‘পানি সরারই ব্যবস্থা নাই, মশা সরব ক্যামনে?’

জলাবদ্ধতার সমস্যা
জলমগ্ন একটি ভবনের নিচ তলা। প্রতিদিন দুই বেলা মটর চালিয়ে এই পানি অপসারণ করা হয়। ছবি: স্টার

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) আওতাধীন পূর্ব জুরাইনের আউটার সার্কুলার রোড এলাকার বাসিন্দা আসাদুজ্জামানের (৪৫) জন্ম এখানেই। জলাবদ্ধতার সমস্যা নিরসনে এই সড়কটি বিভিন্ন সময়ে উঁচু করতে দেখেছেন তিনি। কিন্তু সে অনুসারে এখানকার ড্রেনেজ ব্যবস্থার সংস্কার সেভাবে করতে দেখেননি।

ফলে বৃষ্টি-বাদলা বাদেও এখন প্রতিদিন দুপুরে এখানকার বাসিন্দাদের গোসলের সময় নালার পানি উপচে সড়ক ভাসিয়ে নেয়। মাঝারি কিংবা ভারী বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। পানি সরতে কয়েক দিন পর্যন্ত লেগে যায়।

শুধু তাই নয়, দক্ষিণ সিটির সবচেয়ে দারিদ্রপ্রবণ এই এলাকাটির বেশিরভাগ সড়ক অপরিকল্পিতভাবে উঁচু করায় এখানকার অনেক ভবনের নিচতলার অবস্থান এখন রাস্তার উচ্চতা থেকে নিচে। যে কারণে এসব ভবনের নিচতলায় বছরের বেশিরভাগ সময় পানি জমে থাকে। যেসব ভবন মালিকের সামর্থ্য আছে তারা নিয়মিত মটর লাগিয়ে পানি অপসারণের ব্যবস্থা করেন। যাদের সেই সামর্থ্য নেই, তাদের নিচতলা পানিতেই ডুবে থাকে।

এর বাইরে এই এলাকার অধিকাংশ নালা কংক্রিটের স্ল্যাব দিয়ে ঢাকা থাকায় সেগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না। ফলে দীর্ঘদিনের ময়লা-আবর্জনা জমে নালাগুলোর প্রবাহমনতা থেমে যাওয়ায় সেগুলোও মশা উৎপাদনের একেকটি কারখানা হয়ে উঠেছে। তৈরি হয়েছে এক পূতিগন্ধময় পরিবেশ।

এ অবস্থায় আখতারুজ্জামান কোনোভাবেই ভেবে পান না যে, উল্লিখিত সমস্যাগুলোর সমাধান না করে কেবল ক্র্যাশ প্রোগ্রামের মতো 'লোকদেখানো' উদ্যোগ আর ভবন মালিকদের জরিমানা করে কীভাবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব! এ পর্যায়ে তিনি যে অতিসাধারণ প্রশ্নটি রাখেন তা হলো—'পানি সরারই ব্যবস্থা নাই, মশা সরব ক্যামনে?'

পূর্ব জুরাইনের একটি গলির চিত্র। ছবি: স্টার

একই প্রশ্ন রেখে এই এলাকার আরেক বাসিন্দা ও জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন নাগরিক আন্দোলনে যুক্ত মিজানুর রহমান বলেন, 'ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যা যা করা দরকার তার ধারে-কাছেও কিছু করতে দেখি না তাদের (সিটি করপোরেশনের)। এখানে যখন ক্র্যাশ প্রোগ্রাম চালু হলো তখন দেখলাম ছবি তোলার দিকে তাদের যতটা মনোযোগ তার সিকিভাগও অন্য দিকে নাই।'

'মশা উৎপাদনের ব্যবস্থা সিটি করপোরেশন নিজেরাই করে রেখেছে' মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, 'সিটি করপোরেশন খালি সচেতনতার কথা বলে। কিন্তু স্থানীয়দের সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ নেই। ওই যোগাযোগটা থাকলে হয়তো তারা সংকট আর সমস্যার কারণগুলো বুঝতে পারত। তারা সেটাও বোঝে না আবার রুটিন কাজটুকুও ঠিকমতো করে না। তাহলে মশা নিয়ন্ত্রণ হবে কীভাবে?'

আখতারুজ্জামান কিংবা মিজানুর রহমানের মতো দক্ষিণ সিটির আরও অনেক এলাকার বাসিন্দাদের পর্যবেক্ষণও মোটামুটি একইরকম। তারা বলছেন, ড্রেনেজ ব্যবস্থাসহ দক্ষিণ সিটির অনেক সড়কের অবস্থা বেহাল। পুরনো জলাবদ্ধতার সমস্যার সমাধান এখনো হয়নি। এ অবস্থায় 'আসল জায়গায় হাত না দিয়ে' মুখে সচেতনতার কথা বলে আর জরিমানা করে প্রাণঘাতী ডেঙ্গুর মোকাবিলা কীভাবে সম্ভব সেটা বুঝে উঠতে পারছেন না তারা।

এগ্লা আমরা নিয়তি বইলা ধইর‌্যা নিসি। বাড়ি নিচে কিংবা আশপাশে পানি থাকলে সিটি করপোরেশন আমগো জরিমানা করে। রাস্তায় পানি জমলে কে কারে জরিমানা করব বুইঝ্যা পাই না।

নাজিমুদ্দিন রোডের বাসিন্দা আমজাদ হোসেন

কথা হয় পুরান ঢাকার কাজী আলাউদ্দিন রোডের বাসিন্দা আকবর আলী খানের সঙ্গে। তিনি বলেন, '২ বছরের বেশি সময় ধরে আলাউদ্দিন রোডের রাস্তা ও নালার সংস্কারকাজ চলছে। অথচ ৬ মাসে এই কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। আগের অবস্থা তাও একরকম ছিল। এখনকার দুর্ভোগ বলে বোঝানো যাবে না।'

পুরান ঢাকার আরও কিছু এলাকা ঘুরে দেখা যায়, লালবাগের আর এন ডি রোড, কাজী রিয়াজউদ্দিন রোড, চকবাজারের ওয়াটার ওয়ার্কস রোড, নাজিমুদ্দিন রোড ও বংশালের বেগমবাজার এলাকার সড়কের অবস্থাও খুব ভালো নয়।

এর মধ্যে নাজিমুদ্দিন রোডের বাসিন্দা আমজাদ হোসেন বলেন, 'এগ্লা আমরা নিয়তি বইলা ধইর‌্যা নিসি। বাড়ি নিচে কিংবা আশপাশে পানি থাকলে সিটি করপোরেশন আমগো জরিমানা করে। রাস্তায় পানি জমলে কে কারে জরিমানা করব বুইঝ্যা পাই না।'

ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা ডেঙ্গুর প্রকোপের মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর মোট সংখ্যায় অতীতের সব রেকর্ড মুছে দিয়েছে ২০২৩ সাল।

গত একদিনে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরও ২ হাজার ১৯৭ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। তাতে দেশে মোট ভর্তি রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২ হাজার ১৯১ জনে।

ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর এই সংখ্যা এ যাবৎকালে সর্বোচ্চ। বাংলাদেশে আর কোনো বছর হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা লাখের ঘর ছাড়ায়নি। গত একদিনে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে আরও ৯ জনের। তাতে এ বছর মশাবাহিত এ রোগে মোট ৪৮৫ জনের মৃত্যু হলো। ডেঙ্গুতে এক বছরে এত মৃত্যুও আর কখনো দেখেনি বাংলাদেশ।

তারা (সিটি করপোরেশন) যেভাবে মানুষকে দোষারোপ করে কথা বলে সেটা কিছুটা না বুঝে, আর বাকিটা মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা না থাকার ফল। এনারা যদি সত্যিকার অর্থে মানুষের ভোটের দ্বারা নির্বাচিত হতেন এবং মানুষের কাছে যদি দায়বদ্ধ থাকতেন তাহলে এই ধরনের ঘটনাগুলো ক্রমান্বয়ে কমে আসত।

বে-নজীর আহমেদ, সাবেক পরিচালক (রোগনিয়ন্ত্রণ), স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

এমন পরিস্থিতিতে ডেঙ্গুর বিস্তারের কারণ হিসেবে 'নগরবাসী সচেতন না' কিংবা 'নগরবাসীর মধ্যে সচেতনতার অভাব আছে' এমন নানা বক্তব্য শোনা যাচ্ছে ঢাকার দুই সিটির নগরপিতাসহ কর্তাব্যক্তিদের কাছ থেকে। মানুষের বাড়িতে বাড়িতে অভিযান চলছে। এডিসের লার্ভা পেলে করা হচ্ছে জরিমানা।

তবে জুরাইন ও পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের মতোই গত ১৯ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে ডেঙ্গু তথা মশা নিয়ন্ত্রণের নামে যা যা কিছু চলছে সেগুলোকে 'তামাশা' বলে অভিহিত করেন দেশের কয়েকজন শীর্ষ কীটতত্ত্ববিদ।

প্রায় একই ধরনের অভিমত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বে-নজীর আহমেদের। তার ভাষ্য, লোকজন সচেতন হচ্ছে না বলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না—এই কথাটা সত্য নয়। লোকজন সচেতন। কিন্তু সাধারণ মানুষের একটা কারিগরি সীমা আছে। সেই কারিগরি দক্ষতা বা জ্ঞানটা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা বুঝতেই পারবে না। এখানে প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা লাগে। কারিগরি বিশেষজ্ঞের সহযোগিতা লাগে। এই জিনিসটা আমরা কিছুতেই সিটি করপোরেশনসহ অনেককে বোঝাতে পারছি না।'

বৃষ্টি-বাদলা ছাড়াই নালার উপচে পড়া পানিতে সয়লাব পূর্ব জুরাইনের মেডিকেল রোড। ছবি: স্টার

দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি আরও বলেন, 'তারা (সিটি করপোরেশন) যেভাবে মানুষকে দোষারোপ করে কথা বলে সেটা কিছুটা না বুঝে, আর বাকিটা মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা না থাকার ফল। এনারা যদি সত্যিকার অর্থে মানুষের ভোটের দ্বারা নির্বাচিত হতেন এবং মানুষের কাছে যদি দায়বদ্ধ থাকতেন তাহলে এই ধরনের ঘটনাগুলো ক্রমান্বয়ে কমে আসত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ঢাকাসহ বড় সিটিগুলোতে ভোটদানে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ অনেক কম। ওনারাও এটা জানেন যে, কে ভোট দিলো না দিলো তাতে তাদের কিছু আসে যায় না। এই পরিস্থিতির কারণেই যেখানে মানুষ জনপ্রতিনিধিদের দোষারোপ করবে, সেখানে উল্টো জনপ্রতিনিধি বা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মানুষকে দোষারোপ করে।'

মানুষের সাধ্যের মধ্যে কিছু থাকলে সেটা তাদের দিয়ে করানো সম্ভব মন্তব্য করে বে-নজীর আহমেদ বলেন, 'মানুষকে টিকা দেওয়ার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। মানুষ টিকাকেন্দ্রে গেছে। এভাবে বাংলাদেশে টিকার হার গত ৪০ বছরে ৮৫ শতাংশের ওপরে পৌঁছেছে। তার মানে মানুষকে দিয়ে বড় কাজ করানো যায়। এক্ষেত্রে পরিবার পরিকল্পনার উদাহরণ আসতে পারে, স্যালাইন ব্যাবহারের প্রসঙ্গও আসতে পারে।

'তার মানে, আমাদের দেশের লোকজনকে ভালোমতো উদ্বুদ্ধ করলে এবং সেটা তার সাধ্যের মধ্যে থাকলে তারা সেটা করে থাকে।'

এ পর্যায়ে জুরাইনের পরিস্থিতির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'যখন রাস্তাগুলো উঁচু করা হলো, তখন তো এটাই স্বাভাবিক যে নিচু বাড়িগুলোতে বৃষ্টির পানি জমবে। তাহলে সেভাবে ড্রেনেজ সিস্টেমটা কেন তৈরি করা হলো না? এই জায়গাগুলো হয়ে গেছে এডিস মশা প্রজননের উর্বর ক্ষেত্র। এগুলো সাধারণ মানুষের পক্ষে ডিটেক্ট করা সম্ভব না। এটা বুঝতে রীতিমতো বিশেষজ্ঞ লাগে। যাদের আমরা বলি কীটতত্ত্ববিদ, কীটতাত্ত্বিক সহকারী। তারা পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে, জরিপ করে, ল্যাবরেটরিতে মাইক্রোসকোপে দেখে এগুলো বুঝতে পারেন। এটা কোনো সহজ বিষয় নয়। যেহেতু সহজ নয় সেহেতু লোকজন পার্টিসিপেট করতে পারছে না। এই জিনিসটা সিটি করপোরেশন কিছুতেই বুঝছে না।'

আউটার সার্কুলার রোড ও এর ড্রেনেজ ব্যবস্থার বেহাল দশা। ছবি: স্টার

অবশ্য ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুর কবিরের বক্তব্য, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে 'যতটুকু করা সম্ভব ততটাই করা হয়েছে'। তিনি বলেন, 'আমরা আমাদের পক্ষ থেকে যতদূর সম্ভব করেছি। করেছি বলেই ১৫-২০ দিন আগেও ‍জুরাইন-যাত্রাবাড়ি এলাকায় যে পরিমাণ ডেঙ্গু রোগী ছিল এখন তার সংখ্যা চার ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে। আমরা কাজ করেছি বলেই এটা হয়েছে।'

বাড়িতে বাড়িতে জমে থাকা পানির বিষয়ে তার ভাষ্য, 'মানুষের বাড়ির নিচের পানি আমি কেন পরিষ্কার করব? এটা ওই বাড়ির মালিককেই করতে হবে।'

তাহলে রাস্তা উঁচু করার সময় পানি অপসারণের বিষয়টি কেন মাথায় রাখা হলো না—এমন প্রশ্নের জবাবে ডেইলি স্টারকে এই স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন, 'এটার জন্য আপনাকে প্রকৌশল বিভাগের সঙ্গে কথা বলতে হবে। কারণ রাস্তা মেরামত, ড্রেনেজ এটা ওনাদের হাত দিয়ে হয়। এটার সঙ্গে আমি সংযুক্ত না।'

 

Comments

The Daily Star  | English

Tanvir takes five as Tigers clinch 2nd Sri Lanka ODI

Bangladesh captain Mehidy Hasan Miraz has won the toss and opted to bat first in the second ODI against Sri Lanka, looking to keep the three-match series alive with a win at the R Premadasa Stadium today. 

17h ago