ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ: কলকাতা পারলেও ঢাকা কেন পারছে না

চলতি বছর বাংলাদেশে ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর মোট সংখ্যা ৩৭ হাজার ছাড়িয়েছে। মৃত্যু হয়েছে ২০১ জনের। বিপরীতে গত ২০ জুলাই পর্যন্ত কলকাতায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ২৬০ জন। মারা গেছেন মাত্র ১ জন।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ঢাকায় ফগিং কার্যক্রম। স্টার ফাইল ফটো

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের ইতিহাস কাছাকাছি সময়ে। ১৯৬৩ সালে কলকাতায় প্রথম ডেঙ্গু মহামারি আকারে দেখা দেওয়ার পর ঢাকায় ১৯৬৫ সালে এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়।

এই দুই ঐতিহাসিক শহরের জনসংখ্যার আধিক্য, নগরায়ণের প্রকৃতি কিংবা ভৌগলিক বৈশিষ্ট্যও প্রায় অভিন্ন। তবে বিগত ১০ বছর ধরে ডেঙ্গু রোগের জীবানুবাহী এডিশ মশা নিধন ও বিস্তার রোধে আটঘাট বেঁধে নেমে কলকাতা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন যে সফলতা পেয়েছে, ঢাকায় সে সাফল্য এখনো অধরা। সেইসঙ্গে দিনে দিনে ঢাকার বাইরেও যেভাবে রোগটি ছড়িয়ে পড়ছে, সেটাও ভাবিয়ে তুলেছে সবাইকে।

চলতি বছর বাংলাদেশে ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর মোট সংখ্যা ৩৭ হাজার ছাড়িয়েছে। মৃত্যু হয়েছে ২০১ জনের। এরমধ্যে একদিনে সর্বোচ্চ ১৯ জন মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

জনস্বাস্থ্যবিদ ও চিকিৎসকদের আশঙ্কা, এবার ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা আগের সব বছরকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। আর আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লে সেই হারে বাড়তে পারে মৃত্যুর সংখ্যাও।

বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৭ হাজার ৯২৭ জন রোগী। তাদের মধ্যে ঢাকায় ৪ হাজার ৬৪৬ জন এবং ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ৩ হাজার ২৮১ জন।

বিপরীতে কলকাতা মিউনিসিপ্যালের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে গত ২০ জুলাই পর্যন্ত কলকাতায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ২৬০ জন। মারা গেছেন মাত্র ১ জন।

এমন একটি পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কলকাতার সাফল্য ও ঢাকার ব্যর্থতার কারণ নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে কলকাতা মিউনিসিপ্যাল করপোরশেনের মুখ্য পতঙ্গবিদ ও মশকনিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীয় কমিটির প্রধান দেবাশীষ বিশ্বাস, বাংলাদেশের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বে-নজীর আহমেদ এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবিরের সঙ্গে।

তালিকার শুরুর ৩ জন বলছেন, কলকাতা মিউনিসিপ্যাল ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘদিন ধরে একটি নির্দিষ্ট ব্যবস্থাপনার আওতায় সমন্বিতভাবে কাজ করছে। সেখানে মিউনিসিপ্যালের সঙ্গে এই কাজে যুক্ত আছে রাজ্যের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ও কমিউনিটির লোকজন। ওয়ার্ডভিত্তিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই দেওয়া হচ্ছে ডেঙ্গুর চিকিৎসা। কিন্তু বাংলাদেশে এসবের কিছুই হয়নি। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এখানকার রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতিও প্রবল। এ ছাড়া ঢাকায় মশক নিধন কিংবা নিয়ন্ত্রণের কাজে যাদের ব্যবহার করা হয় তাদের কারুরই এ সংক্রান্ত কোনো কারিগরি জ্ঞান নেই। ফলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যতটুকু উদ্যোগ নেওয়া হয়, সেটাও তেমন কোনো কাজে আসে না।

তবে কলকাতা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ঠিক কতটা সফল তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন দক্ষিণ সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির।

ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথোপকথনে কলকাতা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কীভাবে কাজ করছে তার একটি ধারণা দিয়েছেন কলকাতা মিউনিসিপ্যালের মূখ্য পতঙ্গবিদ দেবাশীষ বিশ্বাস। তার ভাষ্য, কেবল রাজনৈতিক সদিচ্ছাই এই কাজে তাদের অনেকদূর এগিয়ে দিয়েছে। 

দেবাশীষ বিশ্বাস জানান, শুরু থেকেই যে লক্ষ্য নিয়ে কলকাতা এগিয়েছে তার মূলে আছে ফগার মেশিন দিয়ে মশা না তাড়িয়ে উৎপত্তিস্থলেই মশাকে নিধন করে এর বংশবিস্তার রোধ করা। এ জন্য বৃষ্টির মৌসুম আসার আগেই নভেম্বর থেকে জুন— এই ৮ মাস কাজ করেন তারা।

কলকাতায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ৩ স্তরের পরিকাঠামো ও গবেষণাগার গড়ে তোলার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, 'কলকাতা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের মোট ১৬টি বরো (প্রশাসনিক অঞ্চল) এবং ১৪৪টি ওয়ার্ড আছে। প্রতিটি বরোতে আছে ৭ থেকে ১২টি করে ওয়ার্ড। আর প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে মশা নিয়ন্ত্রণ কমিটি আছে। এতে ওয়ার্ড কাউন্সিলর, চিকিৎসক ও স্থানীয় ব্যক্তিরা যুক্ত আছেন। আছেন অন্তত ৬ জন করে মশককর্মী। এদের প্রত্যেকের মশা নিয়ন্ত্রণের প্রশিক্ষণ আছে। এসব ওয়ার্ড কমিটির কাছে এলাকার সম্ভাব্য ডেঙ্গুর উৎসস্থলের তালিকা ও সামগ্রিক তথ্যভাণ্ডার আছে।'

দেবাশীষ বিশ্বাস বলেন, 'এই তথ্যভাণ্ডার তৈরির কাজটি আমরা করেছি ২০১৩ সালে। ওয়ার্ড কমিটির ওপরের বরো কমিটিতেও একটি মশা নিয়ন্ত্রণ কমিটি আছে। এই কমিটিতে একজন কীট নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা ও চিকিৎসক আছেন। প্রতিটি বরোতে ২টি করে মোট ৩২টি র‌্যাপিড অ্যাকশন টিম আছে। এই টিম বছরভর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস, বিপণিবিতান, থানা ও বেসরকারি বড় স্থাপনাসহ নানা জায়গায় নজরদারি করে।'

দেবাশীষ জানান, বরো কমিটির ওপর আছে কলকাতা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের মশকনিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীয় কমিটি। এই কমিটিতে একজন জ্যেষ্ঠ কীটতত্ত্ববিদ ও ৩ জন মশকনিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা আছেন। এই কমিটিই সার্বিক কাজ তত্ত্বাবধান করে থাকে, যার প্রধান হচ্ছেন তিনি।

দেবাশীষ বিশ্বাস বলেন, 'কেউ যদি মনে করে কোনো একক প্রতিষ্ঠান কিংবা সরকারের একার পক্ষে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, সেটা খুবই ভুল একটা ধারণা। সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া এখানে কিছুই করা সম্ভব না। আর ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সবার আগে জরুরি রাজনৈতিক সদিচ্ছার বিষয়টি।'

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কলকাতার যতটুকু সফলতা তার জন্য মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের ডেপুটি মেয়র অতীন ঘোষকে কৃতিত্ব দেন দেবাশীষ বিশ্বাস। বলেন, 'অতীন ঘোষ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিকে রীতিমতো একটি সামাজিক আন্দোলনে রূপ দিয়েছেন। তার নেতৃত্বেই হয়েছে সবকিছু।'

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে অতীন ঘোষের ভূমিকা নিয়ে 'দ্য পাবলিক ফিগার বিহাইন্ড পাবলিক হেলথ' নামের একটি বইও লিখেছেন দেবাশীষ বিশ্বাস। ওই বইয়ে তিনি অতীন ঘোষের ভূমিকা নিয়ে বলেছেন, 'বিশ্বের নানা প্রান্তের যেসব রাজনৈতিক নেতা জনস্বাস্থ্যমূলক কাজে নিস্পৃহ থাকেন, কলকাতার এই নেতার (অতীন ঘোষ) কাছে তাদের অনেক কিছু শেখার আছে।'

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক নেতৃত্বের এমন ভূমিকাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে অভিহিত করেন জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেনও। তিনি বলেন, 'এখানে পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট অ্যান্ড পলিটিক্যাল লিডারশিপ প্রাইম একটি বিষয়। যেটা কলকাতাতে হয়েছে। কলকাতার মেয়র ও কাউন্সিলররা এখনো এটা করে যাচ্ছেন।'

তার ভাষ্য, 'রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি সিরিয়াস না হয় তাহলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের কাজটি সফল করা খুবই কষ্টকর। তাদের সিরিয়াসনেসটাই সঞ্চারিত হয় যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত আছেন তাদের মধ্যে। এটা হচ্ছে প্রধান শর্ত।'

এর বাইরে ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে জনসম্পৃক্ততার বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন ডা. মুশতাক। তিনি বলেন, 'আমাদের এখানে কমিউনিটি এনগেজমেন্টের ব্যাপারটা হচ্ছে না। এমনিতে এই কাজে লজিস্টিকস লাগে, আরও অনেক কিছু লাগে। কিন্তু কমিউনিটি এনগেজমেন্টটাকে একটি বিষয় ধরে নিয়ে কিছু করার কাজটি এখানে হয় না। এখানে কমিউনিটি এনগেজমেন্টকে একটা এক্সট্রা জিনিস হিসেবে ধরা হয়। ধারণা করা হয়, কীটনাশক প্রয়োগ করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।'

ডা. মুশতাক আরও বলেন, 'ডেঙ্গুর সোর্স হচ্ছে এডিস মশা এবং রোগী। ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে দুটো সোর্সকেই আটকাতে হয়। সেই কাজটা এখানে হয় না। এটা কমিউনিটি এনগেজমেন্ট ছাড়া অসম্ভব।'

২০১৯ সালের ভয়াবহ ডেঙ্গু পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত অন্যান্য রোগ প্রতিরোধে একটি জাতীয় নির্দেশিকা তৈরি করেছিল স্থানীয় সরকার বিভাগ। ওই নির্দেশিকা বা গাইডলাইন সম্পর্কে ডা. মুশতাক বলেন, 'সেখানে বলা আছে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কোন কোন পর্যায়ের কমিটিগুলো কেমন হবে, কে কে দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকবেন, ভলান্টিয়ারদের কীভাবে কাজে লাগাতে হবে। একটা ওয়ার্ডে কীভাবে কাজ হবে সেটার নির্দেশনাও আছে সেখানে। প্রত্যেকটা পাড়া, মহল্লা বা গলিভিত্তিক ডেঙ্গু প্রতিরোধ কমিটি তৈরি এবং তাদের কার্যপরিধির কথাও বলা আছে সেখানে। সেটা কিন্তু কার্যকরী হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না সেটাও বোঝা যাচ্ছে না।'

কলকাতার পারলেও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ঢাকার ব্যর্থতা প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বে-নজীর আহমেদের বক্তব্য হলো, 'কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন যে কার্যক্রম, সেই কার্যক্রমটা কলকাতায় আছে, আমাদের এখানে নেই। ডেঙ্গু যেহেতু কীটবাহিত একটা রোগ এবং কীটকে নিয়ন্ত্রণে আনা এই রোগ নিয়ন্ত্রণের মূল উপজীব্য, সেখানে যদি এন্টোমলজিক্যাল (কীটতত্ত্ব) ক্যাপাসিটি না থাকে, টেকনিক্যাল গাইডেন্সটা না থাকে তাহলে আমরা যে কাজগুলো করছি সেই কাজগুলো কখনোই কার্যকরী হবে না। ফলে গত ২৩ বছর ধরে আমরা এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না।'

বে-নজীর আহমেদ বলেন, 'ওখানে (কলকাতায়) এন্টোমলজিক্যাল ল্যাবরেটরি আছে, সেখানে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় এবং তার ওপর ভিত্তি করে তারা কন্ট্রোল মেজার নেন। ওই এলাকায় যদি কোনো ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যায়, তাহলে বিশেষ মেজার নেন। ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব যখন হয়, তার আগে থেকেই তারা কার্যক্রম নিয়ে এডিস মশার ঘনত্বকে একটা লেভেলে নামিয়ে এনে রাখেন, যেটা ডেঙ্গু ছড়াতে দেয় না। এটা তারা প্রত্যেক বছরই নিশ্চিত করছেন। করতে করতে এখন তারা মোটামুটি কন্ট্রোলড অবস্থায় নিয়ে এসেছেন।'

এদিকে ঢাকায় মশক নিয়ন্ত্রণের কাজটি মূলত মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের মাধ্যমে করা হচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, 'তারা (মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মী) নিরক্ষর মানুষ, যাদের কোনো কারিগরি জ্ঞান নেই। তাদের যদি বলা হয় তোমরা ড্রেনে ফগিং করো, সে ফগিং করবে। যদি বলা হয় লার্ভিসাইড করো, সে সেটাই করবে। কিন্তু এটা নিয়ে সার্ভে করা, গবেষণা করা, নানা পদ্ধতি তৈরি করা—এগুলো তাদের পক্ষে সম্ভব না।

'তাহলে এই কাজটা এখানে কারা করে? যারা সুপারভাইজার তারা। তারা হলো সাধারণ ডিগ্রি করা লোকজন। তাদেরও কোনো কারিগরি জ্ঞান নেই। সুতরাং তারা কেবল ধারণার ওপর ভিত্তি করেই কাজ করান।'

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে কেবল ১ জন কীটতত্ত্ববিদ আছেন জানিয়ে বে-নজীর আহমেদ আরও বলেন, 'দক্ষিণে একজনও (কীটতত্ত্ববিদ) নেই। ঢাকায় অনেক উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, কিন্তু যেহেতু কারিগরি বিষয়টির মূল্যায়ন হচ্ছে না, ফলে এটা কার্যকরী হচ্ছে না। আর ঢাকায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগগুলো হয় মূলত এডহক ভিত্তিতে। যেমন যখন প্রাদুর্ভাব বেড়ে গেল তখন। কিন্তু এটা হওয়া উচিত ছিল যখন বেড়ে যায়নি তখন। মৌসুমের আগেই। যাতে করে আদৌ রোগটা না ছড়ায়।'

ঢাকার ডেঙ্গু পরিস্থিতি ইতোমধ্যে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে বলে মন্তব্য করেন সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ বে-নজির আহমেদ। তিনি বলেন, 'যদি রোগটা না ছড়াতে পারে তাহলে ভবিষ্যতেও এই রোগটাকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। আর রোগটাকে যদি ছড়াতে দেওয়া হয়, তাহলে শুধু এটা ঢাকায় না; সবখানেই ছড়াবে। কারণ, যত বেশি এডিস মশা হবে, তত বেশি এরা ডিম পাড়বে, তত বেশি করে মানুষকে কামড়াবে। এই ঘটনাটা পৌনঃপুনিকভাবে হতে হতে আমরা এমন একটি জায়গা চলে এসেছি যে, তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এখন ঢাকার বাইরে এটা ছড়িয়ে পড়ায় আগামী ২০-৩০ বছরের জন্য আমরা একটা ঝুঁকি তৈরি করে ফেললাম দেশের জন্য। কারিগরি বা টেকনিক্যাল দিকগুলো না দেখার ফলেই আমরা খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত একটি পরিস্থিতি তৈরি করলাম।'

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের বিষয়টি 'খুবই কঠিন' মন্তব্য করে বে-নজীর আহমেদ বলেন, 'যদিও শুনছি যে, সিটি করপোরেশনগুলো কীটতত্ত্ববিদের একটা অরগ্যানোগ্রাম তৈরি করছে। সেটা যদি হয় তাহলে হয়তো কিছুটা রিলিফ পাবো। তাছাড়া এর পুনরাবৃত্তি হতেই থাকবে।'

এসবের বাইরে ডেঙ্গুর বিস্তার রোধ ও এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে 'পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট'র বিষয়টি জরুরি বলে মনে করেন বে-নজীর আহমেদও। তার ভাষ্য, 'এই জায়গায় আমাদের ঘাটতি আছে। আমাদের সিটি করপোরেশনের মেয়র কিংবা কাউন্সিলর যারা আছেন, মানুষের কাছে তাদের জবাবদিহিতা কম। সুতরাং আমার ওয়ার্ডটাকে আমি ডেঙ্গুমুক্ত রাখব—এমন কোনোকিছু কোনো জনপ্রতিনিধির মুখ থেকে শোনা যায় না।'

বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামের মোবাইলে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরে বিষয় জানিয়ে খুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।

অবশ্য গত সোমবার উত্তর সিটির বাজেট ঘোষণা অনুষ্ঠানে মেয়র জানান, এবারের বাজেটে মশা নিয়ন্ত্রণে সব মিলিয়ে ১২১ কোটি ৮৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে মশা নিধনকাজ পরিচালনার জন্য ৮৪ দশমিক ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আর মশার ওষুধ কেনায় ব্যয় হবে ৪৫ কোটি টাকা। ৩০ কোটি টাকা ব্যয় হবে বেসরকারি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিয়োজিত মশককর্মীদের দিয়ে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনায়।

বর্তমান ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে মশক নিয়ন্ত্রণে ডিএনসিসি সঠিক পথে আছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে ওই অনুষ্ঠানে মেয়র বলেন, 'আমরা এতকিছু করছি, এর পরও মশা কেন নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না- এই প্রশ্নের উত্তর আমরাও জানি না। আমরাও এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি, আসলে সমস্যাটা কোথায়?'

এদিকে কলকাতার ডেঙ্গু পরিস্থিতি ঠিক কতটা নিয়ন্ত্রণে আছে তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন দক্ষিণ সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির। তিনি বলেন, 'আমার কাছে যে তথ্য আছে তাতে দেখা যাচ্ছে গত বছরও কলকাতার মানুষ মিউনিসিপ্যালের সামনে গিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার প্রতিবাদে। তাই বলা যায় কোনো কোনো বছর তারা সফল হয়েছে, কোনো বছর হয়নি।'

শামসুল কবির আরও বলেন, 'আমি নিজেদের শুধু কলকাতার সঙ্গে তুলনা করব না। অন্য দেশের সঙ্গেও তুলনা করব। যেমন মালয়েশিয়ায় সোমবার পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৬২ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও সিঙ্গাপুরেও প্রচুর আক্রান্ত আছে। কলকাতা কতটা সফল তা দেখার জন্য মৌসুম শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আমরা পৃথিবীর সব দেশ থেকেই শিখতে চাই। কলকাতা যদি সফল হয়ে থাকে আমরা সেই খবর নেব। যদি শেখার মতো কিছু থাকে আমরা অবশ্যই শেখার চেষ্টা করব।'

Comments