ঢাবি শিক্ষক সমিতির ভুলে ভরা বিজ্ঞপ্তি

‘বাংলা ভাষার প্রতি অবমাননা ও চূড়ান্ত অবহেলার দৃষ্টান্ত’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনে করতেন, বাংলা বানান যতদূর সম্ভব উচ্চারণমূলক হওয়া উচিত। আবার ভাষাতত্ত্ববিদ ও গণিতজ্ঞ দেবপ্রসাদ ঘোষের মত ছিল, কেবল উচ্চারণের ভিত্তিতে বানান ঠিক করা উচিত নয়।

১৯৩৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বানান সংস্কারের উদ্যোগ নিয়ে এই দুই মনীষীর 'ঠোকাঠুকি' ও চিঠি চালাচালির বিষয়টি সর্বজনবিদিত হলেও তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে কখনো কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। তারা দুজনেই বাংলা বানানের যথাসম্ভব শুদ্ধ রূপটিই ধরতে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন ভাষার বিশুদ্ধতা।

বাংলা কথ্য ভাষায় উচ্চারণ এবং বিকৃতি নিয়ে যেমন বিতর্ক রয়েছে, তেমনি বানানের ক্ষেত্রে ভুলভ্রান্তিও ব্যাপক চোখে পড়ে।

রাস্তার দুপাশের সাইনবোর্ড, ব্যানার, দেয়াল-লিখন কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যবহারকারীদের বাংলা লেখার হাল দেখলেই এই দুরবস্থা বোঝা যায়।

তবে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভার ৩৪৮ শব্দের একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে অতি প্রচলিত শব্দের বানান ভুলের পাশাপাশি সমাসবদ্ধ শব্দের ভুল প্রয়োগ, মুদ্রণ প্রমাদ এবং সাধু ও চলিত ভাষার মিশ্রণসহ ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে ২৯টির বেশি ভুল চোখে পড়লেও তা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাতে নারাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি।

এ ব্যাপারে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জিনাত হুদার ভাষ্য, 'বানানে ভুল-শুদ্ধ বলে কিছু নেই'। 

এ অবস্থায় প্রশ্ন ওঠে—শিক্ষক সমিতির মতো সংগঠনের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এমন ভুলের ছড়াছড়ি এবং ভুল করেও তা স্বীকার করতে না চাওয়ার এমন প্রবণতা ঠিক কী বার্তা দেয়?

বিষয়টি নিয়ে জিনাত হুদার পাশাপাশি দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান, বাংলা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম, লেখক আহমাদ মোস্তফা কামাল ও জাকির তালুকদারের সঙ্গে।

এ ক্ষেত্রে জিনাত হুদা ছাড়া অন্য সবার ভাষ্য, এটি বাংলা ভাষার প্রতি অবমাননা ও চূড়ান্ত অবহেলার দৃষ্টান্ত। এমন ভুল অন্যদের মধ্যেও সংক্রমিত হতে পারে। এমন ঘটনায় যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়, তেমনি সমাজের কাছে শিক্ষকদের গ্রহণযোগ্যতাও কমে যায়।

তারা আরও বলছেন, ভুল করেও তা স্বীকার করতে না চাওয়ার যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, এই ঘটনা তারই প্রতিফলন।

ঢাবি শিক্ষক সমিতির সংবাদ বিজ্ঞপ্তি। ছবি: সংগৃহীত

সম্প্রতি ঢাবি শিক্ষক সমিতি এ ধরনের অনেক ভুল করেছে মন্তব্য করে অধ্যাপক তানজীমউদ্দীন খান বলেন, 'শিক্ষক সমিতি তো শিক্ষক সমিতি না, এটা ক্ষমতাসীন দলের সমিতি। সাধারণ শিক্ষকদের স্বার্থের ব্যাপারে তো আমি তাদের কোনোকিছু করতে দেখি না। তাদের এ ধরনের ভুল প্রথম না। সম্প্রতি আমরা এরকম আরও কিছু পেয়েছি। এতে আমাদের ভাবমূর্তি তো ক্ষুণ্ন হয়ই, উপরন্তু সমাজের কাছে আমাদের শিক্ষকদের গ্রহণযোগ্যতা একেবারেই নিচের দিকে নেমে যায়।'

এদিকে এ ধরনের 'পাবলিক বিবৃতিতে' কোনো ধরনের ভুল থাকাই উচিত নয় বলে মনে করেন অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম।

আর ভুলের পরেও তা স্বীকার না করে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দেওয়া বক্তব্যের বিষয়ে এই অধ্যাপকের ভাষ্য, 'যদি এই ধরনের ভুলের পরেও সমিতির সাধারণ সম্পাদক এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে থাকেন, তাহলে সেটা ভালো হয়নি। বানানের ক্ষেত্রে যারা এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল, তাদেরকে দেখিয়ে নেওয়াই ভালো ছিল।'

বিজ্ঞপ্তিতে ঢাবি শিক্ষক সমিতির এমন ভুলের ছড়াছড়িকে বাংলা ভাষা ও সমগ্র বাঙালি জাতির প্রতি অবমাননা বলে মনে করেন লেখক জাকির তালুকদার। তিনি বলেন, 'একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবকিছু ধারণ করার কথা। বাংলা ভাষার শুদ্ধতা, উচ্চারণ, বানান ও সম্মান—এটা পুরোপুরিভাবে তাদের ধারণ করার কথা। সেই জায়গাটায় তারা অবমাননা ও চূড়ান্ত অবহেলার দৃষ্টান্ত রেখেছে। শুধু এবারই নয়, বারবার তারা এটা করেছে।'

জাকির তালুকদার আরও বলেন, 'তাদের এই ভুলগুলো অন্যদের মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে। তা নিয়েও তারা সচেতন না। এর পেছনে প্রশাসনের অবহেলা, অমনোযোগ ও অযোগ্যতারও অনেক বড় দায় আছে। আমি মনে করি, সব বিভাগের শিক্ষক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বাংলা ভাষার ওপর ক্লাস করানো উচিত।'

বিষয়টি নিয়ে লেখক আহমাদ মোস্তফা কামালের ভাষ্য, 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এ দেশের সবচেয়ে সম্মানিত পেশার মানুষ। তাদের কাছ থেকে শুদ্ধতা, সৌজন্য, জ্ঞান-প্রজ্ঞা মানুষ আশা করে। শুধু এটাই না, এর আগেও আমরা দেখেছি যে তাদের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে অনেক ভুল থাকে। আমরা যারা ঢাবির প্রাক্তন শিক্ষার্থী বা সাধারণ মানুষ, এতে আমাদের মনে হয় যে, এই বিবৃতি তারা যথেষ্ট আন্তরিকতা নিয়ে দেন না।'

বিজ্ঞপ্তি যিনি টাইপ করেন, তার ভুল হতেই পারে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'কিন্তু এটা যখন প্রচারমাধ্যমে দেওয়া হবে, তখন অন্তত ২-৩ জন মিলে কিংবা দায়িত্বপ্রাপ্ত কেউ এটা দেখবেন। তারপরে এটা প্রচারমাধ্যমে দিতে হয়। বিবৃতি তো কেউ সংশোধন করতে পারে না। বিবৃতি তো বিবৃতি আকারেই ছাপাতে হয়। বিবৃতি যখন পাঠানো হবে, তখন এই সচেতনতা খুবই দরকার যে, তাতে যেন আমাদের সম্মানটুকু থাকে।'

এই লেখক বলেন, 'এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা আমাদের শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের দেখে এসেছি। ফলে এই ধরনের ঘটনায় আমি বেদনাবোধ করি যে, এই ধরনের মানুষরা এখন শিক্ষক। তারা ভুল করেও সেটা স্বীকার করেন না এবং সৌজন্যটুকু দেখান না যে, ভুল হয়েছে এবং পরবর্তীতে আমরা সচেতন থাকব। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক।'

অবশ্য বিজ্ঞপ্তিতে বানান ও ভাষা ব্যবহারে অজস্র ভুলের মতো 'গুরুতর' বিষয়টিকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনতে চাননি ঢাবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জিনাত হুদা।

এ ব্যাপারে তিনি বলেন, 'আপনাদের বানান নিয়ে আপনারা থাকেন। এসব বানান নিয়ে আমি বলে দিয়েছি। যেগুলো টাইপিং এরর ছিল, গতকালই আমরা (ঠিক) করে দিয়েছি। তবে যে বানান আজীবন আমরা দীর্ঘ ঈ-কার দিয়ে লিখেছি, সেগুলো ওভাবেই লিখব। বানান ভুল আর শুদ্ধ বলে কিছু নাই। বাংলা একাডেমি আজকে একটা কথা বলেছে, ৫ বছর পর আরেকটা কথা বলবে। আজকে ডিজি চেঞ্জ হলে কালকে বাংলা একাডেমিও চেঞ্জ হয়ে যাবে।'

জিনাত হুদা বলতে থাকেন, 'জীবনেও "বাঙালি" হ্রস্ব ই-কার দিয়ে লিখি নাই, লিখবও না। হলিক্রস স্কুল ও কলেজের ছাত্রী আমি। বাংলা একাডেমি একটা ডিকশনারি বের করলে সেটা ওহি হয়ে গেছে? আপনি আমাকে বলতে পারতেন যে, আমি কি পুরোনো নিয়ম অনুসরণ করেছি নাকি নতুন নিয়ম। এটা তো ভুলের কোনো বিষয় না। সভাপতি মহোদয় কিংবা আমি বাংলা টাইপ করতে পারি না। আমরা টাইপিস্ট দিয়ে করিয়েছি। এখানেও সমস্যা আছে, অভ্র একটা করে, বিজয় আরেকটা করে। তারপরেও আমাকে যখন বলা হয়েছে, আমি টাইপিং এররগুলো কারেক্ট করে পাঠিয়ে দিয়েছি।'

এদিকে নিজের সম্পর্কে এই অধ্যাপকের মূল্যায়ন হলো, 'দুর্বল শিক্ষক আমি না এবং এত অমনোযোগী ছাত্রী আমি না। সুতরাং আমি যেটা শিখেছি, বুঝেছি, পড়েছি, সেটাই লিখেছি। সেটা একদম পরিষ্কার। আপনারা যেটা ভুল বলছেন, সেটার সঙ্গে আমি একমত না।'

Comments

The Daily Star  | English

Enforced disappearances: Eight secret detention centres discovered

The commission raised concerns about "attempts to destroy evidence" linked to these secret cells

7h ago