রাজনৈতিক দ্বৈততা ও নৈতিক বিভ্রান্তি

প্রতীকী ছবিটি সংগৃহীত

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদের নির্বাচন হয়েছিল ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি—প্রার্থী ছিলেন ছয় জন। জালিয়াতি ও প্রতারণাপূর্ণ নির্বাচনে ফজলে নূর তাপস চার লাখ ২৪ হাজার ৫৯৫ ভোট এবং ইশরাক হোসেন দুই লাখ ৩৬ হাজার ৫১২ ভোট পেয়েছিলেন। কিন্তু বিএনপি সেই নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে, ভোট কারচুপি ও অনিয়মের অভিযোগ তোলে।

যে নির্বাচনের ফলাফল দলীয়ভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে, সেই নির্বাচনে নিজেকে বিজয়ী ঘোষণার আবেদন জানিয়ে মামলা করেন ইশরাক। নির্বাচন জালিয়াতি হয়েছে, কারচুপি হয়েছে, অনিয়ম হয়েছে—এটা ধ্রুব সত্য। কিন্তু ইশরাককে বিজয়ী ঘোষণা করলেই নির্বাচন বৈধ হবে—এটা আইনের দৃষ্টিতে, নৈতিকতার দৃষ্টিতে, বিবেচনার দৃষ্টিতে, এমনকি ন্যায্যতার দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়।

ইশরাক জনপ্রিয়—সেটা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রমাণ হতে হবে এবং নির্বাচন ছাড়া মেয়র পদে আসীন হওয়ার কোনো বিকল্প পথ নেই। জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিএনপি লড়াই করে, দলটির নেতাকর্মীরা ঝুঁকির মুখে পড়ে। কিন্তু ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের সময়ের সেই অবৈধ নির্বাচনের বৈধতা দেওয়ার জন্য বিএনপি দিনের পর দিন আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে, সড়ক অবরোধ করেছে, নগর ভবন তালাবদ্ধ করে রেখেছে।

যে মেয়রের পদ অপসারণ হয়ে গেছে এবং নির্বাচনের পর পাঁচ বছর মেয়াদেরও অবসান হয়েছে, সেই মেয়র পদকে নিয়ে বিএনপির মতো রাজনৈতিক দলের এই ভয়ঙ্কর খেলায় মেতে ওঠার গভীর পর্যালোচনা জরুরি ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য।

আদালতের ভূমিকা ও রাষ্ট্রকাঠামোর ভারসাম্য

একটি বিলুপ্ত ও অপসারিত মেয়র পদে আদালত কি কাউকে পুনঃনিয়োগ করতে পারে? আদালতের একতরফা রায়ে শপথ গ্রহণ রাষ্ট্রের ক্ষমতার ভারসাম্য লঙ্ঘনের সামিল। এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন হলে আইনি ব্যাখ্যা দিয়ে প্রহসনমূলক নির্বাচনও বৈধ হতে পারে—যা রাষ্ট্রকে বিপজ্জনক ন্যায়বিচারবিরোধী পথে নিয়ে যাবে।

যে নির্বাচন ত্রুটিপূর্ণ, জালিয়াতিতে ভরপুর, সেই নির্বাচনে প্রতিপক্ষকে বিজয়ী ঘোষণা করলেই নির্বাচনের বৈধতা নিশ্চিত হয়ে যায়—এমন ধারণা নিশ্চয়ই গণতন্ত্রে নেই।

একবার সংসদ বিদ্যমান থাকা অবস্থায় নতুন সংসদের সদস্যরা শপথ পাঠ করেন। এ নিয়ে উচ্চ-আদালতে মামলা হয়। সংসদ সদস্যদের শপথ পাঠ অবৈধ ঘোষণার দাবি জানানো হয়। কিন্তু উচ্চ আদালত তা 'Past and closed' বলে নিষ্পত্তি করেন। অর্থাৎ, বিষয়টি অতীত হয়ে গেছে এবং চূড়ান্তভাবে নিষ্পন্ন হয়েছে, এখন আর তা নতুন করে বিচারযোগ্য নয়। কিন্তু ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন প্রশ্নে নিম্ন আদালত তা অনুসরণ করেনি। ফলে, রাষ্ট্রকে প্রচণ্ড জটিলতা মোকাবিলা করতে হচ্ছে।

মেয়র নির্বাচন জালিয়াতি ও কারচুপিপূর্ণ হয়েছে—অর্থাৎ জনগণ নিজের অভিপ্রায় অনুযায়ী ভোট দিতে পারেনি। সেই পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত ১৯ আগস্ট ১২টি সিটি করপোরেশনের মেয়রকে অপসারণ করে।

ইশরাকের দুর্ভাগ্য—যিনি জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ে ভূমিকা রেখেছেন, সেই তিনি একটি স্বীকৃত জালিয়াতিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে মেয়র হওয়ার সুযোগ প্রত্যাখ্যান করেননি। আদালতে রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ইশরাক ঘোষণা দিতে পারতেন—আদালতের রায়ে নয়; জনগণের রায়ে নির্বাচিত হবো। ইশরাক এই নৈতিক উচ্চতর অবস্থান গ্রহণের যে সুযোগ পেয়েছিলেন, তা চিরতরে হারিয়েছেন।

যে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েও নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে শপথ গ্রহণ করেননি, সেই দলেরই ইশরাক কারচুপির নির্বাচনে হেরে গিয়েও শপথ নিতে চাইছেন। শুধু তাই নয়; জনগণ যেন দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে ন্যূনতম সেবা না পায়, সেজন্য তিনি নগর ভবন ক্রমাগত অচল করে রেখেছেন। ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে এজন্য বিএনপিকে খেসারত দিতে হতে পারে।

নৈতিক কর্তৃত্ব বনাম আইনগত বৈধতা

একজন ব্যক্তি দাবি করতে পারেন যে, তিনি নৈতিকভাবে বিজয়ী। যেমন: নির্বাচনে ভোট চুরি কিংবা প্রহসন হয়েছে। কিন্তু জন রলসের 'Political liberalism'-এর আলোকে বলা যায়, নৈতিক অধিকার আইনগত বৈধতাকে প্রতিস্থাপন করতে পারে না, যদি না সেই দাবি জনসাধারণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য ও প্রমাণযোগ্য হয়।

ইশরাকের দাবি নৈতিক হলেও জনসম্মত নয়। কারণ, ভোটের প্রকৃত হিসাব বা গণরায়ের ভিত্তি নেই।

ঢাকা দক্ষিণের নগরবাসী কেউ জানে না, ইশরাক কত ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বীরা কত ভোট পেয়েছে। ইশরাক নিজেও জানেন না, তিনি কত শতাংশ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করছেন। অথচ তিনি শপথ নিতে চেয়েছেন।

কিছুদিন পূর্বে পাকিস্তানের করাচি শহরের প্রাদেশিক বিধানসভার পিএস ১২৯ আসনে হাফিজ নাঈম-উর-রেহমানকে জয়ী ঘোষণা করে। কিন্তু নাঈম-উর-রেহমান বলেছেন, এই আসনে মূলত বিজয়ী হয়েছেন তেহরিক-ই-ইনসাফের অর্থাৎ পিটিআই সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী সাইফ বারী। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অর্থাৎ ইমরান খানের আসন কমাতে তাকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছে। সুতরাং এই আসনটি তিনি ছেড়ে দেবেন।

বিজয় প্রত্যাখ্যান করে হাফিজ নাঈম-উর-রেহমান বলেছেন, 'কেউ যদি আমাদের অবৈধ উপায়ে জেতাতে চায়, আমরা তা মেনে নেবো না।' তিনি আরও বলেছেন, 'জনমতকে সম্মান করতে হবে। বিজয়ীকে জিততে দিন, পরাজিতকে হারতে দিন।'

ইশরাক এই দুটি গুণ ব্যবহার করে বলতে পারতেন, জনগণের অবাধ ভোট ছাড়া আমি মেয়র হবো না। এটাই হতো নৈতিকতার গৌরব। কিন্তু তিনি সুযোগটি হারিয়ে ফেলেছেন। এতে বোঝা যায়, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে মূল্যবোধের সংকট কতটা গভীর।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান বলেছেন, ইশরাকের ক্ষমতা গ্রহণ বা শপথে বাধা সৃষ্টি করার মধ্য দিয়ে আবারও আমরা স্বৈরাচারী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাচ্ছি। স্বৈরাচারবিরোধী দীর্ঘ লড়াইয়ের অন্যতম নেতা তারেক রহমান বিবেচনায়ই নেননি যে, বিনা ভোটে ক্ষমতা গ্রহণ শুধুমাত্র গণতন্ত্রবিরোধীই নয়; এটি মানুষের মর্যাদারও পরিপন্থী। রুসো তার 'The Social Contract'-এ বলেন, 'জনসাধারণই রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিক।' জনগণের ভোট ছাড়া যখন কেউ ক্ষমতা গ্রহণ করে, তখন তা সার্বভৌমত্বের সরাসরি লঙ্ঘন। অমর্ত্য সেন বলেছেন, 'বিনা ভোটে ক্ষমতা গ্রহণ মানে সেই প্রক্রিয়াকে অস্বীকার করা, যা প্রকারান্তরে গণতন্ত্রের আত্মাকেই হত্যা করে।' জন লক বলেন, 'রাষ্ট্রের বৈধতা আসে জনগণের ইচ্ছার বৈধতায়।'

বিনা নির্বাচনে ক্ষমতা গ্রহণ আইনি পন্থায় হলেও নৈতিকভাবে বৈধ নয়, যদি না তা জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটায়। নৈতিক বৈধতা ছাড়া শাসন মানে জোরপূর্বক আধিপত্য—যা স্বৈরাচারের রূপ।

নৈতিক শক্তির দুটি অঙ্গ—

১. ন্যায্যতা উপলব্ধির সামর্থ্য।

২. শুভ চিন্তার সামর্থ্য।

ইশরাক এই দুটি গুণ ব্যবহার করে বলতে পারতেন, জনগণের অবাধ ভোট ছাড়া আমি মেয়র হবো না। এটাই হতো নৈতিকতার গৌরব। কিন্তু তিনি সুযোগটি হারিয়ে ফেলেছেন। এতে বোঝা যায়, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে মূল্যবোধের সংকট কতটা গভীর।

রাজনৈতিক দ্বৈততা ও নৈতিক বিভ্রান্তি

নির্বাচনের স্বীকৃতি না দিয়েও আদালতের শরণাপন্ন হয়ে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা এক ধরনের নৈতিক বিভ্রান্তি। জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে লড়াই করা ব্যক্তি যদি আদালতের রায়ে ক্ষমতা গ্রহণ করতে চান, তাহলে তিনি ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার নৈতিক অবস্থান থেকে সরে যাচ্ছেন— যা ইশরাকের ভবিষ্যৎ রাজনীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।

ইশরাক ঘোষণা করতে পারতেন—আদালতে জনগণের জয় হয়েছে, কারচুপির নির্বাচন প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। সুতরাং আমি আদালতের সেই সুযোগ নিতে পারি না জনগণের অবাধ ও সুষ্ঠু ভোট প্রয়োগ ছাড়া। আমি জনমতে বিজয়ী হবো, অন্য কোনো উপায় বা আদালতের আদেশের দ্বারা নয়।

ইশরাক যদি জনগণের প্রকৃত রায়ে বিশ্বাস রাখতেন, তবে আজ তিনি শুধু একজন নেতা নন, গণতন্ত্রের প্রতীক হয়ে উঠতেন। এই বিশ্বাস তার রাজনৈতিক ও নৈতিক অবস্থানকে উচ্চতর থেকে আরও উচ্চতর করতো। তিনি নিজের জন্য একটি মহান রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ গড়তে পারতেন। ইশরাক এমন সুযোগ এই জীবনে আর পাবেন না। দলীয় রাজনীতির সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ইশরাককে রাজনীতিতে মহৎ হওয়ার সুযোগ দিলো না, হয়তো নিজেও তিনি চাননি।

মূল্যবোধ ও নৈতিকতার দুর্ভিক্ষের এই জগতে ইশরাক প্রমাণ করতে পারতেন—নৈতিকতাই গৌরবের; ক্ষমতা নয়।

দার্শনিক হানা আরেন্ট বলেন, 'প্রকৃত কর্তৃত্ব আসে সম্মতি ও স্বীকৃতি থেকে, জবরদস্তি বা আত্মঘোষণায় নয়।' নির্বাচিত না হয়েও শপথ নেওয়া আসলে জনগণের সম্মতিকে বাইপাস করার চেষ্টা, যা আরেন্টের ভাষায় কর্তৃত্বের একপ্রকার প্রতিচ্ছায়া।

রাজনীতিতে নৈতিকতা হারিয়ে গেলে গণতন্ত্র একদিন কেবল আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়। আদালতের রায় দিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ, ভবন তালাবদ্ধ করে জনজীবন অচল, নির্বাচনের কারচুপিকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা—এর সবই নৈতিকতার অপচয়।

রাজনৈতিক দলগুলোকে নৈতিকতা পুনর্গঠনের চর্চা করতে হবে। ব্যক্তিগত বা দলীয় সুবিধার চেয়ে বৃহত্তর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে প্রাধান্য দিতে হবে। ন্যায় ও প্রতিনিধিত্ব পরিহার করে যে পথ বিএনপি অনুসরণ করছে, তা রাষ্ট্রকে নৈতিক সংকটে ঠেলে দিয়েছে। এর উত্তরণ একমাত্র সম্ভব জনইচ্ছার প্রতি শ্রদ্ধাশীল রাজনৈতিক দর্শনে প্রত্যাবর্তন।

Comments

The Daily Star  | English

No immediate tax relief despite inflation woes

There will be no tax relief for individuals in low- and middle-income brackets, at least in the next fiscal year, even though high inflation has significantly eroded their purchasing power over the last couple of years.

10h ago