকে বলতে হবে যে এই কারণে তারা আমার মোবাইল চেক করতে চায়। কেবল মনে হলো আর আমাকে দাঁড় করিয়ে আমার মোবাইল চেক করতে শুরু করল, কোনো সভ্য রাষ্ট্রে এই আচরণ হতে পারে না', যোগ করেন তিনি।

তবে পুলিশের কাছে নাশকতা বা ষড়যন্ত্রের বিষয়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদন থাকলে তারা র‌্যানডম মোবাইল চেক করতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক আইজিপি শহীদুল হক। তার ভাষ্য, 'যদি কোনো গোয়েন্দা প্রতিবেদন থাকে যে, এরকম কিছু লোক আসছে যারা নাশকতা বা ষড়যন্ত্র করতে পারে, তারা মোবাইলের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করছে, তাহলে পুলিশ র‌্যানডম মোবাইল ফোন চেক করতে পারে। গোয়েন্দা প্রতিবেদন না থাকলে তো তারা এটা করার কথা না।'

Comments

The Daily Star  | English
Graft allegations against Benazir Ahmed

Interpol issues red notice against ex-IGP Benazir

Authorities have so far submitted red notices requests against 12 individuals, including several high-ranking officials of the AL regime

1h ago